• প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন
  • " />

     

    বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা, রুবেল... এবং একটি টার্নিং পয়েন্ট

    বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা, রুবেল... এবং একটি টার্নিং পয়েন্ট    

    সব থমকে গেছে যেন আপাতত। এ সময়ে প্যাভিলিয়নে প্যাভিলিয়ন সিরিজে আমরা মনে করেছি মাঠে বসে আমাদের দেখা স্মরণীয় ম্যাচের কথা। যেখানে চারপাশে উল্লাস বা স্তব্ধতা যাই থাকুক, ঘোরলাগা মুহুর্তের রেশ ছিল আমাদের। 


    সে বছর অক্টোবর মাসেও বৃষ্টির রেশ যাচ্ছে না। প্রতিদিনই একবার করে শুরু হয় বিরামহীন ক্রন্দন, মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণযজ্ঞকে থমকে দেয়, আমাদের মত সাইকেল আরোহীদের জীবনে তখন বারোটা বাজে! এর মধ্যেই সাত-সমুদ্দুর ওপারের নিউজিল্যান্ড দল দেশে পা রাখল। সংবাদ-সম্মেলনে ক্রিকেটের চেয়ে তখন বেশি মুখ্য নিরাপত্তা প্রসংগ, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও নিউজিল্যান্ডের মত দলকে খেলতে নিয়ে আসতে পারায় বিসিবিতে চাপা খুশির ফোয়ারা। আমাদের মত আম-আদমির অবশ্য নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে গুঞ্জরিত উত্তেজনা তখন আমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে- ‘তিন বছর আগে দেশের মাটিতে তামিম-মাশরাফি ছাড়া হোয়াইটওয়াশ করা গেলে এবার কেন নয়?’

    ২০১৩ গোটা বছরটাই কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে ঠেকে আমার কাছে। দড়ির পাকের মত বছর শুরুর আনন্দময় ছন্দ পর্যবসিত হয়েছিল নৈরাশ্যের পাকে, কিন্তু সে পাকটা ছিল অস্বাভাবিক দীর্ঘ! এর মধ্যে বেকার জীবন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্লাসে যাবার তাড়া নেই, সামনে পরীক্ষা জানি; কিন্তু সে পরীক্ষার তারিখ জানা নেই। ক্রিকেট তখন একমাত্র অক্সিজেন একটু বুক ভরে শ্বাস নেয়ার, ব্যাট-বল-মাঠের শব্দ তখন মস্তিষ্কের মাঝে আনন্দের একমাত্র অনুরণন। সেটা শুধু আমার একার জন্যেই নয়, দিন-রাত একসাথে কাটানো আমার দুই বন্ধুর ক্ষেত্রেও যেটা সত্যি। নিউজিল্যান্ড আসা মাত্রই তাই সিদ্ধান্ত নিলাম খেলা দেখতে হবে। ইউসিবিএলের গুলশান শাখায় ফজরের আজানের সময় ধরলাম লাইন। দো-প্রহর শেষে, এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে তিন বন্ধু যখন টিকিট হাতে পেলাম, মনে হল আনন্দপুরীর রোমাঞ্চ আমাদের কাছে। তবে একটা দুরূহ শংকা ছিল মনে- এর আগে মিরপুরের গোলাকার মঞ্চে প্রত্যেকবার গিয়ে হতাশ হয়েছি, প্রতিটা ম্যাচেই দেখেছি বাংলাদেশের বোলিংকে গুড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষ কোন না কোন ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি। ‘বাংলাওয়াশ’ এর মৃদু গুঞ্জন প্রথম ম্যাচেই থামিয়ে দিতে আমরাই আবার কালযজ্ঞহেতু না হয়ে যাই!
     


