• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    অ্যানফিল্ড থেকে আগুয়েরো : শেষদিনের শিরোপা রোমাঞ্চ

    অ্যানফিল্ড থেকে আগুয়েরো : শেষদিনের শিরোপা রোমাঞ্চ    

    "আগুয়েরোওওওওও.... আই সোয়ের ইউল নেভার সি এনিথিং লাইক দিস এভার এগেইন"- ২০১২ সালে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের বিপক্ষে সার্জিও আগুয়েরোর গোলের পর মার্টিন টেইলরের ধারাভাষ্যটা হয়ে গেছে ফুটবলের ইতিহাসের অংশ। ৯৪ মিনিটের ওই গোলেই প্রিমিয়ার লিগ জিতেছিল ম্যানচেস্টার সিটি। টেইলর সেদিন একটা নিশ্চয়তা দিয়ে রেখেছিলেন, এমন কিছু আর কখনই দেখবেন না আপনি। কিন্তু ৬ বছর পরই আবার সেরকম কিছুর অপেক্ষা করতেই পারেন আপনি। প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা এবারও ঝুলে আছে শেষদিনে পর্যন্ত। ম্যানচেস্টার সিটি-লিভারপুলের পয়েন্ট ব্যবধান এক। লিগের শেষদিনে এমন রোমাঞ্চ সেবারই প্রথম ছিল না, আর এবারও শেষ নয়। প্রিমিয়ার লিগ যখন আরও একবার নাটকীয় সমাপ্তির অপেক্ষায়, তখন পুরনো গল্পগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন


    ১৯৮৮-৮৯ : অ্যানফিল্ডে হাহাকার তুলে আর্সেনালের শিরোপা উদযাপন   


     

    শেষদিনে পয়েন্ট টেবিলের প্রথম আর দ্বিতীয় দলের খেলা। শীর্ষে থাকা লিভারপুল আর্সেনালের চেয়ে এগিয়ে ছিল ৩ পয়েন্টে। গোলব্যবধানেও এগিয়ে অলরেডরা, +৪। খেলাটাও অ্যানফিল্ডে। অর্থাৎ আর্সেনালকে ফার্স্ট ডিভিশন শিরোপা জিততে হলে অ্যানফিল্ডে লিগের শেষদিনে লিভারপুলকে হারাতে হত দুই গোল ব্যবধানে।

    প্রথমার্ধে লিভারপুলের কাউন্টার অ্যাটাক সামলে ভালোই খেলল আর্সেনাল। কিন্তু গোলশূন্য প্রথমার্ধ। বিরতির সময় শিরোপার পথে এক পা দিয়ে রেখেছিল কেনি ডালগ্লিশের দল। কিন্তু বিরতির পর খুব বেশিক্ষণ আর আর্সেনালকে আটকে রাখতে পারল না লিভারপুল। ৫২ মিনিটে অ্যালান স্মিথের গোলে শিরোপার লড়াই আরও জমিয়ে তুলল আর্সেনাল।

    এক গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ ৮৫ মিনিট পার হওয়ার পর লিভারপুল একরকম সময় অপচয়ের পথই বেছে নিয়েছিল। বাকিটা গোল হজম না করে কাটিয়ে দিতে পারলেই তো শিরোপা নিশ্চিত। সেই কাজটা ভালোভাবেই করে যাচ্ছিল লিভারপুল। ২ মিনিট ইনজুরি সময়েও আর্সেনালকে হতাশ করে যাচ্ছিল তারা। কিন্তু ম্যাচ শেষের ১ মিনিট ১৮ সেকেন্ড বাকি থাকতে সেই অ্যালান স্মিথেরই আরেকটা পাস ডিবক্সের ঠিক সামনে গিয়ে পড়লো। লিভারপুলের কিংবদন্তী ডিফেন্ডার স্টিভ নিকোল শেষ মুহুর্তে চ্যালেঞ্জ করলেন। কিন্তু মাইকেল থমাস বল রিসিভ করে আর থামলেন না। ডিবক্সের ভেতর ঢুকে স্পটকিক নেওয়ার কাছাকাছি জায়গা থেকে গোল করে অ্যানফিল্ডকে স্তব্ধ করে দিলেন আর্সেনাল মিডফিল্ডার।

    ডাগ আউটে ডালগ্লিশের সঙ্গে তখন ঠায় দাঁড়িয়ে পুরো অ্যানফিল্ড। থমাসের ওই গোলের পর আর খেলা হয়েছিল মাত্র ৩৮ সেকেন্ড। শেষ বাঁশির পর অ্যানফিল্ডের পিনপতন নীরবতায় শিরোপা উল্লাস করেছিল আর্সেনাল।

