• " />

     

    ফুটবলের সবচেয়ে বড় "ধোঁকাবাজ"!

    ফুটবলের সবচেয়ে বড় "ধোঁকাবাজ"!    

    ১৯৯৬ সালের ঘটনা। সাউদাম্পটনের কোচ তখন গ্রায়েম সাউনেস। হঠাৎ একদিন তাঁকে ফোন করলেন আগের বছরের ফিফার বর্ষসেরা স্ট্রাইকার জর্জ ইউয়াহ। ‘৯৫ এর ব্যালন ডি’অর জয়ী এই তারকা সাউনেসকে বললেন তাঁর চাচাত ভাই আলি ডিয়াকে দলে নেয়ার জন্য। ফিফা’র বর্ষসেরা ফুটবলারের কথা কি আর ফেলে দেয়া যায়? জর্জ উইয়াহর ভাই এক মাসের চুক্তিতে ডাক পেল সাউনেসের দলে! প্রেস কনফারেন্সে কোচ আলি ডিয়া সম্পর্কে বললেন, “পিএসজি তে সে জর্জ উইয়াহর সাথে খেলেছে। গত বছর খেলেছে জার্মানির দ্বিতীয় বিভাগে।...তাই আমরা তাঁকে দেখতে চাচ্ছি।”

     

    দিন কয়েক বাদেই লিডসের বিপক্ষে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক ঘটে ডিয়ার। খেলার ৩৩ মিনিটের মাথায় সাউদাম্পটনের কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যাট লি টিসিয়ারের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন তিনি। খেলা শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক থাকতেই সাউনেস তাঁকে মাঠ থেকে উঠিয়ে নেয়ার আগে সেইন্ট সমর্থকরা কেবল ডিয়াকে মাঠের এপার থেকে ওপার ছুটতেই দেখেছে।  আলি ডিয়ার ৫৩ মিনিটের সেই খেলাকে লি টিসিয়ার তুলনা করেছিলেন একটা ছটফট করা  হরিন শ্বাবকের সাথে! ঠিক যেন ‘বাম্বি অন আইস’!

     

     

    অমন খেলার দেখার পর ডিয়ার এক মাসের চুক্তি বাতিল হয়েছিল ১৪ দিনের মাথায়। তাঁর আসল পরিচয়টাও জানা গেল কিছুদিনের মধ্যে। তাছাড়া জর্জ উইয়াহর সাথে তাঁর দূর থেকে দূরেরও কোন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় নি! এমনকি ডিয়া পিএসজি’র হয়েও খেলেন নি কখনো! আর সাউনেসকে ফোনটা করেছিল ডিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক বন্ধু। সাউদাম্পটন কোচকে সেদিন বোকা বানিয়ে ডিয়া তাঁর নাম লিখিয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে! বেশকিছু লেখালেখিও হয়েছিল তাঁকে নিয়ে। তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ফুটবলের এই ‘কনম্যান’!

     

    ফুটবলার জর্জ উইয়াহর পরিচয় দিয়ে আলি ডিয়া শুধু সাউদাম্পটনেই খেলেছেন তা নয়। এর আগেও উইয়াহর নাম বেঁচে ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, জার্মানির বিভিন্ন ডিভিশনেও খেলেছেন! আলি ডিয়ার উইকিপিডিয়ার প্রোফাইল অনুযায়ী ১৯৮৮-৯২ সালের মধ্যে ফ্রান্সের চারটি ক্লাবে খেলেছিলেন। যদিও সেই চার ক্লাব এমনকি ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশনও ফ্রান্সের পেশাদার লিগে আলি ডিয়া নামের কোন বিদেশি খেলোয়াড় ছিলনা বলেই জানিয়েছে।

     

