• অন্যান্য খবর
  • " />

     

    মেগান রাপিনো: এত সহজে হাল ছাড়ছি না

    মেগান রাপিনো: এত সহজে হাল ছাড়ছি না    

    জন্ম থেকেই বোধহয় এমনই ছিলাম আমি। 

    ছোট থাকতে আমার এবং আমার যমজ বোন র‍্যাচেলকে নিজের দেওয়া ডাকনামে ডাকতেন আমাদের দাদা। গলা একই রকম ছিল আমাদের, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমরা একেবারেই দুই মেরুর মানুষ। র‍্যাচেল ছিল মিশুক প্রকৃতির; আমি ছিলাম টমবয়, কিছুটা ছেলেদের মত। র‍্যাচেল খুবই মিষ্টি মেয়ে। আমি ওর চেয়ে কিছুটা হলেও অস্থির গোছের ছিলাম। র‍্যাচেলের জন্য আমার দাদার ডাকনাম ছিল ‘মাফিন’। মাফিন কেকের মত মিষ্টি বলেই হয়তো দাদা ঐ নামে ডাকতেন তাকে। আমার নাম ছিল ‘মা বার্কার’। দাদার এমন নাম আমার মধ্যে বেশ কৌতূহলের জন্ম দেয়। এখনও মনে আছে; ছোট থাকতে একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

    ‘দাদা, মা বার্কার কী?’

    তিনি বলেছিলাম, ‘মা বার্কার একজন মানুষের নাম’

    ‘ও আচ্ছা। উনি কে? বা কী করতেন?’

    আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো একজন মহিলা নভোচারী বা একজন চৌকস উকিল। কিন্তু আমাকে অবাক করে দাদা বললেন, ‘মা বার্কার ১৯২০-এর দিকের একজন কুখ্যাত মহিলা গুণ্ডা’

    মাফিন এবং মা বার্কার। আমাদের জন্য দাদার ডাকনাম দিয়েই হয়তো বুঝে ফেলেছেন আমরা দুই বোন মানুষ হিসেবে কতটা আলাদা। আগেই বলেছি, আমি খুবই অস্থির প্রকৃতির। ছোট থাকতে আমরা সারাদিন রাস্তায় হকি, বাস্কেটবল খেলে দুপুরের খাবারের জন্য বিরতি নিয়ে ফিরে এসে ফুটবলও খেলতাম। আমাদের দিন শেষ হত আবারও রাস্তায় হকি খেলেই। আমরা যেনতেন ভাবে খেলতাম না, পেশাদারি খেলোয়াড়দের মত পুরো জার্সি, গার্ড, হেলমেট- সব পড়েই নামতাম। পাঁচ থেকে বার বছর বয়স পর্যন্ত আমি আমার জীবনের সেরা সময়টাই পার করেছি। মাইকেল জর্ডানের ‘জর্ডান ১১’ বুট, কাউবয়দের জার্সি- সবই ছিল আমার। বন্ধুদের নিয়ে খেলাধূলা, চিৎকার-চেঁচামেঁচি করে পাড়া-পড়শিদের ঘুম হারাম করে ছাড়তাম আমরা।

    এরপর হঠাৎ করেই একদিন চিন্তায় পড়ে গেলাম। স্কার্ট? ছেলেবন্ধু? নাচানাচি? সব কিছুই কেমন যেন অন্যরকম মনে হতে লাগল। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণী আমার জন্য ভয়াবহ ছিল। অন্যান্য বাচ্চারা বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা পার করছিল, এ সময় ছেলে-মেয়েদের যেসব স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা হয়ে থাকে অন্য লিঙ্গের ব্যাপারে, তাদের সেরকমই হচ্ছিল। কিন্তু আমি ছিলাম আলাদা। নিজের সত্তা, ভাল লাগা- সব কিছু নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন রাস্তায় হকি খেলা সবাই পরদিনই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল; আমি বাদে। আমি তখনও সেই টমবয়ই ছিলাম। আমি কে, বা এই বয়সে আমার কি করা উচিত, কীভাবে চলাফেরা করা উচিত- নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হচ্ছিল আমার। মিডল স্কুলের সময়টা পার করার সময় আমাকে সবচেয়ে সাহায্য করেছিল খেলাধূলা এবং র‍্যাচেল, আমার বোন।