    অক্টোবরের শেষ কাল- সকালে এক পশলা বৃষ্টির পর দুপুরে উঠল খটখটে রোদ। রামপুরা থেকে সাইকেল যোগে মিরপুর পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর পেরিয়ে গেল। বন্ধুর ফুপুর বাসায় সাইকেল রেখে, রিকশা করে গোলচত্তর এসে, লম্বা লাইন মাড়িয়ে যখন স্টেডিয়ামে ঢুকে স্কোরকার্ডের দিকে তাকালাম, বুঝলাম কালযজ্ঞহেতু হওয়াই আমাদের কপালে আছে! দশ ওভারও খেলা হয়নি, এর মধ্যেই দুই ওপেনার সহ প্রথম তিন ব্যাটসম্যান সাজঘরে। সাকিব খেলছেন না কোন এক কারণে, মুঠোফোনে ইন্টারনেট সহজলভ্য নয় তখনো- তাই জানতেও পারি নি কেন তিনি দলে নেই! ক্রিজে তখন মুশফিক আর নাইম বলের পর বল ঠেকিয়ে যাচ্ছেন। জিমি নিশাম আর টিম সাউদির বলগুলো একটুর জন্যে ব্যাটের কানা না পেয়ে কিপারের হাতে জমা হচ্ছে। এতদিন পর ঠিক মনে নেই কিউইদের সটকে দেয়া বাঁধনটা কে আলগা করেছিলেন- শুধু মনে পরছে মুশি-নাইমের ২০ ওভার শেষে লড়াকু হয়ে উঠা। পুরনো হয়ে যাওয়া বলকে ব্যাটের আওতায় পেয়ে ক্ল্যাসিক সব কাভার ড্রাইভ, কাট, আর পুল। যোগ্য সেঞ্চুরিটা পেতে পারতেন দুজনই, কিন্তু ক্ষণিকের মনযোগহীনতায় দুজনই উইকেট বিলিয়ে এলেন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। ৩ উইকেটে ১৭৯ রান থাকলেও স্কোরবোর্ডে তাই ৫০ ওভার শেষে ২৬৫ এর বেশি উঠলো না। পূর্ণ হল না ৫০ ওভার কোটাও!

    খুব ভালো বোলিং না হলে এই ম্যাচে জেতার আশা অবান্তর! প্রতিপক্ষ দলে ফর্মে থাকা রস টেলর, কেন উইলিয়ামসন, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মত ব্যাটসম্যানরা। লোয়ার অর্ডারে জিমি নিশাম, কোরি অ্যান্ডারসনরা তখন রুদ্রমূর্তি হতে শুরু করেছেন। উইকেট খারাপ নয়, বল সুন্দর মত ব্যাটে বাংলাদেশের গোটা ইনিংস জুড়েই এসেছে। নিউজিল্যান্ড তাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেললেই এ ম্যাচ বাংলাদেশের আওতার বাইরে চলে যাবে। তবে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে এলে এসব কেন যেন ঠিক মাথায় খেলে না- যুক্তি তখন বিবেকের বাইরে থাকে, কিছু একটা হতেও তো পারে ভাব মাথার ভিতরে ঘুরপাক খায়। নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শুরু হতে না হতেই সোহাগ গাজীর আঘাত সে ধারণাকে আরো পোক্ত করে। আমরা প্ল্যাস্টিকের শক্ত আসনে আরো জড়সড় হয়ে বসি। চুপচাপ দৃষ্টিতে শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ড থেকে চোখ রাখি মিরপুরের মঞ্চে।


