• বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ
  • " />

     

    গৃহযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ আর ফুটবল : আফ্রিকার বুরুন্ডির স্বপ্নযাত্রা

    গৃহযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ আর ফুটবল : আফ্রিকার বুরুন্ডির স্বপ্নযাত্রা    

    বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সেমিফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ বুরুন্ডি। জাতীয় দলের ফুটবলাররা না থাকলেও বুরুন্ডির এই দলটাও কম শক্তিশালী নয়। দলের দায়িত্বে নেই মূল কোচও। তবে জাতীয় দলের কোচ অলিভিয়ের নিয়ুংগেকোও দলের সঙ্গে অবস্থান করছেন ঢাকায়। যার হাত ধরে বুরুন্ডি গত বছর অংশ নিয়েছিল আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসে। নিয়ুংগেকোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার পর পূর্ব আফ্রিকার দেশটির ফুটবল উত্থানের গল্প তুলে ধরে হয়েছে এখানে।


    ধানমন্ডির শেখ জামাল ক্লাব মাঠে টিম বাস থেকে নেমে অনুশীলন শুরু করবে বুরুন্ডি। সবার শেষে গাড়ি থেকে নামলেন অলিভিয়ের নিয়ুংগেকো। দল ততোক্ষণে অনুশীলন শুরু করে দিয়েছে। নিয়ুংগেকো মাঠেও ঢুকলেন না। পাশে দাঁড়িয়ে অনুশীলন দেখছেন, আসলে গিলছেন। নিয়ুংগেকো বুরুন্ডির জাতীয় দলের কোচ । বাংলাদেশের বিপক্ষে বুরুন্ডির বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সেমিফাইনাল দুইদিন পর। নিয়ুংগেকোর অবশ্য তেমন কাজ নেই এখানে। ঢাকায় এসেছেন তরুণ দলটা দেখতে। বুরুন্ডি জাতীয় দলের ব্যানারে বাংলাদেশে এলেও এত এক ঝাঁক নতুন মুখ। দলের কোচও অন্য আরেকজন, বিপফুবসা জসলিন। তিনিই অনুশীলন পরিচালনা করছেন। অনুর্ধ্ব-১৭, ২৩ দল মিলিয়ে একটা জাতীয় দল দাঁড় করিয়ে বাংলাদেশে এসেছে বুরুন্ডি।

    মার্চে আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের বাছাইপর্বে বুরুন্ডির প্রতিপক্ষ মৌরিতানিয়া। হাতে আরও দুই মাস সময় আছে। নিয়ুংগেকো এখানে এসেছেন শুধুই অনুশীলন দেখতে। লক্ষ্য ঘরোয়া লিগে খেলা এই খেলোয়াড়দের ভেতর থেকে জাতীয় দলের জন্য নতুন কাউকে খুঁজে বের করা।

    ৪৯ বছর বয়সী ফুটবল কোচ বার্সেলোনার পাঁড়ভক্ত। ঢাকায় এসেও বার্সেলোনার খেলা মিস যায়নি তার। তবে হোটেলরুমের টিভিতে গত রবিবার লিভারপুল-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যাচটি দেখতে না পেরে চরম বিরক্ত নিয়ুংগেকো। একটু অভিযোগের সুরেই বললেন, তোমাদের এখানে চ্যানেল ঘোরালে শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট, এটা কোনো খেলা হলো নাকি!

    ***


    ১৯৯৩। খাদের কিনারায় বুরুন্ডি, গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় থমথমে অবস্থা। দেশের অমন পরিস্থিতিতে গ্যাবনে আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের বাছাইপর্বের প্লে অফ ম্যাচ বুরুন্ডির। প্রতিপক্ষ গিনি। যুদ্ধের হাত থেকে বুরুন্ডিকে কেউ যদি রক্ষা করতে পারত তাহলে সেটা ছিল সম্ভবত ওই ফুটবল ম্যাচটাই। বুরুন্ডি গিনির সঙ্গে ম্যাচটা হারল টাইব্রেকারে গিয়ে। কোনোকিছুই আর পক্ষে গেল না। ওই ম্যাচের কিছুক্ষণ পর নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মেলকোয়ির এনদাদায়ের নিহত হলেন দেশটির তুতসি বাহিনীর হাতে। এর পর হুতু আর তুতসি বাহিনীর যুদ্ধটা ছিল সময়ের ব্যাপার।শুরু হলো গৃহযুদ্ধ।

