• ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯
  • " />

     

    প্রিয় নিউজিল্যান্ড, তোমাদের জন্য ভালোবাসা

    প্রিয় নিউজিল্যান্ড, তোমাদের জন্য ভালোবাসা    

    প্রিয় নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল,

    ইতিহাস নাকি সব সময় বিজয়ীদের মনে রাখে। কথাটা হয়তো এক অর্থে ঠিক। কাগজে কলমে আর রেকর্ডবুকে লেখা থাকবে, ট্রফিটা ইংল্যান্ডই জিতেছে। ক্রিকেট নামের বুড়ো খেলাটা যখন আরও এক শতাব্দী পর আরেকটু বুড়ো হবে, হয়তো ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই তারিখটা মনে রাখার মতো আর কেউ থাকবে না। তখন পরিসংখ্যান বলবে, বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসরে তোমরা রানার্স আপ হয়েই বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু আজকের কোনো শিশুর স্মৃতিতে কালকের ম্যাচটা কোনোভাবে শত বছর পর যদি বেঁচে থাকে, সে জানবে তোমরা হারোনি সেদিন। ট্রফি না পেলেও যে ভালোবাসা তোমরা পেয়েছ, সেটা কোনো পার্থিব পুরস্কার দিয়ে মাপা যায় না।


    আরও পড়ুন

     অলৌকিক এক ম্যাচে ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে জিতে গেল ক্রিকেট


    জানি, তোমাদের কাছে এসব নিছক অর্থহীন ফাঁপা বুলি মনে হচ্ছে। তোমাদের ওই দারুণ রসিক ছেলেটা আছে না, জিমি নিশম। এমনিতে সারাক্ষণ সে টুইটারে মজা করছে, দুষ্টুমি করছে হরদম। কিন্তু কালকের ম্যাচের পর যখন সে লিখল, ‘বাচ্চারা তোমরা খেলাধূলায় এসো না। এর চেয়ে অন্য কিছু কোরো। ৬০ বছর বয়সে সুখী হয়ে মরতে পারবে-’ বিশ্বাস কর, প্রতিটা শব্দ যেন চুরমার করে গেছে হৃদয়। তোমাদের সবার কথা যেন নিশম নামের ছেলেটা বলে দিয়েছে একাই, নীলকন্ঠ হয়ে পান করেছে কষ্ট। লাল, নীল, বেগুনি বা অন্য কিছু নয়, আজকের দিনে যে কষ্টের রং শুধুই কালো।

    এই কষ্ট তো তোমরা কম পাওনি গত ছয় মাসে। ক্রাইস্টচার্চের সেই ঘটনার পাঁচ মাসও হয়নি এখনও। তোমাদের ছবির মতো সুন্দর শান্তির নীড় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী হামলায়। আমাদের দেশের ছেলেরা একদম কাছ থেকে দেখে এসেছিল তা, তোমাদের ২২ গজের জীবন অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল ওই ঘটনায়। তোমরা সবাই সেদিন মুষড়ে পড়েছিলে, পুরো দেশটাই তো আসলে এক লহমায় রূপকথা থেকে নেমে এসেছিল কুৎসিত, কদর্য পৃথিবীতে। কিন্তু তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো তোমরা অন্তত কালো জার্সিতে কোনো দাগ লাগতে দাওনি। সবার ওপরে ক্রিকেট সত্যকেই করেছে ধ্রুবতারা।

    কালকের কথাই ধরো। কথায় আছে সংকটের সময় নাকি সত্যিকার রূপ দেখা যায় মানুষের। সেরকম মুহূর্ত কয়েকবার এসেছিল কাল। স্টোকস যখন নিশামকে ছয় মারল, বোল্ট ক্যাচটা ধরতে গিয়ে পা দিয়ে ফেললেন সীমানাদঁড়িতে। আম্পায়াররা সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগেই মার্টিন গাপটিল আঙুল তুলে ছয়ের সংকেত দিলেন। ম্যাচের ওই স্নায়ুক্ষয়ী মুহূর্তে একটুর জন্য যখন হতে পারে কত কিছু, তোমরা খেলোয়াড়ি চেতনা ভুলে যাওনি।