    ১৯৯৫ সালে ডিয়া ফিনল্যান্ডের ক্লাব ফিন্নাইরিন পাল্লোইলিজাত (সংক্ষেপে ‘ফিন্নাপা’) তে যোগ দেয়। ফিন্নাপা সেবারই প্রথম ফিনিশ ফুটবলের টপ লেভেলে খেলার সুযোগ পায়। তাই নতুন করে সাজানো ফিন্নাপা’র সেই দলে ডিয়ার সাথে ছিল লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী সামি হাইপিয়ার মত ফুটবলারও। আলি ডিয়া ফিন্নাপা’র দলেও ঢুকেছিল সেই জর্জ উইয়াহর নাম বেঁচেই! আর সেই সময় এতসব তথ্য যাচাই করা সহজ ছিলো না বিধায় সবাই সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য ছিল। ফিনিশ ক্লাবটির হয়ে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছিল ডিয়া। তবে মাঠে ছুটাছুটি, অসংখ্যবার অফসাইড আর গোল মিস করা ছাড়া তেমন কিছুই দেখাতে পারে নি  জর্জ উইয়াহর তথাকথিত ‘ভাই’!

     

    অতঃপর হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যায় আলি ডিয়া। ফিন্নাপা’র এক কর্মচারীকে ডিয়ার ফ্ল্যাটে পাঠানো হলে সে তাঁর ঘরে কতগুলো হাড্ডি ছাড়া কিছুই খুঁজে পায় নি। তবে এখানেই আলি ডিয়ার ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অ্যাডভেঞ্চার’ শেষ হয় নি। ডিয়া এইবার যোগ দিলেন পিকে-৩৫ নামের ক্লাবে। সেখানেও বলে বেড়ালেন যে তিনি জর্জ উইয়াহর ভাই। এই ক্লাবে এসে একটা গোল করতে পারলেও ডিয়া কেমন খেলে তা সবারই বোঝা হয়ে গিয়েছিল। তাই এই সেনেগালিজ ফিনল্যান্ড ছেড়ে পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেকেন্ড বুন্দেসলিগার ভিএফবি লুইবেক নামের ক্লাবে উইয়াহর ভাই পরিচয় দিয়ে সুযোগ পায় ডিয়া। অবশ্য আলি ডিয়া পাঁচ গোল করেছিল একটি ট্রায়াল ম্যাচে! তবে লিগে ২ ম্যাচ খেলেই ডিয়া বুঝে গিয়েছিল জার্মানিতেও তাঁর থাকা হচ্ছে না।

     

    তারপরই নতুন করে কল্পিত ‘সিভি’ বানিয়ে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। আর সেখানে বোকা বানালেন সাউদাম্পটনের কোচ সাউনেসকে! সাউদাম্পটন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ডিয়া কিছুদিন ইংলিশ ক্লাব গেটসহেডেও খেলেছেন। সেইসময় সংবাদ সংস্থা ‘মিরর’ আলি ডিয়ার এই দীর্ঘ ধোঁকাবাজির কাহিনি ফাঁস করে। তবে ডিয়া তাঁদের এই রিপোর্টকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে জানায় তিনি ক’দিন আগেই সেনেগালের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে গিনির বিপক্ষে গোল করেছেন। কিন্তু, সেনেগাল কখনই গিনির সাথে খেলেনি আর ‘৯৮ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে সেনেগাল প্রথম পর্বেই টোগোর বিপক্ষে হেরে বাদ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আলি ডিয়ার ধোঁকাবাজি সেখানেই সব ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।

     

    এরপর ডিয়া নিজেকে প্রমাণ করার কথা জনালেও তাঁর পক্ষে সেটা কখনোই সম্ভব হয়ে উঠে নি। অতঃপর ধীরে ধীরে অতীতের মত গায়েব হয়ে যান । তবে এবার আর খুঁজে পাওয়া যায় নি ফুটবলের এই ‘কনম্যান’ কে। তবে ইন্টারনেট ঘাঁটলে এখনো খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর নামের টুইটার, ফেসবুক প্রোফাইল। হয়ত কোথাও তরুণ কোন ফুটবলপ্রেমীকে তাঁর গল্প শুনিয়ে বলছে, “তুমিও চাইলে প্রিমিয়ার লিগে ফুটবল খেলতে পারবে। ঠিক আমার মত…!”