     

     

    র‍্যাচেলের সাথেই থাকতাম আমি সারাদিন। সপ্তম শ্রেণীর পুরোটা সময়ই ওর সাথে পার করেছি। ও যেখানেই থাকত, তার ঠিক দুই ফুট দূরেই যেন থাকতাম আমি- এমনই ছিল আমাদের সপ্তম শ্রেণীর সময়টা। আমি জানি না কীভাবে সে সবখানেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত। মিশুক প্রকৃতির হওয়ায় ঐ সময়টায় কোথাও আটকাতে হয়নি ওকে, আর ওর সাথেই পার পেয়ে গিয়েছিলাম আমিও। বিবিসি আর্থ বা জিওগ্রাফি চ্যানেলের ‘প্ল্যানেট আর্থ’ শো-গুলো দেখেছেন? ছোট থাকতে দেখতাম যে সাগরের উপরিভাগে ছোট ছোট মাছগুলো কীভাবে শুশুক বা তিমি মাছদের ওপর ভেসে থাকত। তিমি বা শুশুক যেদিকে যেত, ছোট মাছগুলোও সেদিকেই যেত। আমার জীবনে ঐ সময়টায় র‍্যাচেল ছিল তিমি বা শুশুক, আর আমি ছিলাম ঐ ছোট মাছগুলোর কোনও একটা। ও যা করত, তাই করতাম আমি। বলতে গেলে যেন ওর ছায়াই ছিলাম আমি। র‍্যাচেল না থাকতে বয়ঃসন্ধির সময়টা কীভাবে পার করতাম, আমি নিজেও জানি না। 

    আগেই বলেছি যে র‍্যাচেলের মত ঐ সময়টায় খেলাধূলা আমাকে দারুণ সাহায্য করেছে। ছোট থেকেই প্রায় সব ধরনের খেলার সাথে সখ্য থাকায় হকি, বাস্কেটবল- সবই ভালো খেলতাম আমি। তবে আমার জীবনের মোড় ঘোরানো সময়টা ছিল ১৯৯৯ সালের মেয়েদের বিশ্বকাপ। বাস্কেটবল, হকি খেললেও ফুটবল আমাকে ভীষণ টানত। আমাদের স্থানীয় ক্লাবেও ফুটবল খেলতাম তখন, কিন্তু ফুটবলে পেশাদার ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা আসেনি কখনও।  

    কিন্তু আমার সেসব চিন্তাভাবনা পাল্টে যায় ‘৯৯-এর সেই বিশ্বকাপের পর। এখনকার ১৪-১৫ বছর বয়সী মেয়েরা হয়তো কখনোই বুঝতে পারবে না ঐ বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্রে আমার মত তরুণীদের জন্য কতটা অর্থবহ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ‘৯৯-এর বিশ্বকাপে উপচেপড়া ভীড় হয়েছিল, সবাই মুখে নিজেদের দেশের পতাকা এঁকে, ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মাঠে সমর্থন জানাচ্ছিল। টেলিভিশনেও সব ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। মেয়েদের বিশ্বকাপে এমন উন্মাদনা কেউ চিন্তাও করেনি আগে। আমি এবং র‍্যাচেল স্ট্যানফোর্ড স্টেডিয়ামে যুক্তরাষ্ট এবং ব্রাজিলের সেমিফাইনাল ম্যাচটি দেখতে গিয়েছিলাম। ঐ ম্যাচটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মেয়েদের ম্যাচ দেখার জন্য মাঠে ৭০,০০০ দর্শকের সরব উপস্থিতি- কয়েক মাস আগেও যা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি কেউ।

