• অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ২০২০
  • " />

     

    উনিশে এসে অবশেষে ক্রিকেট-বসন্তের দেখা পেল বাংলাদেশ

    উনিশে এসে অবশেষে ক্রিকেট-বসন্তের দেখা পেল বাংলাদেশ    

    ফাইনাল, অ-১৯ বিশ্বকাপ ২০২০
    ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ অলআউট (জইসওয়াল ৮৮; অভিষেক ৩/৪০, সাকিব ২/২৮, শরিফুল ২/৩১)
    বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ ৪২.১ ওভারে ১৭০/৭
    বাংলাদেশ ডিএল মেথডে ৩ উইকেটে জয়ী


    একটা ম্যাচ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারতেন না আপনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে আপনার এত বছরের বেড়ে ওঠা, এরকম একটা দিনের জন্য আপনি অপেক্ষা করছিলেন। এত এত ফাইনালে শেষ মুহূর্তের স্বপ্নভঙ্গ, তার বেশির ভাগই আবার ভারতের কাছে- আরেকটা স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনালের আগে আশংকার চোরাস্রোত হয়তো বয়ে যাচ্ছিল আপনার শিরায়। সব সংশয় পেরিয়ে, সব ফাইনালের ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের তরুণরা লিখল জয়ের কাব্য। হ্যাঁ, এখন আপনি লিখতে পারেন বাংলাদেশের এই প্রথম ক্রিকেটের কোনো বৈশ্বিক শিরোপা জিতেছে, ভারতকে ডিএল মেথডে ৩ উইকেটে হারিয়ে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের ট্রফি আসছে বাংলাদেশে।

    সেই জয়ের পরতে পরতে কত নাটক, কত রোমাঞ্চ। বাংলাদেশ ফাইনালে উঠলে এমন কিছু দেখার জন্য আপনি মানসিকভাবে হয়তো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। তবে এটাও তো ঠিক, এই যুবারাই মাস পাঁচেক আগে তীরে এসেও এই ভারতের বিপক্ষেই তরী ভেড়াতে পারেনি এশিয়া কাপে। আজ প্রতিপক্ষ ভারত বর্তমান চ্যাম্পিয়ন, সব প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে উঠেছে ফাইনালে। আরেকটি ফাইনালের আগে আরেকটি অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গেও তো যুঝতে হচ্ছিল বাংলাদেশকে- বৃষ্টি। পচেফস্ট্রুমের আকাশ যতই কালো হয়ে এসেছে, বাংলাদেশকে সেই সঙ্গে ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডের হিসেবও মেলাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি এসে খেলা থামিয়ে দিলেও মাঠ থেকেই জয় নিয়ে উল্লাস করতে পেরেছে বাংলাদেশ। পচেফস্ট্রুম মুহূর্তেই হয়ে গেছে একটুকরো লাল-সবুজ, আকবর-শরিফুল-রাকিবুলদের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে গেছে আফ্রিকা থেকে হাজার মাইল দূরের এই এক লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের বদ্বীপে। একটা শিরোপার জন্য যে অনেক দিন ধরেই অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ!

    নাটকের কথা বললে আসলে ক্রিস্টোফার নোলানের একটা সিনেমার চিত্রনাট্যই হয়ে যাবে। ভারত যখন ১৭৭ রান করল, তখন ম্যাচের হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষেই পাল্লা ভারি। পচেফস্ট্রুমের উইকেটে এমন কোনো জুজু ছিল না, তারপরও ফাইনাল মানেই তো চাপ। শুরুতে মনে হচ্ছিল সেই চাপ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে বাংলাদেশের যুবারা। তানজিদ হাসান তামিম আর পারভেজ হোসেন ইমন মিলে শুরুটা করেছিলেন দুর্দান্ত। প্রথম কয়েক ওভারে ৬-এর ওপর রান-রেট ছিল বাংলাদেশের। ভারতের বোলাররা অনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ওয়াড-নো দিয়ে কাজটা সহজ করে দিচ্ছিলেন। সঙ্গে ইমন আর তামিম খেলছিলেন চোখজুড়ানো কিছু শট। এর মধ্যে লেগ স্পিনার রভি বিষ্ণয় এলেন, তাকে স্লগ সুইপে দারুণ একটা ছয়ও মারলেন তামিম। কিন্তু সেই কাজটা আবার করতে গিয়েই শুরু বাংলাদেশের হোঁচট খাওয়ার। ১৭ রান করে ফিরলেন তামিম।
     


    আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয় দারুণ দুইটি চারে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিষ্ণয়ে বিস্মিত হওয়া শুরু হলো বাংলাদেশের। গুগলি বুঝতে না পেরে বোল্ড জয়, তৌহিদ হৃদয় আরেকটি গুগলি বুঝতে না এলবিডব্লু হলেন কোনো রান না করেই। ইমনও ক্র্যাম্প হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়লেন, মড়ার ওপর খাড়ার ঘা যোগ হলো বাংলাদেশের। কার্যত ৬২ রানে চারটি উইকেট হারিয়ে ফেলল বাংলাদেশ। খানিক পর শাহাদাত যখন স্টাম্পড হয়ে গেলেন বিষ্ণয়ের বলে, ৬৫ রানে আসলে পাঁচ উইকেট নেই বাংলাদেশের।

