• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    জিং বেলের কথকতা : কী, কেন এবং বিতর্ক...

    জিং বেলের কথকতা : কী, কেন এবং বিতর্ক...    


    ক্রিকেট + নিয়ম + প্রযুক্তি = বিতর্ক। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছে জিং বেল বিতর্ক। বল স্টাম্পে লাগে, কিন্তু পড়ে না বেল। বিশ্বকাপে প্রথম ১৪ ম্যাচে পাঁচবার ঘটেছে এমন, প্রায় প্রতি তিন ম্যাচে এমন। জিং বেল ঘিরে উঠতে পারে, এমন সব প্রশ্নোত্তর...

    জিং বেল বা জিং উইকেট কী? 

    বিশেষ ধরনের স্টাম্প ও বেল। সহজ কথায় এলইডি (বা লাইট এমিটিং ডায়োড) যুক্ত স্টাম্প ও বেল। ব্রন্টি একারম্যান নামের একজন অস্ট্রেলিয়ান মেকানিকাল ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্টের উদ্ভাবন। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার জিং ইন্টারন্যাশনাল নামের কোম্পানি এর উৎপাদনকারী। জিং বেল ও জিং স্টাম্পের মিলিত নামই জিং উইকেট।

    কী দিয়ে তৈরি হয়? কাজই বা করে কীভাবে?

    চিরায়ত স্টাম্প ও বেল কাঠ দিয়ে তৈরি হলেও জিং উইকেট তৈরি কম্পোজিট প্লাস্টিক দিয়ে। এসব চলে লো-ভোল্টেজের ব্যাটারি দিয়ে, যা সংযুক্ত থাকে বেল ও স্টাম্পেই। বেল ও স্টাম্পের সঙ্গে থাকে মাইক্রোপ্রসেসর, যেটা নির্ধারণ করে স্টাম্পের সঙ্গে বেলের ‘সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন’ হয়েছে কিনা। এবং এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভিত্তিতে এলইডি জ্বলে ওঠার ব্যাপারটা ঘটে সেকেন্ডের প্রায় ১০০০ ভাগের ১ ভাগের মধ্যে, অর্থাৎ ১ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে। বেল বিচ্ছিন্ন হলে শুধু সেটার এলইডি নয়, সেটা থেকে রেডিও সিগন্যাল গিয়ে জ্বলে ওঠে স্টাম্পের এলইডিও। 

    একারম্যান এটা বানালেন কেন? 

    তার মতে, এটা তার রাত তিনটার দিকে পাওয়া একটা আইডিয়া (বেশ অনেকখানি রেড ওয়াইড খাওয়ার পর, “আমি আমার স্ত্রীকে সবসময়ই বলি, যতো বেশি রেড ওয়াইন, ততো বেশি স্মার্ট হই আমি)। সঙ্গে আছে তার মেয়ের এক ধরনের খেলনাও, যেটা মাটিতে পড়লেই এলইডি জ্বলে ওঠে। এমনিতে ক্রিকেট ভক্ত বলে এই আইডিয়াটা ক্রিকেটে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। 

     

     

    শুধুই বিনোদনের জন্য জিং উইকেট? 

     

    না। ক্রিকেটের নিয়মকে প্রযুক্তি দিয়ে আরও নিঁখুত করাও এর লক্ষ্য। ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী, ‘উইকেট ইজ ডাউন’ বা ‘উইকেট পড়তে’ হলে স্টাম্পের ওপরের খাঁজ থেকে বেলকে পুরো চ্যুত বা বিচ্ছিন্ন হতে হবে। এবং ‘উইকেট পড়া’ বা ‘উইকেট ইজ ডাউন’ বোল্ড ছাড়াও স্টাম্পিং, রান-আউটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখন টিভি আম্পায়াররা স্লো-মোশন রিপ্লে, ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমকে একই সঙ্গে দেখে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। যেহেতু খুব সূক্ষ্ণ সময়ে জিং উইকেট বেল ‘ডিসলজ’ বা ‘স্থানচ্যুত’ হওয়া নির্ধারণ করতে পারে, সেহেতু টিভি আম্পায়ার সূক্ষ্ণ রান-আউট বা স্টাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে এটি আরও নির্ভুলভাবে কাজে লাগাতে পারেন। 