     

     

    আমার মনে হয় না ঐ ম্যাচটা শুধু আমার জীবনেরই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমার মত খেলা দেখতে আসা অনেক মেয়েই হয়তো সেদিন বাড়ি ফিরে বল পায়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘আমিও ক্রিস্টিন লিলি, জয় ফসেটদের মত ফুটবলার হব। এটাই আমার স্বপ্ন।’ ঐ ম্যাচের পরই জীবনে গতানুগতিক ডাক্তার, শিক্ষক ছাড়াও অন্যকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল আমাদের। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বাবা-মা নিজেরাও হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন, একদিন দেশের জার্সিতে মাঠে থাকবে তাদের মেয়েরাও।

    ব্রাজিল ম্যাচের পর বাড়ি ফিরে আমার দেখা স্বপ্ন সত্যি হয় সাত বছর পর। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মত জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পাই আমি। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। আমার এখনও মনে আছে, লকার রুমে প্রথমবার ক্রিস্টিন লিলিকে দেখে আমি রীতিমত উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। ‘৯৯-এর চীনের বিপক্ষে ফাইনালে টাইব্রেকারে জয়ের আগে নির্ধারিত সময়ে তিনি লাইন থেকে নিশ্চিত গোল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে প্রথমবার সামনাসামনি দেখেছিলাম ক্যাম্পেই, আমার বয়স ছিল ২১ বছর। কিন্তু নিজের আইডলকে প্রথমবার চোখের সামনে দেখে কারোই স্বাভাবিক থাকার কথা না। আমি তো ১২ বছরের কিশোরীর মত উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। ক্রিস্টিন একে একে সবার সাথেই পরিচিত হচ্ছিলেন, আর আমি এক কোণায় বসে ভাবছিলাম, ‘ক্রিস্টিনকে কী বলব আমি? আমি কে? হে ঈশ্বর, কী হচ্ছে এসব?’

    উত্তেজনায় মনে হচ্ছিল এখনই জ্ঞান হারাব আমি। আমার কাছে এসেই মিষ্টি হাসি হেসে ক্রিস্টিন আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন প্রথমবার ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার জন্য। তিনি সামনে আসতেই আমি রীতিমত তোতলানো শুরু করেছিলাম, ‘আ-আমরা আ-আসলে এখানে নতুন। ক-কী হচ্ছে, আ-আসলে কিছুই জ-জানি না। আপনি ক্রিস্টিন লিলি, আমার আইডল। আপনার অসংখ্য প-পোস্টার ছিল আমার বাড়িতে।’ ক্রিস্টিন খুবই স্বাভাবিকভাবে, মিষ্টি হেসেই আমার তোতলানো শুনছিলেন। সবার সাথেই খুবই আন্তরিক ছিলেন তিনি। ক্রিস্টিন চাইলেই আমাদের তুচ্ছজ্ঞান করে, কিংবদন্তী হওয়ায় দেমাগ দেখাতে পারতেন। কিন্তু এমন কিছুই তিনি করেননি।

    একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হয়েছে। আমার আইডল বাস্তব জীবনে অহংকারী হলে নিজেরই খুব খারাপ লাগত। কিন্তু তিনি একেবারেই অমায়িক ছিলেন, এবং সেজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। একজন কিংবদন্তীর এমন চমৎকার ব্যবহার আমাকে পেশাদারিত্বের ব্যাপারে অনেক কিছু শিখিয়েছে। পুরুষ ফুটবলারদের মত এত সুযোগ-সুবিধা আমাদের নেই। এটাই অপ্রিয় বাস্তবতা। খেলার পাশাপাশি অনেকভাবেই তারা আরও উপার্জন করে থাকেন। আমাদের সে অবকাশ নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনে সুযোগ খুঁজতে হয় আমাদেরই, অন্য কেউ সেটা করে দেয়না আমাদের জন্য। তাদের মত প্লেনে প্রতিনিয়ত ফার্স্ট ক্লাসে যাতায়াত করার বিলাসীতা নেই আমাদের, ব্যক্তিগত শেফও নেই।

