• " />

     

    যতো কাণ্ড চীনে!

    যতো কাণ্ড চীনে!    

    ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ লুইস ফিলিপ স্কলারিকে এখন কোন দলের ডাগ আউটে দেখা যায় জানেন তো? গোয়াংজু এভারগ্রান্ডে। এই দলটিতে স্কলারির পূর্বসূরি কে বলতে পারেন? আরেক বিশ্বকাপজয়ী ইতালিয়ান কোচ মার্সেলো লিপ্পি! না, ক্লাবের নামটা পরিচিত না ঠেকলে নিজের ফুটবল জ্ঞান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ার কোন প্রয়োজন নেই। তবে জেনে রাখুন, অনাগত ভবিষ্যতে চীনের এমন কিছু ফুটবল ক্লাবের ‘আপডেট’-ও ভরিয়ে তুলতে পারে আপনার ফেসবুকের ‘নিউজ ফীড’!

     

     

    ব্যাপারটা এমন নয় যে, গোয়াংজুর মতো চীনা ক্লাবগুলো কোন কারণে রাতারাতি আলোচনায় চলে এসেছে। চেলসি কিংবদন্তী দিদিয়ের দ্রগবা, ফরাসী স্ট্রাইকার নিকোলাস এনেলকা, ব্রাজিলের বিস্ময় রবিনহো, পলিনহো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ছোট দলের বড় তারকা টিম কাহিলের মতো অনেক পরিচিত নামই ইউরোপ-আমেরিকার ক্লাব ছেড়ে চীনে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো।

     

     

    তবে ক্লাব ফুটবল মৌসুমের অন্তর্বর্তী দলবদলে হাতে গোনা ক’টি পরিচিত নামের বেশীরভাগই যখন চীনের ক্লাবগুলোতে নাম লেখান, তখন বিষয়টা ফুটবল দুনিয়ার টনক নড়াতে বাধ্য বৈকি! গত মাসে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার র‍্যামিরেজকে আড়াই কোটি পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসি থেকে দলে ভিড়িয়ে সাড়া ফেলে দেয় চীনা ক্লাব জিয়াংসু সানিং। আর চলতি মাসের শুরুতেই স্প্যানিশ জায়ান্ট অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের প্রথম একাদশের পরিচিত মুখ জ্যাকসন মার্টিনেজকে এশিয়ান রেকর্ড ৩ কোটি ১০ লাখ পাউন্ডে চুক্তিবদ্ধ করেছে স্কলারির গোয়াংজু এভারগ্রান্ডে।

     

    ওদিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী চেলসির ‘সম্ভাব্য বিদায়ী’ অধিনায়ক জন টেরিও পুরনো সতীর্থ র‍্যামিরেজের হাত ধরে চলতি মৌসুম শেষেই আরও একটি চমকে দেয়ার মতো চুক্তিতে ভিড়ে যেতে পারেন কোন চীনা ক্লাবেই!

     

    **********

     

    পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি গোটা দুনিয়ায় পরিচিত মূলত ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’-এর জন্য। ‘মেড ইন চায়না’ কোনো পন্য কোনো দিন ব্যবহার করে নি এমন মানুষ বোধকরি গোটা দুনিয়াতেই খুঁজে পাওয়া বিরল হবে! কিন্তু ফুটবলের মাঠে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশটির দাপট আজ অব্দি দেখা যায় নি। ফুটবলের বিশ্বকাপ চীনারা এ যাবত একবারই খেলেছিল, সেটিও ২০০২ সালে কোরিয়া-জাপান স্বাগতিক হওয়ার সুবাদে সরাসরি সুযোগ পেয়ে যাওয়ায়।

     

