• বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    'আমাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই'। মারিও লেমোসের ডায়েরি

    'আমাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই'। মারিও লেমোসের ডায়েরি    

    আবাহনী লিমিটেডের পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস একরকম আটকাই পড়েছেন ঢাকায়। একটি হোটেলে দিন কাটছে তার। হৈ-হুল্লোড়ের শহরে হুট করে নীরবতা নামলে যে হাহাকার সৃষ্টি হয় সেটা তার মনেও দাগ কেটে গেছে। ৩৩ বছর বয়সীর এই সময়টায় থাকার কথা ছিল পরিবারের কাছে। তবে বিমান ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় সেই সুযোগ আর হয়নি তার। ঢাকার কোয়ারেন্টিন জীবন কেমন যাচ্ছে সেসব নিয়ে লিখেছেন প্যাভিলিয়নে। অনুবাদ করেছেন রিফাত মাসুদ।  


    গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকায় আমার আবাসস্থল এক হোটেল। প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল- এই ১০ তলা হোটেলের একমাত্র অতিথি এখন আমিই! এ শহরে বোধহয় এর চেয়ে বিশুদ্ধ হোম কোয়ারেন্টিনের সুবিধা আর পাওয়া সম্ভব নয়! ঢাকায় কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো খানিকটা অদ্ভুত তাই আমার জন্য- হোটেলবন্দী হয়েই কাটছে।

    এখানে আমার অবসরের বড় একটা অংশ কাটে কফিশপে। ধানমন্ডির এক কফিশপে আমার নিয়মিত যাতায়াত। ওই দালানের ঠিক পাশেই কিছু বাচ্চা মেয়ে প্রতিদিন ফুল বিক্রি করে। আমাকে দেখলে দ্বিগুণ উৎসাহে ছুটে আসে। হয়ত চামড়ার রঙটা একটু ভিন্ন বলে আমাকে নিয়ে তাদের এতো বিস্ময়। আমিও সাধ্যমত ওদের সহায়তার চেষ্টা করি। ব্যস্ত শহরে ওদের মুখগুলো দেখলে নিজের মেয়ের কথা মনে হত। এখন যতবার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ছে, ওদের কথাও মাথায় ঘুরছে। জানিনা, এই সংকটে তাদের খাবার জুটছে কি না।

    ৪ মাস বয়সী গাবি লেমোসকে সবশেষ দেখেছিলাম শেষ ডিসেম্বরে। এর পর বাংলাদেশে নতুন মৌসুম শুরু হলো, আমিও ফিরলাম আবাহনীতে। ফেডারেশন কাপ শেষ হওয়ার পর অবশ্য জানুয়ারিতে ছুটি মিলেছিল। তবে লিগের জন্য দল গোছাতে আমি সেবার থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন খানিকটা আফসোস হচ্ছে। তখন একবার ঘুরে এলে ছোট্ট গাবিকে এতোদিন না দেখে থাকতে হত না।


    গাবি লেমোসের ১০০ তম দিনে


    গাবির জন্মটাও এক অদ্ভুত সময়ে। গত মৌসুমের শেষদিকে আমরা বাংলাদেশের প্রথম দল হিসেবে এএফসি কাপের সেমিফাইনালে উঠলাম। প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়ার এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভ। ওই দলটাই মূলত উত্তর কোরিয়ার জাতীয় দল। এমন শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ম্যাচের ৪ দিন আগে আমার মেয়ে জন্ম। আমার মনে আছে, ওর জন্মের ৩ দিনের মাথায় সব মায়া ত্যাগ করে আমি ফিরে এলাম ঢাকায়। ৫ দিন দলকে অনুশীলন করালাম, ২১ তারিখে আমরা মুখোমুখি হলাম এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভের। ওরকম শক্ত প্রতিপক্ষকেও সেদিন ৪-৩ গোলে হারিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। মনে হয়েছিল, আমার মেয়ে আমার জন্য সৌভাগ্য বনে এনেছে।  

    আমার আসলে এখন ওর পাশেই থাকার কথা ছিল। প্রিমিয়ার লিগের সূচী অনুযায়ী এখন ক্লাব ফুটবলে দুই সপ্তাহের একটা ছুটি ছিল। এই ছুটিতে স্ত্রী ও মেয়ের কাছে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল আমার, ওরা সেখানেই থাকে। মার্চের ১৬ তারিখের বিমান টিকেটও কেটে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই তো করোনাভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই থেকে যেতে হয়েছে।


    আরও পড়ুন : ব্যাংকার থেকে 'বসুন্ধরার বুকে' | অস্কার ব্রুজোন


    একাকীত্বে মেয়ে আর স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে আরও বেশি। দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটছে তাদের সঙ্গে ফেসটাইমে যোগাযোগ করে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো। সেদিক দিয়ে কিছুটা নির্ভার থাকার সুযোগ আমার রয়েছে। আমার দেশ পর্তুগালেও অবশ্য জরুরী অবস্থা চলছে। বাবা-মা-ভাই-বোনরা আপাতত নিরাপদে আছে। তবে আমাকে নিয়ে তাদের শঙ্কাটা আঁচ করতে পারি আমি। হয়ত আমি বাংলাদেশে একা আছি বলেই মাথাব্যথা তাদের।

    আমাকে নিয়ে এই দুশ্চিন্তাটা শুধু আমার পরিবারের মধ্যেই সীমাবন্ধ নয়। হোটেল ম্যানেজার দুই-তিন দিন পরপর ফোনে যোগাযোগ করে খবর জানতে চাচ্ছেন। একটু মজা করে আবার ভূতের ভয়ও দেখাচ্ছেন। আমিও অবশ্য জবাব দিয়েছি, এএফসি কাপের সেমিফাইনালিস্ট কোচকে ভূতের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ভূতও পালাবে আমার ভয়ে!