     

     

    পুরুষ ফুটবলারদের মত বাড়িতে জিম বানানোও সম্ভব নয় আমাদের। আর দশজনের মত পাবলিক জিমেই যাই আমরা। তবে এসব কিছু কখনোই বিচলিত করে না আমাদের। সত্যি বলতে, আমার কাছে মনে হয় আমাদের, মেয়ে ফুটবলারদের, জীবনটাই সবচেয়ে সুখের। আমাদের চাকরিটাই সবচেয়ে মজার। ভোর ছয়টায় প্লেন থেকে নেমে হোটেলে চেকইন করা, সেখানেই জিম করা। সব মিলিয়ে সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছি আমরা। কিন্তু এটাই আমাদের জীবন, এবং আমরা কৃতজ্ঞ সেজন্য। মেয়েদের ফুটবল নিয়ে অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা যে চার বছর পর পর আমরা হাজির হই বিশ্বকাপ খেলতে। ব্যাপারটা কোনওভাবেই এমন না, আমরাও ছেলেদের মত অনুশীলন করি, আমরাও সারা বছর ক্লাব ফুটবল খেলি। পুরো সময়টাই দারুণ সংগ্রাম করতে হয় আমাদের। কিন্তু এটাই আমাদের পেশা, এটাই আমাদের নেশা। আবারও বলছি; আমাদের কাছে আমাদের এই চাকরিটাই, এই জীবনটাই সবার চেয়ে সেরা।

    অনেকে হয়তো ভাবতে পারে যে এত সীমাবদ্ধতা, সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে এত পিছিয়ে থাকার পরও কেন আমরা ফুটবল নিয়েই পড়ে আছি। শুধু আমার জন্য নয়, যেকোনও মেয়ে ফুটবলারের জন্যই উত্তর একটাই; আমাদের সমর্থকেরা। পৃথিবীর সব প্রান্তে আমাদের সমর্থকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। আমাদের স্টাফ, পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে এই লেখাটি পড়া মানুষেরাও আমাদের মূল অনুপ্রেরণা, আমাদের শক্তি, বিশেষ করে তরুণ সমর্থকেরা। ২০১১ বিশ্বকাপের জন্য রওনা হওয়ার আগে নিউজার্সির রেড বুল অ্যারেনাতে আমাদের বিদায়ী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২৫ হাজার দর্শকের জায়গায় সেদিন দর্শক হয়েছিল মাত্র ৭ হাজার। টুর্নামেন্টের আগেই কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম আমরা।

    মনে হয়েছিল, নিজেদের যতটা বড় আমরা ভাবি; আমরা হয়তো তত বড় না। হয়তো এখনও আমাদের সিরিয়াসভাবে নেওয়ার মত সামর্থ্য বা অর্জন হয়নি আমাদের। কিন্তু ২০১১ বিশ্বকাপ আমার সব ধারণা পাল্টে দেয়। বিশ্বকাপ ফাইনাল। টাইব্রেকারে জাপানের কাছে হার। তীরে এসে তরী ডুবানো। এত কাছে এসেও খালি হাতে বিদায় নেওয়ার হতাশা, কান্না। আমাদের বারবার মনে হচ্ছিল যে সমর্থকদের প্রত্যাশামত খেলতে পারিনি আমরা। কিন্তু দেশে ফিরতেই সবাই বীরের বেশে আমাদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিল। আমরা কিন্তু জিতিনি, রানার্স আপ হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের জন্য সেটিই ছিল ‘৯৯ বিশ্বকাপের সমান।

     

     