    কিন্তু সেবার গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ে যাওয়ার পরপরই ফুটবলের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনা হাতে নেয় চীনা সরকার। মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিভাবান ফুটবলারদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি শুরু হয় অবকাঠামোগত উন্নয়নও। স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম ফুটবল একাডেমী 'গোয়াংজু এভারগ্রান্ডে ইন্টারন্যশনাল ফুটবল স্কুল'। সমাজতান্ত্রিক দেশটির সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আনুকূল্য পেতে বড় বড় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে শুরু করেন ফুটবল বানিজ্যে। ইতিবাচক প্রভাবটাও স্পষ্ট হতে শুরু করে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর চায়নিজ ফুটবল লিগে। 

     

     

    আর বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিংয়ের ফুটবল-প্রেম চীনা ফুটবলে অর্থের ঝনঝনানিটা অনেক বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে আচমকাই। সুপার লিগের জন্য আগামী পাঁচ বছরের টিভি স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৮৩ কোটি পাউন্ডে, পূর্বের অংকের তুলনায় যেটি কিনা ৩০ গুণ বেশী! আরও জেনে রাখুন, ফুটবলার লেনদেনের বাজারে গত মৌসুমে অর্থের অংকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের পরপরই ছিল চায়নিজ লিগের অবস্থান!

     

    **********

     

    সময়টা ভালো যাচ্ছে না ব্রাজিল ফুটবলের। বলা হচ্ছে নিজেদের স্বর্ণযুগটা পিছনে ফেলে লম্বা এক সংকট কালে ঢুকে পড়ছে ফুটবল-তীর্থের দেশটি। নানা কারণে জাতীয় অর্থনীতির মন্দা প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে ঘরোয়া ফুটবলে। অর্থাভাবে খেলোয়াড়দেরও ছেড়ে দিতে শুরু করেছে বড় ক্লাবগুলো। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে নব্য ধনীদের খাতায় নাম লেখাতে শুরু চীনা কাবগুলো। এমন সব লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে যেগুলো ফিরিয়ে দেয়ার মতো ‘বোকামি’ করছে না ক্লাব কিংবা খেলোয়াড় কেউই। রবিনহো, পলিনহোদের পথ ধরে এলকেসন, র‍্যামিরেজ, অগুস্তো, গিল...চীনে পাড়ি জমানো ব্রাজিলীয়দের সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। এই মুহূর্তে চীনা লিগের ৫৬ জন বিদেশীর ১৮ জনই ব্রাজিলের।

     

     

    সেলেকাও ফুটবল অনুরাগীরা এই ভেবে দুশ্চিন্তায় ভুগতেই পারেন যে, এভাবে দলে দলে মানহীন একটি ফুটবল লিগে নাম লেখানোটা জাতীয় ফুটবলের দুর্দশার চিত্রটা আরও প্রকট করে তোলে কিনা! এসব লিগে খেলে এসে ফুটবলাররা জাতীয় দলকে কি দিতে পারবেন, সেটির চেয়েও বড় প্রশ্ন চীনা লিগের একজন খেলোয়াড় ব্রাজিলের মতো দলে সুযোগ পাবেন কিনা! অর্থের ঝনঝনানি যতোই থাকুক, মানের বিচারে ইউরোপের সাথে পাল্লা দিতে হলে যে চীনকে আরও বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

     

    চীনের একজন ফুটবল বিশেষজ্ঞ বলছেন সুপার লিগে আচমকা বেড়ে যাওয়া অর্থের প্রবাহটা কতোদিন থাকে সেটির উপরই অনেকটা নির্ভর করছে এই আয়োজনের ভবিষ্যৎ মান। আর অর্থের সেই প্রবাহ নির্ভর করছে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিশেষ করে আবাসন ব্যবসার গতিপ্রকৃতির উপর। অর্থনীতির সে জটিল হিসেবনিকেশ বিশেষজ্ঞরাই করুন, সাধারণ ফুটবল অনুরাগীরা বরং দলবদলের বাজারে চীনা ক্লাবগুলোর তরফে আরও কিছু চমকের অপেক্ষায় থাকুন!