    ১৯৯৪-৯৫ : অ্যানফিল্ডই শিরোপা ফিরিয়ে দিল ডালগ্লিশকে


    ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের শীর্ষস্থানে লিড দুই পয়েন্টের। দুইয়ে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবশ্য গোলব্যবধান অনেক ভালো ব্ল্যাকবার্নের চেয়ে। নিজেদের হাতে না থাকলেও শেষদিনে তাদের কাজটাও খুব কঠিন ছিল না। ওয়েস্টহামকে হারাতে হবে আপটন পার্কে। ওয়েস্ট হামের রেলিগেশন বাঁচানো হয়ে গেছে। লিগের শেষদিনে তাদের পাওয়ার মতোই নেই তেমন কিছু। ইউনাইটেডকে অবশ্য লিগ জিততে হবে করতে হচ্ছে প্রার্থনা। অ্যানফিল্ডে পয়েন্ট হারাতে হবে ব্ল্যাকবার্নকে। তাদের শেষ ম্যাচ লিভারপুলের বিপক্ষে। ব্ল্যাকবার্ন লিভারপুলের বিপক্ষে ড্র করলে আর ইউনাইটেড নিজদের ম্যাচে জিতে গেলে আরও একবার প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে যাবে অ্যালেক্স ফার্গুসনের দল।

    অ্যানফিল্ডে এবার প্রতিপক্ষ ম্যানেজার কেনি ডালগ্লিশ। তার ব্ল্যাকবার্ন ছুটছে ইতিহাস গড়তে। লিভারপুল কিংবদন্তীর সমর্থনের অভাব হলো না অ্যানফিল্ডে। বৈরি অ্যানফিল্ড সেদিন বন্ধুর মতোই বরণ করে নিয়েছিল ব্ল্যাকবার্নকে। সেটা পুঁজি করে দুর্দান্ত শুরুও করলো তারা। ৩৪ মিনিটে অ্যালান শিয়ারের গোলে এগিয়ে গেল ব্ল্যাকবার্ন। প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা শেষ ম্যাচেও হাল ধরলেন দলের। কিন্তু বিরতির পর গেল সবকিছু ওলট পালট হয়ে।

    ৬৪ মিনিটে জন বার্নসের গোলে সমতায় ফেরে লিভারপুল। তোতক্ষোণে আপটন পার্কে একবার পিছিয়ে পড়ে সমতায় ফিরেছে ইউনাইটেডও। কিন্তু ৯০ মিনিটে জেমি রেডন্যাপ ব্ল্যাকবার্নের স্বপ্ন দিলেন চুরমার করে। ফ্রি কিক থেকে গোল করে ব্যবধান করলেন ২-১। মাঠে থাকা ব্ল্যাকবার্ন খেলোয়াড়রা সব শেষই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যানফিল্ডের কোণায় ব্ল্যাকবার্ন সমর্থকদের উল্লাস তো অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে! ওয়েস্ট হামের বিপক্ষে জিততে পারেনি ইউনাইটেডও। তাই এই ম্যাচের ফলের কোনো গুরুত্বই থাকল না আর।

     

     

    এবার অ্যানফিল্ডে উল্লাসটা করতে পারলেন ডালগ্লিশ। লিভারপুল ম্যাচ জিতেছে, ইউনাইটেডও শিরোপা জেতেনি- অ্যানফিল্ডেরও তাই খুব বেশি আপত্তি থাকলো না সেই উদযাপনে ডালগ্লিশের দলকে খানিকটা সঙ্গ দিতে। 

    ২০১১-১২ : আগুয়েরোওওওও....  



    ইতিহাদের নাম তখন বসেনি ম্যানচেস্টারের এই স্টেডিয়ামে। পুরো মৌসুম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। রেড ডেভিলদের নয়েজি নেইবাররা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বছর পাঁচেকও হয়নি তখনও। কিন্তু এই সময়ে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে তখনও পর্যন্ত একমাত্র এফএ কাপ জেতাটাই সম্বল তাদের।

     

    লিগের তিন ম্যাচ বাকি থাকতেও শীর্ষ স্থানটা ছিল ম্যান ইউনাইটেডের অধীনে। এরপর মিডউইকের ম্যানচেস্টার ডার্বিতে জিতে সিটি ছুঁয়ে ফেলল ইউনাইটেডকে। দুইদলের পয়েন্ট সমান, গোলব্যবধানে এগিয়ে ম্যান সিটি। লিগ শেষ হতে বাকি দুই ম্যাচ। প্রথম ম্যাচটা জিতল দুই দলই। এরপর শেষ রবিবারের জন্য তোলা থাকল প্রিমিয়ার লিগ রোমাঞ্চ।