    এক যুগের গৃহযুদ্ধে দেশটির শাসন কাঠামোই ভেঙে পড়েছিল। এর ভেতর ১৯৯৩-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ফুটবল থেকেও নির্বাসনে ছিল বুরুন্ডি। নতুন শতাব্দীতে ধীরে ধীরে আন্তজার্তিক ফুটবলে বিচরণ শুরু হলেও সেটা আবার থমকে যায় ২০০৩ সালে। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায়ে ফিফাও সাহায্য সহযোগিতার হাত সরিয়ে নেয় বুরুন্ডির থেকে।

    যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নিজের ভবিষ্যৎ দেখেননি নিয়ুংগেকো।  উপায় না দেখে ২০০৭ সালে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুইডেন। তিন বছর বহু চেষ্টা করেও অবশ্য শেষ পর্যন্ত সুইডেনের ‘কাগজ-পত্র’ জোটেনি নিয়ুংগেকোর কপালে। বছর তিনেক পর তাই দেশেই ফিরতে হয়েছিল নিয়ুংগেকোকে। যেখানে ফিরতে চাননি তিনি।

    নিয়ুংগেকো ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে বুরুন্ডির হয়ে আফ্রিকান ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপেও খেলেছিলেন। এর পর দক্ষিণ আফ্রিকার এক ক্লাব  থেকেও ডাক এসেছিল তার জন্য। কিন্তু মায়ের ইচ্ছের বিপরীতে যাননি নিয়ুংগেকো। কিশোর নিয়ুংগেকো পড়াশুনাই চালিয়ে গিয়েছিলেন। ফুটবল কোচিংয়েও হাতেখড়ি তখন।

    নিয়ুংগেকো ফুটবলকে আর পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। তবে হতাশ হয়ে ফুটবলের জন্য বিদ্বেষও জন্মায়নি তার মনে। ভালোবাসার সঙ্গে আবার প্রতারণা হয় নাকি? হলে সেটা আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। ফুটবলের প্রেমেই পড়েছিলেন নিয়ুংগেকো।  ২০১০ সালে দেশে ফিরে তাই নেশাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন, শুরু করলেন ফুটবল কোচিং, “আমি ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তাই এর পর লক্ষ্য ছিল কোচ হওয়া।”- জহুরীর চোখ দিয়ে দূর থেকে খেলোয়াড়দের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ফাঁকে ফাঁকে এই গল্পগুলো বলছিলেন নিয়াংগেকো।  

    স্থানীয় দুইটি ক্লাবে কাজ করার পর নিয়ুংগেকো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। জাতীয় দলে খেলা হয়নি, কিন্তু ২০১৬ সালে ইনতাম্বা মু রুগাম্বার নতুন কোচ হলেন সুইডেনের শরণার্থী হতে চাওয়া সেই ভদ্রলোক। বুরুন্ডির জাতীয় দলের হেড কোচ।  এর পর বুরুন্ডির ফুটবলভাগ্য মিলে গেছে পাজলের মতো। ১৯৯৩ তে যে স্বপ্নেরদুয়ার থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল, ২০১৯ এ গিয়ে বুরুন্ডির সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে নিয়ুংগেকোর হাত ধরে। বাছাইপর্ব পেরিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছিল বুরুন্ডি। 

    “সে রাতে বুরুন্ডির ঘরে ঘরে উৎসব হয়েছে। এমন কিছু আগে দেখিনি আমি। সে উদযাপনের কথা বলে বোঝানো যাবে না।”- আফ্রিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের টুর্নামেন্ট আফকনের (আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস) মূলপর্ব নিশ্চিত হওয়ার পর বুরুন্ডিয়ানদের উদযাপনের বলছিলেন নিয়ুংগেকো। বুরুন্ডির জাতীয় নায়ক তো হবেনই নিয়ুংগেকো!