    ইয়াসির ইরফান : 'আপন' গ্যালারি, না দেখা ক্রিকেট আর রিচার্ড স্টোকস হওয়ার বাসনা


    গাজী উইকেট পেলেও রান দিচ্ছিলেন, আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন না রাজকীয় ছন্দে। এক প্রান্তে মাশরাফি আটকে রাখলেও বাংলাদেশের সেরা অস্ত্র স্পিনাররা ঠিক জুত পাচ্ছিলেন না। তখনই মঞ্চে এলেন মাহমুদউল্লাহ, প্রায় সেট হয়ে যাওয়া আরেক ওপেনারকে পাঠালেন প্যাভিলিয়নে। বলটা ঠিক কীভাবে ব্যাটের ফাঁক গলে উইকেটে আঘাত হেনেছিল, আড়াআড়িভাবে শহীদ মুশতাক স্ট্যান্ডে বসে সেটা বুঝিনি। শুধু মনে আছে একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম, আশেপাশের উন্মত্ত জনতার সাথে তাল না মিলিয়ে শুধু হাততালি দিয়েছিলাম। উইকেটে তখন এসেছেন রস টেলর, বাংলাদেশকে পেলেই যিনি ব্র্যাডম্যানীয় সিনড্রোমে ভুগতে শুরু করেন। একটা ভাল ব্যাপার ছিল কেন উইলিয়ামসনের অনুপস্থিতি, ফিল্ডিং এর সময় চোট পেয়েছিলেন তাই দুই উইকেট পড়ে গেলেও তিনি ক্রিজে আসেননি।

    আজ কিছু হলেও হতে পারে সে বিশ্বাসটা আরো পোক্ত করেছিলেন রুবেল হোসেন- টেলরকে মুশফিকের হাতে ক্যাচ বানিয়ে। দৃঢ়ভাবে মুষ্টিবদ্ধ হাত ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছে, স্টেডিয়াম কাঁপছে তখন হাজার মানুষের উচ্ছ্বাসে। কিন্তু সব উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিল বৃষ্টি। ধীরে শুরু হওয়া বৃষ্টি ধারণ করল মুষল রূপ, নিজেদেরকে আক্ষরিক অর্থেই মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ দলের রাস্তায় দাঁড়ানো কালো বিড়াল- অমঙ্গল বয়ে আনা ছাড়া যাদের আর কাজ নেই! অবশ্য একটা সান্ত্বনা ছিল- এবার তো অন্তত প্রতিপক্ষের ঝড় দেখতে হয়নি। নৈরাশ্যের ২০১৩ তে এই বা আমাদের জীবনে কম কিসের?


    অম্লান মোসতাকিম হোসেন : 'ফ্রম সুবর্ণ এক্সপ্রেস টু এমএ আজিজ স্টেডিয়াম'


     

    সে সন্ধ্যাটায় কি হয়েছিল প্রকৃতির কে জানে! মুষল বৃষ্টির মধ্যেই শুরু হল প্রবল বাতাস, মাঠের এক প্রান্তের কাভার উড়িয়ে এনে ফেলল গ্যালারিতে। আমাদের উপরে থাকা ছাদ অক্ষম প্রতীয়মান হল, বৃষ্টির তীব্র ছাট এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমাদেরও। তবে সে বাতাসেই মেঘ সরে উঠলো স্বস্তির সন্ধ্যাতারা, কর্মীদের অমানুষিক পরিশ্রমে মাঠ হয়ে গেল খেলার জন্য পরিষ্কার। নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ হল ২০৬, উইকেটে কোরি অ্যান্ডরসন, সাজঘরে জিমি নিশাম-ব্র্যান্ডন ম্যাককালামরা তৈরি।

    ক্রিজে নেমেই কোরি অ্যান্ডরসন শুরু করলেন তাণ্ডব! ব্যাটে লাগালেই বল উড়ে এসে পড়তে লাগলো গ্যালারিতে, এলিয়ট দিতে থাকলেন যোগ্য সঙ্গ। স্টেডিয়াম তখন নিশ্চুপ, আমরা ভিজে শার্ট নিয়ে লেপ্টে আছি চেয়ারের পিঠে। বল-রানের ব্যবধান কমছিল দ্রুত, হাতে সাত উইকেট নিয়ে এ ম্যাচ যে নিউজিল্যান্ডের হারার উপায় নেই সেটা স্পষ্টত বোধগম্য হচ্ছিল!
     