    এবং বিনোদনের ব্যাপার তো রয়েছেই। আলো মানেই সেটা আপনার নজর কাড়বে। আর একারম্যানের ভাষায়, এটা এমন এক প্রযুক্তি, যা ক্রিকেটের অন্যান্য প্রযুক্তির চেয়ে আলাদা। অন্যগুলো যেমন পর্দার পেছনে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়, এক্ষেত্রে এটা সরাসরি কাজ করে। ‘আপনি যা দেখছেন, হচ্ছে সেটাই’, নিজের প্রেজেন্টেশনে বলেছিলেন তিনি। 



    ক্রিকেটে কবে থেকে এসেছে? 

    প্রথমে অ্যাডিলেডের ক্লাব ক্রিকেটে ব্যবহার করা হয়েছিল এটা। এরপর প্রথম ব্যবহার করা হয় ২০১২ সালের বিগব্যাশে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ব্যবহার করার জন্য এটি অনুমোদন পায় আইসিসির। এরপর ২০১৪ ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি, ২০১৫ বিশ্বকাপেও ব্যবহার করা হয়েছিল জিং উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন মোটামুটি নিয়মিতভাবেই ব্যবহার করা হয়। 
    এসব উইকেট টেকে কতক্ষণ? 

    একারম্যানের মতে, এসব উইকেট প্রতি ছয় ম্যাচ পরপর ‘ডিসফাংশনাল’ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত এসব স্টাম্প জিং ইন্টারন্যাশনাল আইসিসি বা অন্যান্য আয়োজকদের ‘ভাড়া’ দেয়। সঙ্গে চার্জারও দেওয়া হয়। 

    বিতর্ক কেন? 

    জিং বেলের স্বভাবটা ‘নাছোড়বান্দা’র মতো হয়ে যাচ্ছে বলে। এ বিশ্বকাপের প্রথম ১৪ ম্যাচে পাঁচবার এমন ঘটনা ঘটেছে, বল স্টাম্পে লেগেছে কিন্তু পড়েনি জিং বেল। ইনসাইড-এজ হয়ে বলের গতি কমে যাওয়া বা দিক পরিবর্তনের ফলেও যেমন হয়েছে, তেমনি মিচেল স্টার্কের ৯১ কিলোমিটার গতির বল স্টাম্পের বাইরের অংশে লাগলেও পড়েনি বেল। স্বাভাবিকভাবেই টুইটারে বয়ে যাচ্ছে ঝড়। এখন পর্যন্ত যারাই এর ভুক্তভোগী , অর্থাৎ বোলাররা, তাদের দল প্রতিবারই জিতেছে। তবে ম্যাচের ফল ভিন্ন হলে বা আরও ‘গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ বা আরও গুরুত্বপূর্ণ’ অবস্থায় জিং বেলের ‘এমন আচরণ’ নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়ে তুলবে বিতর্ক। 

    অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ বলছেন, সাধারণ বেলের চেয়ে এটা ভারি। ফলে ‘একটু জোরে আঘাত’ করতে হয়। 


    বেল পড়ে না, পড়ে না রে.../এএফপি


    আসলেই ভারী? আইসিসি কী বলে? 

    আইসিসির ভাষ্যমতে, সাধারণ বেলের সঙ্গে ভরভেদে এর তেমন কোনও পার্থক্য নেই। ক্রিকেটে সাধারণত দুই রকমের বেল ব্যবহার করেন আম্পায়াররা (আম্পায়ারদের পকেটে অতিরিক্ত বেল থাকে, ভেঙে গেলে যেসব ব্যবহার করেন তারা। জিং বেলও থাকে এখন)। এক ধরনের আছে যা হালকা, আরেক ধরনের আছে যা একটু ভারি, বাতাস বেশি হলে যা ব্যবহার করা হয়। ‘জিং বেল সেসব ভারী বেলের চেয়েও বরং হালকা, এসব কাজ করে সাধারণ বেলের মতোই', বলেছে আইসিসি। 

    এসব স্টাম্পও কি ভারী হয়? 