    বুরুন্ডি আফকনে খেলতে গিয়েছিল ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে পেছনের দল হয়ে। প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়ার কাছে এক গোলের হারের পর মাদাগাস্কারের কাছেও এক গোলে হেরেছিল বুরুন্ডি। এর পরও শেষ ম্যাচ জিতলে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল নিয়াংগেকোর দলের, “শেষ ম্যাচে কী হলো আমি এখনও বুঝি না। আমাদের জয় দরকার ছিল। কিন্তু ম্যাচের দশ মিনিটের ভেতর (আসলে ১২ মিনিট) এনদুয়ারুগিয়া লাল কার্ড দেখে আমাদের দশ জনের দল বানিয়ে দিল। পরে ম্যাচটা দুই গোলে হারতে হলো।” গল্প বোধ হয় এমনই হয়।  ২৭ বছর আগে গিনির কাছে হেরে আফকনে খেলা হয়নি বুরুন্ডির। প্রথমবার আফকন খেলতে এসেই দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াল সেই গিনিই। এবার আর পাজল মেলানো গেল না। বুরুন্ডির স্বপ্নযাত্রা থেমেছিল তাই গ্রুপপর্বেই।



    নিয়মিত প্রিমিয়ার লিগ দেখে থাকলে সাদিও বেরাহিনোকে চেনার কথা আপনার। ওয়েস্টব্রম আর স্টোক সিটির (চ্যাম্পিয়নশিপ) হয়ে বুরুন্ডিয়ান স্ট্রাইকার বেরাহিনো আলো ছড়িয়েছিলেন অনেকদিন। বুরুন্ডির জাতীয় দলের অধিনায়কও বেরাহিনো। বুরুন্ডির নায়কও তিনি।

    আফকনের জন্য নিয়ুংগেকো দল গড়েছিলেন বেরাহিনোদের মতো খেলোয়াড়দের দিয়ে। বেরাহিনোর গল্পটাই বলা যাক। গৃহযুদ্ধ শুরুর বছর জন্ম, গৃহযুদ্ধ প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল বেরাহিনোর বাবার। এর পর ১০ বছর বয়সে বুরুন্ডি থেকে একা একা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়ে বেরাহিনো হয়েছিলেন পেশাদার ফুটবলার। ইংল্যান্ডের মতো ক্লাবে না হলেও ওই প্রজন্মের অনেক বুরুন্ডিয়ান ফুটবলারের জীবনের গল্পই বেরাহিনোর মতো।

    “টাকার জন্য ফুটবল খেলে লাভ নেই। ওভাবে ফুটবল হয় না। ফুটবল নিয়ে খেতে হবে, ঘুমাতে হবে, ভালোবাসতে হবে। সে তুমি খেলোয়াড় হও, কোচ হও আর সাংবাদিক হও।”- দীর্ঘ আলাপচারিতায় এই কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ কয়েকবার বলেছেন নিয়ুংগেকো।

    জাতীয় দল তো একটি দাঁড়িয়ে গেছে। তাহলে এখন কি পরিকল্পনা? কোচ তো একজন এসেছেনই। জাতীয় দলও এখানে নেই। তাহলে বুরুন্ডি থেকে ঢাকায় আসার দরকার কী ছিল? নিয়ুংগেকো এই প্রশ্নগুলোর জবাবে যা বলেছেন তাতে শেখার আছে আমাদের দেশের ফুটবল কর্তাদেরও, “আমি জাতীয় দলে এমন সব খেলোয়াড় ডেকেছি যারা বাইরের দেশে লিগ খেলে। বাইরের দেশে না খেললে পেশাদারিত্বের ব্যাপারে ঘাটতি থেকে যায়। এই যে এখন যে খেলোয়াড়রা এখানে খেলছে এরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। জাতীয় দলের পরের ম্যাচে এখান থেকে কাউকে ডাকা যায় কী না সেটা পরখ করছি এখানে বসে। এটাই আমার কাজ।”