    শেষ ম্যাচে ঘরের মাঠে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্স ম্যান সিটির প্রতিপক্ষ। সিটির যখন শিরোপা নিশ্চিত করতে জয় দরকার, কিউপিআরের তখন জয় চাই রেলিগেশন এড়াতে। আর স্টেডিয়াম অফ লাইটে খেলা ম্যান ইউনাইটেডের। সিটির চেয়ে গোলব্যবধানে অনেক পিছিয়ে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের দল। সান্ডারল্যান্ডকে তাই শুধু হারালেই হবে না ইউনাইটেডের। সিটিকেও পয়েন্ট হারাতে হবে।

    একই সময় শুরু হওয়া দুই ম্যাচে, প্রথম গোল ইউনাইটেডের। ২০ মিনিটে ওয়েইন রুনির গোলে এগিয়ে গেছে ম্যান ইউনাইটেড। সিটি অফ ম্যানচেস্টারে তাই একটু একটু করে কেমন অস্বস্তি ভর করতে লাগল। কিন্তু সেটা বিরতি পর্যন্ত টেনে নিতে দিলেন না পাবলো জাবালেতা। ৩৯ মিনিটে গোল করে তিনিও ম্যান সিটিকে এগিয় নিলেন। বিরতির সময় সিটি অফ ম্যানচেস্টার স্টেডিয়ামে বিটলসের 'হেই জুড' গানের তালে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে ছিল সিটিজেনরা।

    কিন্তু কী থেকে যেন কী হয়ে গেল! ৪৮ মিনিটে জিব্রেইল সিসের গোলে সমতায় ফিরল কিউপিয়ার। স্তব্ধ স্টেডিয়ামে শুধু শোনা গেল সিসের উল্লাস। এর কিছুক্ষণ পর অবশ্য জোয়ি বার্টন নিজেও সব আলো কেড়ে নিলেন। সাধারণত বেশিরভাগ সময়ে যে কারণে শিরোনাম হন তিনি সেটাই করলেন আরেকবার। মেজাজ গরম করে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন দলকে রেলিগেশন যুদ্ধে রেখে।

    প্রতিপক্ষ ১০ জনের দল, সিটির কাজ আরও সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু সব আয়োজনে পানি ঢেলে ৬৬ মিনিটে জন ম্যাকেই আরও একবার গোল করলেন কিউপিএআরের হয়ে। সেই গোল সিটি সমর্থকদের বুকে গিয়ে বাধল শেলের মতো। আর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে তখন ম্যানচেস্টারের লাল অংশে। ম্যান সিটি আরও একবার পা হড়কাচ্ছে....

    খেলা প্রায় শেষ। স্নায়ুর চাপে সিটি সমর্থকদের অনেকেই কাঁদা শুরু করে দিয়েছেন তখন। ইনজুরি সময়ে শুরু হতে হতে রবার্তো মানচিনিও হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন। ৪৪ বছর পর শিরোপার এতো কাছাছি এসে খালি হাতে ফিরতে হলে কোথায় মুখ লুকাবেন সিটি সমর্থকেরা? এই সুযোগ হাতছাড়া করলে আর কোনোদিন কি ছুঁয়ে দেখা হবে শিরোপা? চাপে পড়া মুহুর্তে তাই ঘরের মাঠের গুমোট পরিবেশও প্রতিপক্ষ হয়েছিল মাঠের সিটির খেলোয়াড়দের।

    ৫ মিনিট এক্সট্রা টাইমের দ্বিতীয় মিনিটে এডিন জেকো করলেন গোল। ম্যান সিটি ২-২ কিউপিআর। স্টেডিয়াম অফ লাইটে তখন খেলা শেষ। ইউনাইটেড নিজেদের কাজ সেরে ফেলেছে। কিন্তু টানেলের পথ ধরেননি রুনি, গিগসরা। মাঠেই থাকলেন ইউনাইটেডের সবাই, অন্য খেলার ফল জানতে।

    ইউনাইটেডকে শেষে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল সান্ডারল্যান্ড সমর্থকদের উল্লাস দেখে। মারিও বালোতেল্লি বলটা কোনোমতে ডিবক্সের ভেতর ডান কোণায় দিলেন সার্জিও আগুয়েরোকে। ৯৩ মিনিট ২১ সেকেন্ড তখন ম্যাচে, প্রথমবার বলে শট নিলেন না আগুয়েরো। দারুণ এক টাচে এক ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে চলে গেলেন গোলের কাছে। সময় তখন স্থির হয়েছিল আগুয়েরোর সামনে। নইলে স্নায়ুক্ষয়ী ওই মুহুর্তে অমন নিখুঁত ফিনিশ কীভাবে সম্ভব? সেই আগুয়েরোওওওওও মুহুর্তে শেষে লিগ জয় সিটির। ৮৯ পয়েন্ট নিয়েও গোলব্যবধানে পিছিয়ে থেকে ইউনাইটেড সেদিন ফিরেছিল খালি হাতে।