    বিশ্বকাপে এমন খুব কমই স্মৃতি আছে আমার যেগুলো মাঠের বাইরেও মনে থাকবে চিরদিন। আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি ছিল পরিবারের সাথে বিশ্বকাপের আমেজটা ভাগাভাগি করে নেওয়া। ২০১১ বিশ্বকাপে আমার মা-ও আমার সাথে এসেছিলেন। আমার মায়ের এক বিচিত্র অভ্যাস আছে। প্রতি রাতে ঘুমুনোর আগে তার ভিন্ন পায়জামা চাই। একদম নতুন করে ধোয়া থাকতে হবে, কোনওভাবেই এর ব্যতিক্রম চলবে না। কোথাও ঘুরতে বেরুলে তার স্যুটকেসের অর্ধেকই বোঝাই থাকে পায়জামা দিয়ে। আদর করে আমরা তাকে ‘ম্যামার জ্যামার’ ডাকি।

    মায়ের এই বিচিত্র অভ্যাস নাকি মেনোপজের সময় থেকেই। হরমোনজিত কারণেই নাকি মা কোনও কিছুর স্পর্শ, গন্ধে বেশ সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিলেন। আমরা এটা জানতামই না। ২০১১ বিশ্বকাপের জন্য জার্মানিতে যাওয়ার আগে আট দিন থাকার জন্য তিনি গুণে গুণে আট জোড়া পায়জামা নিয়েছিলেন! একবার ভাবুন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের কী অবস্থাটাই না হয়েছিল মায়ের স্যুটকেস দেখার পর। আট দিনের কথা বলেছিল এজন্য যে অনেকেই ভাবেনি আমরা গ্রুপপর্ব পেরুতে পারব। কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত ফাইনাল খেলেছিলাম। যেটা আমাদের জন্য অবিশ্বাসই ছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, মায়ের পায়জামা সমস্যা যেন আরও ঘনীভূত হয়। আমার এখনও মনে আছে, নকআউট পর্বের আগে আমরা একদিন হোটেলে বসেছিলাম। মা হোটেল লবিতে বসে তার ল্যাপটপে জার্মানির পায়জামা বিক্রি করা দোকানের খোঁজ করছিলেন। মায়ের এই ব্যস্ততা দেখে আমি বললাম, 

    ‘আমরা মাত্র আর কয়টা দিনই থাকব এখানে, যে পায়জামাগুলো এনেছো ওগুলো পড়লেই হয়’

    মা অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, যেন তার আনা পায়জামাগুলো আবার পড়া অসম্ভব কিছু। 

    ‘মেগান, আমার প্রতিদিন নতুন পায়জামা লাগে। আগের গুলো পড়া অসম্ভব।’

    পায়জামার ক্ষেত্রে মা একটু বেশিই শুচিবায়ু। 

     

     

    চার বছর পর ২০১৫-তে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আমার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলাম। কানাডায় যাওয়ার আগে অবশ্য মা ২০১১-এর ভুল করেননি। এবার একেবারেই গ্রুপপর্ব থেকে শুরু করে ফাইনাল পর্যন্ত প্রতিদিনের জন্য নতুন পায়জামা, জুতা, বেডশিট- সবই এক সেট করে নিয়েছিলেন। বেডরুম বিলাসিতার ওপর কোনও পুরষ্কার দেওয়া হলে সেটা আমার মা-ই জিততেন।  সত্যি বলতে, আমার সব বিশ্বকাপে প্রতিদিন মা-কে পাশে পাওয়াটা মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে আমাকে। শুধু আমি নই, আমাদের দলের মোটামুটি সবাই-ই পরিবারের সাথেই ছিল। সমর্থকদের মত আমাদের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি তারাই। এসব আবেগ, অনুভূতির জন্যই আমরা কখনোই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগি না। কারণ জয়ের জন্য সবসময় আমাদের প্রতিপক্ষকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে থাকি।

    আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময়টা ছিল ২০১৬ অলিম্পিকের আগে। পায়ের গুরুতর ইনজুরিতে পড়েছিলাম। হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় মনে হয়েছিল হয়তো ক্যারিয়ারটাই শেষ আমার। অলিম্পিকে খেলা হচ্ছে না- ডাক্তাররা মানসিকভাবে মেনে নিতে বলেছিলেন আমাকে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ছিল আমার। ইনজুরি থেকে ফিরে ২০১৬ অলিম্পিকের স্কোয়াডেও জায়গা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টেই নিজের ছায়া হয়ে ছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও টুর্নামেন্টটা ভাল যায়নি।

    মাঠের মত মাঠের বাইরেও সময়টা তেমন ভাল যাচ্ছিল না আমার। গত সেপ্টেম্বরে এক প্রীতি ম্যাচের সময় জাতীয় সঙ্গীতের আগে মাঠে হাঁটু গেড়ে বসেছিলাম আমেরিকান কোয়ার্টারব্যাক কলিন কাপেরনিকের সমর্থনে। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর পুলিশের নির্মমতা এবং আমেরিকায় বর্ণবাদের প্রতিবাদে আমার বা কলিনের প্রতিবাদ আমাদের কারো ফেডারেশনই মেনে নেয়নি। আমাদের কোনও ধরনের সমর্থনও জানানো হয়নি। ইনজুরি সমস্যা না থাকার পরও আমাকে স্কোয়াডের বাইরে রাখা হচ্ছিল। অবশ্য আমাকে প্রতিবাদের জন্য নয়, ফেডারেশন থেকে বারবার বলা হচ্ছিল; ফর্মহীনতার কারণেই আমাকে দলে রাখা হচ্ছে না। যেটা সত্যি, কারণ মাত্রই ইনজুরি থেকে ফিরেছিলাম; ফর্মেও ছিলাম না একেবারেই।

     

     

    আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের লিগ ফুটবলের মৌসুমও শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন। জাতীয় দলে খেলেই ফর্মে ফেরা আমার একমাত্র উপায় ছিল। কিন্তু টানা পাঁচ মাস আমাকে দলে নেওয়া হয়নি। ফর্মে ফিরতে আমাকে খেলতে হত, কিন্তু লিগ ফুটবল না থাকায় এবং আমাকে জাতীয় দলে না নেওয়ায় আমার খেলারও সুযোগ ছিল না। দু’বছর আগের বিশ্বচ্যাম্পিন পেশাদারি ফুটবলে খেলতে পারছে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বললেও হয়তো কম বলা হবে না। যেমনটা বলেছিলাম, আমার বারবার মনে হচ্ছিল ক্যারিয়ারই হয়তো শেষ আমার। কিন্তু শেষটা এরকম হবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল আমার। আগে মনে হত এরকম হঠাৎ করেই বিদায় হবে আমার। কিন্তু আসলেই যখন এমনটা হতে যাচ্ছে, তখন আবারও নিজের ইচ্ছাশক্তি বাধ সাধল আমার। এভাবে বিদায় নেব আমি, আর যাই হোক। আমি মেগান রাপিনো, এত সহজে হার মানার পাত্র নই আমি। 

    ফেরার অনুপ্রেরণা আর ইচ্ছাশক্তিই আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অনেক কথা বলেছে। আমি বুড়িয়ে গিয়েছি, ফর্ম নেই আমার, জাতীয় দলে আমার জায়গা নেই। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় এসবে কান দেওয়ার সময় ছিল না আমার। কিন্তু বাস্তব জীবনে সবাই দারুণ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে আমাকে। জিমে, রাস্তায়, লাইব্রেরি- যেকোনও জায়গায় যার সাথেই দেখা হয়েছে, সবাই-ই আশা জাগানিয়া কথাই বলেছিলেন। ‘আমরা তোমার সাথে আছি’, ‘জাতীয় দলে তোমার অবদান ভোলা যাবে না’, ‘তোমার হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদের সাথে সহমত আমরা’, ‘তুমি আবারও ফিরতে পারবে জাতীয় দলে’- মাঝেমধ্যে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তাম এসব কথা শুনে। 