    সাধারণত কাঠের স্টাম্পের ভর বেশি হওয়ার কথা প্লাস্টিকের চেয়ে। তবে এসব স্টাম্পের ভেতরে আরও উপাদান থাকে বলে ওজন বাড়িয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এখন স্টাম্প ক্যাম, স্টাম্প মাইক্রোফোন আসার কারণে কাঠের স্টাম্পও বিশেষ ভাবে তৈরি হতো জিং উইকেটের আগে, যেসবেরও ওজন থাকতো সাধারণ স্টাম্পের চেয়ে বেশিই। 

    বেল না পড়ার ঘটনা কি এবারই প্রথম? 

    গত বিশ্বকাপেও অন্তত দুবার ঘটেছিল এমন। একবার বেঁচেছিলেন মিসবাহ-উল-হক, তার লেগস্টাম্প ছুঁয়ে গিয়েছিল বল, আলো জ্বললেও পড়েনি বেল। আর এড জয়েস বেঁচেছিলেন আরও অদ্ভুতভাবে। বল স্টাম্পে লেগে বেলকে ওপরেও তুলেছিল, তবে সেটা আবার গিয়ে পড়েছিল স্টাম্পের খাঁজে। 

    জিং বেলের আগে এমন ঘটেনি? 

    ঘটেছে অবশ্যই। নিউজিল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজেই অন্তত দুবার ঘটেছিল এমন। ঘটেছে আরও সিরিজেও। শ্রীলঙ্কার পারভেজ মাহরুফ একবার এভাবে শুধু বেঁচেছিলেন তাই নয়, জাহির খানের বলটা স্টাম্পে লেগে দিক পরিবর্তন করে ফাঁকি দিয়েছিল এমএস ধোনিকে, হয়েছিল বাই চার। 

    যদি স্টাম্পেও আলো জ্বলে, তবে আদতে দরকার আছে বেলের……?

    এখন পর্যন্ত আছে। কারণ জিং উইকেটের সিস্টেমে বেল ‘ডিসলজ’ হলেই শুধু জ্বলবে স্টাম্পের এলইডি। সেক্ষেত্রে বেলকে হিসাবের থেকে বাদ দিতে হলে এ সিস্টেম বদলাতে হবে। আর স্টাম্পের বেল ক্রিকেটের চিরায়ত নিয়মের অংশ, এখন যেমন উইকেট ভাঙার ‘প্রয়োজনীয়তা’ আছে, বেল না থাকলে সেটা হয়ে পড়বে শুধুই ‘ছোঁয়াছুঁয়ির’ খেলা। 

    তাহলে এখন? 

    আইসিসি অনুমোদন দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করেই দিয়েছে। সেক্ষেত্রে এসব ঘটনা কাকতালীয় বলে পার হয়ে যাওয়া যায়। তবে নিয়মিত ঘটছে বলে সেটা বলার উপায় থাকছে না সম্ভবত। আর প্রযুক্তির সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্কটা মোটামুটি সবসময়ই এরকম। এক সমস্যা মেটাতে গেলে হাজির হয় আরেকটি। ডিআরএস, ডিআরএস করে যেমন আম্পায়াররা এখন বোলারদের পায়ের দিকে নজর দিতে ভুলে যাচ্ছেন, বা এড়িয়ে যাচ্ছেন। সবিকিছুর পর তাই ওই কথাটাই প্রযোজ্য, ‘ইটস আ ফানি ওল্ড গেম’! সেখানে জিং বেল বিবর্তনেরই আরেকটি ধাপ।