• জিম্বাবুয়ের বাংলাদেশ সফর
  • " />

     

    লিটন-তামিমদের দিনে মাশরাফিকে নিয়েই গল্প হোক

    লিটন-তামিমদের দিনে মাশরাফিকে নিয়েই গল্প হোক    

    মাশরাফি বিন মুর্তজা প্রথম দুই ম্যাচে রোদচশমা পরে মাঠে আসেননি। আজ ছবিটা অন্যরকম, শেষবারের মতো দেশের হয়ে টস করতে নামার সময় তার চোখে রোদচশমা। আবেগটা ঢাকা দেওয়ার জন্যই কী?

    মাশরাফি অবশ্য দৃশ্যত এই আবেগে বিশ্বাস করেন না। কাল সংবাদ সম্মেলনে যখন বলা হচ্ছিল বিদায়ের ঘোষণা দেওয়ার সময় চোখটা একটু টলোমলো কি না তখন প্রায় শাসনের সুরে বললেন, ‘এসব বানাবেন না, এসব একদম বানাবেন না।’ তবে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের আজকের ম্যাচটা ছিল আসলে মাশরাফির জন্যই। মঞ্চটা তার, তবে সেখানে পারফর্ম করে গেলেন লিটন দাস আর তামিম ইকবাল। মাশরাফি নিজেও খানিকটা সময় মঞ্চ আলো করে গেলেন।  কেন্দ্রীয় চরিত্র হওয়ার জন্য যে মঞ্চে বেশির ভাগ সময় থাকতে হবে এমন তো কথা নেই!

    সেই মঞ্চ মাশরাফির হলো একদম শেষবেলায়। ম্যাচ শেষের সঙ্গে সঙ্গে সাইফ উদ্দিন গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাকে,  মাশরাফি আলিঙ্গনটা প্রলম্বিত করতে দেননি। তবে সতীর্থদের ভালোবাসা আর বিদায়ী সম্মানটা আর অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তামিম এসে কাঁধে তুলে নিলেন তাকে, যেমনটা টেন্ডুলকারকে নিয়েছিলেন কোহলিরা। মিরাজ, তাইজুলরা দুই পাশ থেকে নিয়ে অধিনায়ককে দিলেন বিদায়ী ল্যাপ অব অনার। মাশরাফির পীড়াপীড়িতে সেটাও হলো সংক্ষিপ্ত। ১২৩ রানের জয়ে ৫০তম ওয়ানডে জিতে বিদায় বলার সময়ও মাশরাফি কোনো দাগ রাখতে চাইলেন না!

    তবে না চাইলেও কী তা হয়? সতীর্থেরা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন আরও বড় কিছুর। খানিক পরেই পুরো বাংলাদেশ হয়ে গেল একেকজন মাশরাফি। সবার পেছনে দুই নম্বর জার্সি, লেখা মাশরাফি। সামনে লেখা ‘থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন’। মাঠে নেমে এসেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। সতীর্থেরা বিদায়ী স্মারক দিলেন মাশরাফিকে। আর গ্যালারি জানাচ্ছে বিদায়ী অধিনায়ককে অভিবাদন।

    সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে প্রথম দুই ম্যাচে গ্যালারি খালি ছিল বেশ। সিলেটে অন্তত দৃশ্যটা বেমানান। বিপিএলের টিকিটের জন্যই যেখানে প্রায় কাড়াকাড়ি অবস্থা, সেখানে জাতীয় দলের খেলায় লোক হবে না কেন? শুক্রবার ছুটির দিন, সেই হাহাকার কেটে গেল অনেকটা। গ্যালারি আবারও টইটম্বুর। তবে চোখ চলে যায় কয়েকটা ব্যানারের ওপর, ‘ধন্যবাদ মাশরাফি, সবকিছুর জন্য’, ‘বিদায় অধিনায়ক’। ঢাকা থেকে সমর্থকেরা অনেকে এক দিনের নোটিশেই চলে গেছেন ‘নিতার’ বিদায়ী ম্যাচে। শেষবারের মতো যখন টস করতে নামলেন, স্টেডিয়ামজুড়ে উঠল তুমুল হুল্লোড়। সেটা অবশ্য পরেও উঠেছে বেশ কয়েকবার। উঠেছে লিটন আর তামিমের জন্য।

    জিম্বাবুয়ের সঙ্গে চিত্রনাট্যটা আগের ম্যাচের মতোই আজ অনুমিতভাবে হয়েছে। আজ শুধু একটা পার্থক্য, টসে জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে সুযোগটা করে দিয়েছেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক শন উইলিয়ামস। তামিম ইকবাল ও লিটন দাস দুজনেই আগে রান পেয়েছেন, তবে একসঙ্গে পাননি। আজ দুজনের একসঙ্গে জ্বলে ওঠার দিন। আর দুজনের ব্যাট এমনই আগুন ছড়াল, জিম্বাবুয়ে তাতে একদম পুড়ে অঙ্গার। মধ্যে দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে বৃষ্টিও সেই আগুন নেভাতে পারল না। বরং বৃষ্টি থামার পর আরও বেশি দুর্বার বাংলাদেশ।