    জানালা থেকে দেখা ঢাকা এখন বড্ড অপরিচিত


    আপনার মনে এখন একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে আমি জানি। এই পর্তুগিজ লোক একা একা খাচ্ছেটা কী? এবার আপনাকেও একটু আশ্বস্ত করি। শেফ, সিকিউরিটি গার্ড মিলিয়ে হোটেল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩-৪ জন লোক রয়ে গেছেন এখানে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বাড়তি কোনো ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না তাই। তবে সত্যি বলতে কী, চিকেন বিরিয়ানি খেতে খেতে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি।

    ২০১৮ সালে প্রথম ঢাকায় আসি। তখন ছিলাম জাতীয় দলের ট্রেইনার। জানতাম, এখানে অনেক মানুষ, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এটি। তবে নিজ চোখে দেখার আগ পর্যন্ত জনসংখ্যাটা কেবল মাত্র একটা সংখ্যাই ছিল আমার জন্য। ঠিক দুই বছর পর এখন জানালার ফাঁক দিয়ে যখন বাইরে তাকাচ্ছি, তখন একটা কেমন হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে মনে। এমন ফাঁকা শহর চেয়েছিলাম বটে, তবে এমন আতঙ্কের বিনিময়ে তো নয়! হর্নের যন্ত্রণায় কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার দায় হতো। সে শহরে এখন পিনপতন নীরবতা, হোটেল ম্যানেজার সে শহরে ভূতের ভয় দেখায়!

    অথচ আমি জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে এমন পরিবেশে। সেই আমার কাছেও এখন এটা বড্ড বেমানান লাগছে। এমন নয় যে শুধু মাত্র ঢাকার এই দশা। গোটা পৃথিবীই তো আসলে থমকে গেছে


    অথচ এই হলে কয়দিন আগেও ছিল কোলাহল


    এই ফুরসতটুকুর অবশ্য ভালো দিকও আছে। কোচিং নিয়ে আরেকটু ভাবার সময় পাচ্ছি। এমনিতে তিন-চারদিন পরই পরই নতুন নতুন প্রতিপক্ষকে নিয়ে ছক কষতে হয়। তাই কাজগুলো হয় অনেক বেশি তাড়াহুড়োর ভেতর। বলতে পারেন, প্রতিপক্ষকে বিশ্লেষণ করে সময় কাটছে আমার। কোন খেলোয়াড় কীভাবে ভাবে, তার শক্তিশালী দিক কোনগুলো- এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিচ্ছি বেশি। বিশ্বের প্রায় সব লিগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টিভিতেও খেলা নেই, কিন্তু ফুটবল তো আমার উপজীব্য। আমার মনে হয়, আবার সবকিছু শান্ত হলে, ফুটবলে ফিরে এই বিশ্রামটুকুর প্রভাব দেখা যাবে আমাদের খেলায়।

    শুধু ফুটবল নিয়েই আছি সেরকমটি আবার ভেবে বসবেন না। যেহেতু খেলা থেকে দূরে আছি, তাই দিনের ব্যপ্তি বেড়ে গেছে আমার জন্য। রাতে ঘুমাতে খানিকটা কসরতই করতে হচ্ছে। চেষ্টা করছি দিনের একটা সময় জিম করে ফিট থাকতে। দু’দিন  হলো রিচার্ড কার্লসনের একটি বইও পড়ছি। যদিও বইয়ের কথাগুলো  সঙ্গে বর্তমান সময়ের জীবনের ব্যাপক অমিল। ব্যস্ত জীবনে কীভাবে ছোট ছোট ঝামেলায় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে সেসব নিয়েই এই বই। আপাতত জীবনে তো কোনো ছোট ঝামেলা নেই! যা আছে সব বড় ঝামেলা।


    যেভাবে ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকছে অটুট


    শহরে লকডডাউন ঘোষণা করার পর এক সুপারশপে গিয়ে কিছু স্ন্যাকস আর কফি কিনে এনেছিলাম। নিজের হাতে বানানো কফি অবশ্য খুব বেশি ভালো হচ্ছে না। আর কেবল রুমবন্দী হয়ে থাকায় কফি পানের অভ্যাসও কিছুটা কমে গিয়েছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণের স্বভাবটা একটু বেড়েছে। সেটাও কাজের জন্য অবশ্যই। নিয়মিত আপডেট রাখছি, বাংলাদেশের সঙ্গে পর্তুগাল আর দক্ষিণ কোরিয়ার খবরটাও রাখতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে দিন পার করে ফেলছি এসব করেই।


    আরও পড়ুন: মরিনহো মুগ্ধতায় হাতেখড়ি, এর পর বাড়ি ফেরার লড়াই | আবাহনীর 'সুপার' মারিও


    পৃথিবীর এই অস্থিরতা আবার কবে কাটবে জানিনা। তবে যখনই কাটুক, আমি আবার এই শহরের জ্যামে আটকে বিরক্ত হতে চাই, ধূলো-বালি হোক আর কাদা মাঠ হোক- আমার ছেলেদের নিয়ে অনুশীলন করতে চাই। ধানমন্ডির সেই কফিশপের পাশের বাচ্চা মেয়েগুলির সেই চাহনি দেখতে চাই।

    তবে সবকিছুর আগে একবার গাবির সঙ্গে দেখা করতে চাই। সবশেষ যখন ওকে দেখেছিলাম, তখনও হামাগুড়ি দিতে পারত না। আর এখন বসতে শিখে গেছে। বড় হলে নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে ঢাকার সময়টা নিয়ে গল্প হবে।

    আর গল্প হবে এই কটা দিন নিয়ে, আলাদা করে।