    ১৭৭ রান তখন মনে হচ্ছিল অনেক দূরের পথ। আকবর আলী শুরুতেই দারুণ কিছু শটে চাপ কমালেন। কিন্তু অন্য পাশে শামীম হোসেন শুরু থেকেই ছটফট করছিলেন। অস্থির হয়েই সুশান্তের অফ স্টাম্পের বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে একস্ট্রা কাভারে তুলে দিয়ে এলেন ক্যাচ। ৮৫ রানে ৫ উইকেট নেই বাংলাদেশের, অশনী সংকেত আরেকটু ভালো করে দেখা দিতে শুরু করেছে।

    অভিষেক ব্যাট করতে পারেন, একটা চার মেরে সেটার প্রমাণও দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেও ভর করল অস্থিরতার রোগ। এক ওভারে দুই বার জীবন পাওয়ার পরও সুশান্তের বলটা আবার পুল করতে গিয়ে দিয়ে এলেন ক্যাচ। ১০২ রানে ৬ উইকেট নেই বাংলাদেশের।

    ইমনকে চোট ভুলে আবার নামতে হলো মাঠে। আকবরের সঙ্গে মিলে ঠিক করলেন, উইকেট দেওয়া যাবে না। তখনও বিষ্ণয়ের ওভার চারেক বাকি, রানও দরকার ৭০ এর বেশি। এরপর আর কোনো স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান নেই। দুজন মিলে একটু একটু করে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু চোটের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো ইমনকে, ৪৭ রান করে জইসওয়ালের বেশ বাইরের বলে ক্যাচ দিয়ে এলেন। দুজনের ৪১ রানের জুটি ভাঙল, তখনও জয়ের জন্য দরকার ৩৪ রান।
     


    আকবর ঠিক করলেন, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। জানতেন, একটা উইকেট হারালে ডিএলের সমীকরণও চলে যাবে বিপক্ষে। টানা তিন ওভারেরও বেশি কোনো রান না নিয়েই কাটিয়ে দিলেন রাকিবুলকে নিয়ে। বিষ্ণয়কে এনেও লাভ হলো না ভারতের। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুজন। এরপর যখন বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত এলো, জয় থেকে ১৫ রান দূরত্বে বাংলাদেশ, তবে ডিএলে এগিয়ে থাকায় আর খেলা না হলে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু বৃষ্টি ছিল মাত্র মিনিট দশেক, এরপর সমীকরণ দাঁড়াল পাঁচ ওভারে সাত রান। সেটা নিতে এক ওভারের বেশি নেয়নি বাংলাদেশ।

    তার আগের গল্পটা বাংলাদেশের বোলারদের। টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে শুরু থেকেই শরিফুল আর সাকিব দারুণ বল করে চাপে রেখেছিলেন ভারতের ওপেনারদের। অভিষেকের বলে শেষ পর্যন্ত উইকেট দিয়ে এলেন সাক্সেনা, দুই রানেই ফিরলেন। তবে জইসওয়াল স্থির থেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন ইনিংস, তিলক ভার্মার সঙ্গে যোগ করলেন ৯৪ রান। সাকিবের বলে শেষ পর্যন্ত ভার্মা আউট হলেন, সেখানেও শরিফুল। দারুণ একটা ক্যাচ নিলেন, ১০৩ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল ভারত। প্রিয়াম গার্গ ৭ রান করে রাকিবুলের বলে আউট, তবে জুরেলকে নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন জইসওয়াল। এর পরেই শরিফুল এসে করলেন গেম চেঞ্জিং ওভার। প্রথমে তার বলে ৮৮ রান করে ফিরলেন জইসওয়াল, পরের বলে ভির আউট কোনো রান না করেই। ১৫৬ রানে ৫ উকেট নেই ভারতের।

    সেই চাপ থেকে শেষ পর্যন্ত আর বেরুতেই পারল না তারা। ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে গেলেন জুরেল, পরের ওভারে সরাসরি থ্রোতে বিষ্ণয়কে ফেরালেন আবার সেই শরিফুল। এরপর অথর্ভ আর কার্তিককে ফিরিয়ে দিলেন অভিষেক, আর সুশান্তকে আউট করে শেষ টান দিলেন সাকিব। শেষ ক্যাচটাও ধরলেন শরিফুলই। ৩ উইকেটে ১৫৬ রান থেকে ১৭৭ রানে অলআউট হলো ভারত। এর পরের গল্পটা তো আপনি জেনেই গেছেন। টিভিতে বা মুঠোফোনে হোক বা পচেফস্ট্রুমে, যেখানেই দেখুন, সেই গল্প আপনি করবেন অনেক অনেক দিন।