    ২০১৩’র অতল তিমিরে হাবুডুবু খাওয়া আমরা কতবার চেয়েছি কোন একটা মিরাকল আসুক আমাদের জীবনে! কৈশোর থেকে হটাত তারুণ্যের জীবনের ডামাডোলে পথ হারানো আমরা তখন কতশতবার প্রার্থনা করেছি কিছু একটা হবার জন্যে! জীবনকে তখন চিনছি কঠিনভাবে, নিষ্ঠুরতার নির্মমতা উপলব্ধি করছি প্রতি মুহুর্তে। ব্যর্থতাকে তখন স্বাভাবিকভাবে নেয়া শুরু করেছি, ক্রিকেট মাঠের এই হার এমন নতুন কি আর-‘এ তো খেলাই!’ তবে অদৃষ্টের বোধহয় ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের গোটা বছরের বিষাদকে এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় তিনি পূর্ণতা দিবেন বলে হয়তো ভেবে রেখেছিলেন। নইলে চরম আগ্রাসী কোরি অ্যান্ডরসন খামাখা রুবেলের সোজা আসা বলটা আড় ব্যাটে চালাতে গিয়ে বোল্ড কেন হবেন? কেন ঠিক পরের বলেই ম্যাককালাম মরা পিচে হঠাত উঠে আসা বলটা নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে গ্লাভসে লাগিয়ে পয়েন্টে হাই ক্যাচ তুলে দিবেন? কেনই বা নিশাম হ্যাট্রিক বলটায় ব্যাট ছুঁইয়ে দিবেন, আর মুশফিক বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বলটাকে মুঠোবন্দী করে আমাদেরকে তুলে দিবেন সপ্তম স্বর্গে? জিতার আশা নিয়ে এসেছিলাম ঠিক, কিন্তু চর্মচক্ষে সামনাসামনি হ্যাট্রিক দেখব সে স্বপ্ন ঘুণাক্ষরেও দেখি নি! ১২১/৩ থেকে ১২১/৬; ম্যাচটা কার্যত ঐ ওভারেই শেষ করে দিলেন রুবেল। নাথান ম্যাককালাম কিছুটা সময়ক্ষেপণ করলেও বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতলো ৪৩ রানে!

    ক্রিকেট কি জীবনের চাইতে বড়? অবশ্যই নয়। তবে ক্রিকেট-ফুটবল এবং যেকোন খেলার কিছু একটা সামর্থ্য আছে- চরম নৈরাশ্যে এটা কিছু এক ফুল ফোটায়। এজন্যেই হয়তো কোন ফুটবল ম্যাচের সময় অস্ত্রবিরতি চলে, কোন ক্রিকেট ম্যাচের সময় ভেদাভেদ ভুলে সবাই চোখ রাখে টিভি পর্দায়। একজন খেলোয়াড়ের কি যে সামর্থ্য থাকে খেলার মাঠের বাইরে এটা হয়তো অনেক খেলোয়াড় উপলব্ধি করার আগেই ক্যারিয়ার শেষ করে ফেলেন। তারা নির্বাক জীবনকে সবাক করতে পারেন, ক্ষুধার্ত কোন মানুষকে এক রাতের জন্যে হলেও ক্ষুধা ভুলানো আনন্দের ঘুম এনে দিতে পারেন, শত্রুতা ভুলিয়ে দিতে পারেন শুধু মাত্র একটা খেলায় জয় এনে দিয়ে। জীবনের চাইতে বড় না হলেও, খেলা কিছু অংশে কমও হয়তো নয়। এরপর পাকিস্তানকে ১৬ বছর পর হারাতে দেখেছি মাঠে। সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতে গিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয় দেখেছি বাউন্ডারি লাইনের পাশে বসে। কিন্তু আমার কাছে মাঠে দেখা সেরা জয় ঐ টাই- আমাদের জীবনে সে জয়টা দিয়েছিল আলোর সন্ধান, সে রাতে পাওয়া ক্রিকেটীয় স্বস্তি সঞ্চারিত হয়েছিল অন্যান্য ক্ষেত্রেও। রুবেলের জন্যে ঐ হ্যাট্রিক যেমন অনেক বেশি আবেগের, আমাদের ক্ষেত্রেও তাই!