    আমি জানি আমি যেভাবে ফিরেছি এসব নিয়ে হয়তো তেমন প্রচার হবে না, এটা নিয়ে দুঃখও নেই আমার। কিন্তু কলিনকে সমর্থন জানানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ যেভাবে সমর্থন জানিয়েছে আমাকে, এখনও এ বিষয়ে কথা হয় চারদিকে। এই মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। নিন্দুকেরাও অনেক কথা বলেছেন। ভাল, খারাপ- সবই আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অনুশীলন করতে, ফর্মে ফিরতে এবং নিজের সামর্থ্যেই স্কোয়াডে ফিরতে। এবং আমি ঠিকই ফিরেছিলাম। এজন্যই আমি বলি, ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনও কিছুই অসম্ভব না। বুড়িয়ে গেলেও আমি কখনোই হুট করেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মত কেউ নই। পুরো ক্যারিয়ার আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেবার স্কোয়াডে ফিরেই আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ, আবারও স্বরূপে ফেরার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। গত বছর স্কোয়াডে ফেরার পর মনে হয়েছিল, আবারও নিজের সেরা ফর্মে ফিরতে পারব। আবারও নিজের সেরাটা দিতে পারব।

     

     

    স্কোয়াডে ফিরে প্রথম অনুশীলনের দিন যেন জীবনকে নতুন করে উপভোগ করছিলাম। যুদ্ধ জয়ের হাসি ছিল আমার মুখে। আর এই হাসি ছিল সেসব নিন্দুকদের সমালোচনার কড়া জবাব, যারা ভেবেছিল আমি কখনোই ফিরতে পারব না। যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়ার মত আর কিছুই নেই আমার।

    আমি জানি ২০১৯ বিশ্বকাপই হয়তো আমার শেষ টুর্নামেন্ট। আমি এখনও বিশ্বাস করি; আমার চাকরি, আমার জীবনটাই পৃথিবীর সেরা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্ট্যানফোর্ড স্টেডিয়ামে ব্রাজিলের বিপক্ষে সেমিফাইনালে দর্শক সারিতে র‍্যাচেলের সাথে বসে এই স্বপ্নটাই দেখেছিলাম আমি। সেদিন আমি আমার স্বপ্নের পেশাটাই বেছে নিয়েছিলাম, গত ১৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলের হয়ে জীবনের সেরা সময়টাই কাটিয়েছি।

    শেষবেলায় এসে আমি আরও একটি বিশ্বকাপ চাই। ধরে রাখতে চাই ২০১৫-এর শ্রেষ্ঠত্ব। আরও একটি বিশ্বকাপ, আরও একটি ট্রফি প্যারেড। বন্ধু, সতীর্থ, কোচিং স্টাফ, দেশবাসী, সমর্থক, পরিবার-পরিজনদের সাথে আরও একটি দুর্দান্ত উদযাপন; যারা আমাদের এই পরিশ্রম, এই সাফল্যকে আরও কয়েকগুণ অর্থবহ করে তোলেন। শেষ বিশ্বকাপের জন্য রওনা হওয়ার আগে তাই মায়ের মত বলতে চাই, পায়জামা প্যাক করা হয়ে গেছে। 

     

    [২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে দ্য প্লেয়ারস ট্রিবিউনে যুক্তরাষ্ট্র মহিলা দলের অধিনায়ক মেগান রাপিনোর আর্টিকেল 'ইউ ক্যান্ট গেট রিড অফ ইউর গার্ল দ্যাট ইজিলি' থেকে অনুবাদিত]

    [মূল আর্টিকেল লিঙ্ক: https://www.theplayerstribune.com/en-us/articles/megan-rapinoe-united-states-world-cup-youre-not-gonna-get-rid-of-your-girl-that-easily]