    এর চেয়েও বড় ঘটনা হলো আরেকটু পর। শেষ ওভারে গিয়ে, যখন বিশ্বকাপ ট্রফি আর তোমাদের মধ্যে ইঞ্চির ব্যবধান। বেন স্টোকস বোল্টের বলটা ডিপ মিডউইকেটে ঠেলে দিয়েই দৌড় দিলেন। সেই গাপটিল, যার অর্জুনসম নিশানায় ধোনির আউটে তোমরা উঠে এসেছিল ফাইনালে। কিন্তু এবার কী হলো? গাপটিলের মাপা থ্রোতে স্টোকস যখন ক্রিজে ঢোকার জন্য ডাইভ দিলেন, বল তার ব্যাটে লেগে চার হয়ে গেল। অন্য অনেক দল হলে তখনই লংকাকাণ্ড হয়ে যেত হয়তো, ওই ঘটনার পর হয়ে যেত তুলকালাম। তোমরা খানিক বিভ্রান্তির পর আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছ অধোবদনে। এমনকি ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে যখন তোমাদের কাণ্ডারি উইলিয়ামসনের কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলো, মৃদু হেসে ব্যাপারটা একরকম এড়িয়েই গেলেন। সেই উইলিয়ামসন, এখনকার ক্রিকেটটা যার মতো পার্ট অব দ্য গেম করে নিতে পেরেছেন খুব কম ক্রিকেটারই। তার চেয়েও বড় ধাক্কাটা নিশ্চয় পেয়েছেন এরপর। সেই বলে আম্পায়ার ধর্মসেনা ছয় রান দিলেন, কিন্তু আসলে সেটা ছিল ভুল। পাঁচ রানই দেওয়া উচিত ছিল, যেটার জন্য তোমাদের দিতে হয়েছে মূল্য। কিন্তু কিচ্ছু নিয়ে কোনো প্রতিবাদ জানাওনি, ক্রিকেট নামের খেলাটার গায়ে কোনো দাগ লাগতে দাওনি। যারা তোমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক-টুইটার পোস্ট চালায়, তারাও জয়ের পর পরেই ইংল্যান্ডকে অভিনন্দন জানিয়ে পোস্ট দিয়েছে। ধন্যবাদ প্রাপ্য ওদেরও।


    আরও পড়ুন 

    কেন উইলিয়ামসন : ২২ গজে এক সন্ন্যাসী


    আর হ্যাঁ, তোমাদের অধিনায়ক উইলিয়ামসন নামের ভদ্রলোককে আলাদা করে ধন্যবাদ দিও। এমন একটা ম্যাচের পর চাইলেই একগাদা অভিযোগ করতে পারত সে। আম্পায়ারিং থেকে শুরু করে দুর্ভাগ্য, দায়ী করতে পারত অনেক কিছুকে। এমনকি সবচেয়ে বেশি বাউন্ডারিতে জেতার প্রশ্নবিদ্ধ নিয়মের জন্য কাঠগড়ায় তুলতে পারত আইসিসিকেও। অথচ একটা অভিযোগ তো দূরে থাক, কোনো অনুযোগ  পর্যন্ত নেই। ম্যাচ শেষে পাণ্ডুর মুখের আড়ালে হতাশার রেখাটাই শুধু চোখে পড়ল। ব্যস, ওটুকুই। এরপর মলিন হাসি নিয়েই কথা বলল ম্যাচ শেষে, দুর্দান্ত একটা টুর্নামেন্ট কাটানোর পর সিরিজসেরা হিসেবে নিজের নাম জেনে  রীতিমতো বিস্মিত হয়েছে সে। বুকে পাথর বেঁধে বলেছে, শিরোপা ইংল্যান্ডের প্রাপ্য। ক্রিকেটে তার মতো মানুষের আরও দরকার আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ভীষণ বিব্রত হয়েছে। হাসতে হাসতে শুধু বলেছে, সবাই যে যার মতো আলাদা। সেই ক্রো, ফ্লেমিং, ভেট্টোরি থেকে শুরু করে ম্যাককালাম- তোমরা তো কম নেতা দাওনি ক্রিকেটকে। কিন্তু এই লোকটা সবার চেয়ে আলাদা। এমন সৌম্য শান্ত ঋষিসুলভ লোককে আসলে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জৌলুসের ভারে ক্লিষ্ট এখনকার কৃত্রিম ক্রিকেটে মানায় না মোটেই। এমন একজন নেতা পাশে পাওয়াটা তোমাদের তো বটেই, ক্রিকেটের জন্যই সৌভাগ্য।

     