    নিয়ুংগেকো জানালেন দেশটির বয়সভিত্তিক সবগুলো দলই তার কোচিং দর্শন মেনে চলে। তাতে বয়সভিত্তিক দল থেকে জাতীয় দলে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটাও সচল হয়। দেশের ফুটবলের খবর নিয়মিত রেখে থাকলে আপনি জানেন, এখানকার চিত্র পুরো বিপরীত। অথচ এক যুগের গৃহযুদ্ধ থামার পরও ২০১৫ সাল থেকে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতায় নড়বড়ে হয়ে গেছে বুরুন্ডি। ইউনাইটেড নেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রায় চার লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছে। যেখানে পূর্ব আফ্রিকার দেশটির জনসংখ্যা ১ কোটি ১৭ লাখের কিছু বেশি।  ওই একই বছরের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৫৬ টি দেশের ভেতর সবচেয়ে অসুখী দেশের নামও বুরুন্ডি। অথচ এক ফুটবল সে দেশের শিশুদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয় জাদুর মতো। নিয়াংগেকু বলছেন তার দেশে ফুটবল এক নম্বর খেলা। তার দেশের প্রেসিডেন্ট নিজেও একজন সাবেক ফুটবলার। কাঠামো তৈরির কাজটাই করছেন এখন তারা। বুঝতে বাকি থাকে না বাংলাদেশে খেলতে আসাও সেই প্রক্রিয়ার একটি অংশ বুরুন্ডির জন্য।  



    ***

    আফ্রিকার দেশ, শারীরিক দিক দিয়ে তাদের এগিয়েই থাকার কথা। কিন্তু নিয়ুংগেকো বলছেন অন্য কথা, “আমার খেলোয়াড়রা টেকনিক্যালি দারুণ। কিন্তু ফিজিক্যালি তারা তেমন ভালো না। ভালো খাওয়া না পেলে এমনটা হবেই।” নিয়াংগেকুর আফসোস আছে তার ট্রেনিং স্টাফদের নিয়েও। তার ভাষ্যমতে মাত্র তিনজন কোচিং স্টাফ আর চিকিৎসক ও অফিসিয়ালদের নিয়ে মোট ৬ জন মিলে এই বুরুন্ডির দল চালাতে হয় তাকে। নিয়ুংগেকু বাস্তবতা বোঝেন, নিজ দেশের সীমাবদ্ধতার কথাও জানেন। তবে এক জায়গায় আটকে থাকতে চান না তিনি, বুরুন্ডির এই স্বপ্নযাত্রাটা যাতে এক আফকন খেলাতেই থেমে না যায় সেটাই তার লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যেই ঢাকায় পা রাখা তার।

    বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে খুব বেশি ধারণা নেই নিয়ুংগেকোর। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মতে উন্নতির নকশা সব দেশেই এক। নিজের দেশের উন্নতির ধারাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি, “আমরা এক বছর আফকনের বাছাই পর্বের প্লে-অফে খেললাম, পরের বার ফিফার অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে (১৯৯৪ সাল) অংশ নিলাম। এভাবে ধাপে ধাপে উন্নতি করেছি আমরা।”

    “আপনাকে সবার আগে একটি সাদা কাগজ হাতে নিতে হবে। এর পর ওখানে লিখতে হবে আপনি কী করতে চান, কোথায় পৌঁছাতে চান আর কীভাবে পৌঁছাতে চান। সেটা ধরেই এগিয়ে যেতে হবে।”

    ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ থাকা, সুইডেনেও ঠাঁই না হওয়া- এতোসব অপ্রাপ্তির পরও ফুটবল নিয়ুংগেকোকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। নিয়ুংগেকোর জীবনের গল্প বলছে ফুটবলের কাছ থেকে কিছু চাননি তিনি, বরং ফুটবলকে দিতে চেয়েছিলেন কিছু। কিছু দিতে গিয়েই প্রাপ্তি নিয়ে ফিরেছেন তিনি।