    লিটনের সেঞ্চুরি অবশ্য হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। প্রথম ম্যাচে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল। আজ ফিফটির পর একটু খোলসে ঢুকে গিয়েছিলেন, ৫৪ বলে ফিফটির পর পঞ্চাশের জন্য খেলতে হলো ৬০ বল। স্ট্রাইক রেটে বরং তামিমই বেশি এগিয়ে ছিলেন। তবে লিটনই বল বেশি খেলেছিলেন, সতীর্থের আগেই তাই সেঞ্চুরিতে পৌঁছে গেলেন। এমনিতে লিটনের ব্যাটিং মানে ধ্রুপদী সৌন্দর্য, তবে আজ সিলেটে কিছু শট ছিল একদম স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বাঁধিয়ে রাখার মতো। তামিমও আগের সেঞ্চুরির পর ছিলেন বেশ আত্মবিশ্বাসী।

    তবে বৃষ্টির পর যখন ম্যাচ ৭ ওভার কাটা গেল, দুজনের ব্যাট হয়ে উঠল খাপখোলা তলোয়ার। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলেন বিশেষ করে লিটন। সেঞ্চুরির আগে ছয় ছিল না একটিও, এরপর শুরু করলেন তাণ্ডব। এর মধ্যে তামিম অলক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন সেঞ্চুরিতে। রেকর্ডবুকও ওলট পালট শুরু হয়ে গেল। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি হয়েছিল আগেই, যে কোনো উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডও হয়ে গেল। তবে লিটন ছুটছিলেন আরও বড় কিছুর জন্য।

    দেড়শ করার পর লিটন আরও বেশি খুনে। একটা সুযোগ তো শুরুতেই পেয়েছিলেন, ৫৪ রানের সময় তার রিভিউ নেয়নি জিম্বাবুয়ে। সেঞ্চুরির পর অন্তত চার বার আউট হতে হতেও হননি, প্রতিবারই বেঁচে গেছেন জিম্বাবুয়ে ফিল্ডারদের দাক্ষিণ্যে। এবার আল অলস সৌন্দর্য নয়, সীমানার ওপারে পাঠানোর মিশন। গুণে গুণে আট ছয় মারলেন। দুই দিন আগে তামিমের গড়া ১৫৮ রানের রেকর্ড ভাঙলেন, সেটার অভিনন্দনও পেলেন তামিমের কাছ থেকে। ডাবল সেঞ্চুরির ক্ষীণ আশাটা যখন পর পর দুই ছয়ে জাগিয়ে তুলছিলেন, মুম্বার বলে তৃতীয় ছয়টা মারতে গিয়েই ক্যাচ দিলেন লং অনে। ১৭৬ রানের ইনিংসটা শেষ হলো আফসোস জাগিয়ে। ইশ! আরও তো দুই ওভারের বেশি বাকি ছিল! তামিম এবার আলোটা নিজের দিকে নিলেন, পরের দুই ওভারে তুললেন ঝড়। বৃষ্টির পর ৫৮ বলে ১৪০ রান তুলল বাংলাদেশ, ওভারপ্রতি প্রায় ১৪র কাছাকাছি! জিম্বাবুয়ের জন্য ডিএল মেথডে লক্ষ্য হয়ে গেল ৩৪২ রান।

    মাশরাফি নতুন বল হাতে নিলেন আজ। এবার নিজের সলো পারফর্ম করার পালা। প্রথম ওভারেই স্লিপে ক্যাচ বানালেন তিনাশে কামুনহুকাওমেকে। মোস্তাফিজ আর সাইফ উদ্দিন ফিরেছিলেন আজ, বাংলাদেশের বোলিংয়ের ধারটা বেড়েছিল অনেকখানি। আস্কিং রেট আটের কাছাকাছি, জিম্বাবুয়েকে করতে হতো দারুণ কিছু। ব্রেন্ডন টেলরের ওপর ভরসা ছিল অনেকখানি, কিন্তু ভুলে যাওয়ার মতো একটি সিরিজে ব্যর্থ হলেন আজও। শন উইলিয়ামস, রেজিস চাকাভা ভালো শুরু করেছিলেন, কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি কেউ। এবং যথারীতি চিত্রনাট্য মেনে আগের ম্যাচের মতো এবারও টিন এজার ওয়েসলি মাদভেরে আর সিকান্দার রাজাই ভরসা। কিন্তু মাদভেরে ফিফটি পেলেন, রাজাও ফিফটির পর ফিরলেন। টিরিপানো শুরু করেও আগের ম্যাচের মতো অলৌকিক কিছু করতে পারলেন না। শেষটা করলেন সাইফ উদ্দিন, শেষ দুই বলে উইকেট নিয়ে শেষ করলেন ম্যাচ। চার উইকেট নিয়ে জানান দিলেন, এখন আরও ধারাবাহিক হয়ে উঠছেন তিনি।

    তবে দিন শেষে এসব গল্প গৌণ। আজকের দিনটা, আজকের জয়টা তার জন্য। আজ তাই মাশরাফিকে নিয়েই গল্প হোক।