    এবার তোমাদের কাছে একটু ক্ষমা চাওয়ার পালা। এই বিশ্বকাপে তোমাদের ব্র্যান্ড ছিল একটু অন্যরকম। অন্য দলগুলো যখন শুরুর দিকে রান করে যাচ্ছেই, বড় স্কোরও করছে দেদারসে। কিন্তু তোমরা মন দিয়েছিলে বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে। ব্যাটিং ম্যাচ জেতায়, কিন্তু বোলিং জেতায় টুর্নামেট- সেই বিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলে। আর সঙ্গে দুর্দান্ত  ফিল্ডিং তো আছেই। প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে কানের পাশ দিয়েই গুলি গেছে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে হারার পর যেন হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেললে। এরপর সেমিতে ওঠা নিয়েই টানাটানি। মানুষজনও বলা শুরু করল, এই নিউজিল্যান্ড ঠিক চলে না, শেষ চারে ওঠা তাদের ‘প্রাপ্য’ নয়। শেষ পর্যন্ত সেমিতে ভারতের মুখোমুখি হলো, তোমাদের পক্ষে বাজি ধরার লোক খুবই কম। ২৩৯ রান করার পর সেটা কমে গেল আরও। সেই রানকেই বোলিং আর দারুণ ফিল্ডিংয়ে বানিয়ে ফেললে যথেষ্ট।

    তারপরও তো কম কথা হয়নি তোমাদের নিয়ে। নিউজিল্যান্ডে ফাইনালে কী করতে পারবে, সেটা নিয়েও ছিল সংশয়। তোমরা ফাইনালে আন্ডারডগ কি না, এমন প্রশ্নে উইলিয়ামসন মুচকি হেসে বলেছিল, ‘যে কেউ যে কাউকেই হারাতে পারে, সেটা যে ডগ- হোক।’ লর্ডসে যেভাবে শুরু হলো ম্যাচ, তাতে উইলিয়ামসনের কথার ওপর ভরসা করতে পারেনি অনেকেই। আরও একবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ২৪১ রান করার পর ‘ইটস কামিং হোমটাই’ হয়তো শোনা যাচ্ছিল বেশি। কিন্তু আরও একবার বোলিং আর ফিল্ডিং দিয়ে ম্যাচ প্রায় বের করে নিচ্ছিলে তোমরা। শেষ পর্যন্ত পারো বটে, কিন্তু আমাদের মন তো ভরিয়েছ। কয়েক দিন আগেই যারা বলছিল, এই দল ফাইনালে যাওয়ার যোগ্য নয়, তাদের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।

    ক্রিকেটকেও কি কম ঋণী করেছ কাল? এমন একটা ম্যাচ এসেছে তোমাদের হাত ধরে, যেটার গল্প চলবে যুগ যুগ ধরে, অন্তত যতদিন আমরা বেঁচে আছি। ক্রিকেট নামের খেলাটার সবচেয়ে পুরনো দূতদের একজন তোমরা। ২২ গজ খেলে অনেকেই, তবে ক্রিকেটের চেতনার সত্যিকারের বিজ্ঞাপন তোমাদের মতো করে করতে পেরেছে খুব কম দলই। অথচ মানুষ কত আর তোমাদের দেশে, টেনেটুনে ৫০ লাখ। এক ঢাকা শহরেই এর চেয়ে চারগুণ লোক থাকে। এত সীমাবদ্ধতার পরও তোমরা খেলে গেছ আনন্দদায়ী ক্রিকেট। শুধু ওয়ানডের কথা ধরলে সেই ৯২তে মার্টিন ক্রোর খেলা দেখে বড় হয়েছে একটা প্রজন্ম। দীপক প্যাটেলকে দিয়ে ওপেন করানো বা মার্ক গ্রেটব্যাচকে দিয়ে পিঞ্চহিটিং- আধুনিক ক্রিকেটের অনেক মৌলিক ভাবনার নেপথ্যে ছিলে তোমরা। অথচ ট্রফিটা বরাবরই অধরা হয়ে থেকেছে। ম্যাককালামের সোনালী প্রজন্মও গত বার দেশের মাটিতে পারেনি ট্রফি এনে দিতে। তাও তো সেবার লড়াই করতে পারোনি, অন্তত আক্ষেপ কম ছিল। এবার তো সেটাও নেই। এত কাছে ফিরে আসার তো কোনো সান্ত্বনা হয় না। এমন সুযোগ আবার কবে আসবে, সেটাই বা কে বলতে পারে!

    তবে এটুকু জেনে রাখ, তোমরা এই বিশ্বকাপকে যা দিয়েছ, তার ঋণ শোধ করতে অনেক দিন লাগবে ক্রিকেটের। তোমরা দেশে ফিরে যাচ্ছ হতাশ হয়ে, তবে অবশ্যই মাথা নিচু করে নয়। তোমাদের শোকেসে ট্রফি থাকবে না হয়তো, তবে ভালোবাসার কোনো কমতি হবে না সেখানে। সত্যিকার চ্যাম্পিয়নদের তো ট্রফি লাগে না, তাই না?

     

    বাংলাদেশ থেকে

    তোমাদের একজন শুভানুধ্যায়ী