• বুন্দেসলিগা
  • " />

     

    ডর্টমুন্ডকে ১২ গোল দিয়েও যেবার আফসোস করেছিল গ্লাডবাখ

    ডর্টমুন্ডকে ১২ গোল দিয়েও যেবার আফসোস করেছিল গ্লাডবাখ    

    বুন্দেসলিগার ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমের শেষ দিনটা নিছক আনুষ্ঠানিকতার হওয়ার কথা ছিল। শিরোপা নিষ্পত্তি হয়নি তখনও হয়নি। তবে এফসি কোলন যেমন ছন্দে ছিল তাতে লিগের শেষদিনে পয়েন্ট টেবিলের তলানীর দল সেন্ট পলির বিপক্ষে তাদের জয়টা অনুমিতই ছিল। সেন্ট পলি সেবারই প্রথম শীর্ষ স্তরে উঠে এসেছিল। আবার শেষদিনের আগেই তাদের রেলিগেশনও নিশ্চিত হয়ে ছিল। কোলনের জন্য সমীকরণ তাই সহজ, জিতলেই শিরোপা নিশ্চিত, না জেতারও কারণ নেই।  

    অবশ্য সহজ সমীকরণের আড়ালে একটা গাণিতিক হিসাবের মারপ্যাঁচ ছিল। শেষ ম্যাচের আগে শীর্ষে থাকা কোলনের পয়েন্ট ছিল ৪৫, দুইয়ে থাকা বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখেরও তাই। সমান পয়েন্ট নিয়েও কোলন এগিয়ে ছিল গোলব্যবধানে। সেই ব্যবধান যেন তেন নয়, গ্লাডবাখের চেয়ে পাক্কা ১০ গোল এগিয়ে ছিল কোলন। কোলনের তাই অন্য ম্যাচের কথা মাথায় রাখার দরকারও ছিল না। সপ্তাহ দুয়েক আগে তারা জার্মান কাপ ঘরে তুলেছে। ১৪ বছর পর আবারও বুন্দেসলিগার শিরোপা জয়ের হাতছানি তাদের সামনে। অপেক্ষা তাই শুধুই উৎসবের।


    ১৯৭৮ এর ২৯ এপ্রিল নিয়ম মেনে দুইটি ম্যাচই শুরু হলো একই সময়ে। গ্লাডবাখের প্রতিপক্ষ বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। আগের দেখায় ডর্টমুন্ডের মাঠে দুইদল ৩-৩ গোলে ড্র করে ফিরেছিল। মনশেনগ্লাডবাখের মাঠেই হওয়ার কথা ছিল ম্যাচটি। তবে নিজেদের স্টেডিয়ামে সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় মৌসুমের শেষ ম্যাচটিও তাদের খেলতে হয়েছিল ডুসেলডর্ফের অন্য মাঠ, রাইনস্টাডিওনে।

    তখনকার মনশেনগ্লাডবাখ অবশ্য জার্মান ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দল। আগের মৌসুমে অল্পের জন্য ইউরোপিয়ান কাপ হাতছাড়া হয়েছে তাদের। ফাইনালে লিভারপুলের কাছে হেরে জেতা হয়নি শিরোপা। শেষ ৩ বারের বুন্দেসলিগার চ্যাম্পিয়নও তারা। টানা চতুর্থবার শিরোপা জিততে ডর্টমুন্ডকে হারাতে হবে অন্তত ১১ গোলের ব্যবধানে, আর অন্যদিকে আবার পয়েন্ট খোয়াতে হবে কোলনকে। মনশেনগ্লাডবাখ খেলোয়াড়রা নিজেরাও শিরোপা ধরার স্বপ্ন দেখেননি। এমন সমীকরণ দেখলে অবশ্য লড়াই শুরুর আগেই দমে যাওয়ার কারণ বুঝতেও কষ্ট হয় না।

    মনশেনগ্লাডবাখ ম্যাচে প্রথম গোল করল ম্যাচের সময় ১ মিনিট পার হওয়ার আগেই। ইয়ুপ হেইঙ্কেস খুললেন গোলের খাতা। ৩২ মিনিট পার হতে হ্যাটট্রিক ও করে ফেললেন হেইঙ্কেস। আর সবমিলিয়ে ততক্ষণে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের জালে ৫ বার বল পাঠানো হয়ে গেছে মনশেনগ্লাডবাখের। বিরতির আগে আরও এক গোল যোগ, মনশেনগ্লাডবাখের আধ ডজন গোল দেওয়া হয়ে গেছে। অন্য ম্যাচে কোলন বিরতিতে গেল ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে। সেই হিসেবে পরের অর্ধে আরও আধ ডজন গোল দিলে শিরোপা মনশেনগ্লাডবাখের।  তখন আর কোনো কিছুই অসম্ভব মনে হচ্ছিল না।

    ডর্টমুন্ড আসলে একরকম খেলাই ছেড়ে দিয়েছিল। কোচ অটো রেহাগেল শেষ ম্যাচে মাঠে নামিয়েছিলেন দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক পিটার এন্ড্রুলাতকে। প্রথম গোলরক্ষক হোর্স্ট বার্তরাম চোটে পড়েছিলেন, সেরে উঠেছিলেন অবশ্য। তবে রেহাগেল চেয়েছিলেন শেষ ম্যাচে এন্ড্রুলাতকে একটা সুযোগ দিতে। ম্যাচের আগেরদিনই কোচ তাকে জানিয়েছেন, এটাই এখানে তার শেষ মৌসুম। এর পর চুক্তি নবায়ন হবে না এন্ড্রুলাতের।


    প্রথমার্ধে ৬ গোল হজম করার পর ‘বেচারা’ গোলরক্ষককে অবশ্য তুলে নিতে চেয়েছিলেন রেহাগেল। তবে এন্ড্রুলাত বলেছিলেন, তিনি ঠিকঠাক আছেন, বাকিটা সময় চালিয়ে নিতে পারবেন। তাই আর কোনো বদলিই করাননি ডর্টমুন্ড কোচ। পরে অবশ্য খানিকটা আফসোসি করেছিলেন এন্ড্রুলাত, “আমার আসলে উচিত ছিল সেদিন বদলি হয়ে যাওয়া। আমি নিশ্চিত বার্তরামও ৬ গোলই হজম করত। লোকে আসলে ভুলে যায় আমি ওই ম্যাচে ভালো কিছু সেভও করেছিলাম। অন্তত যেগুলো ঠেকানোর মতো ছিল আর কী!"

    পরের অর্ধে গুণে গুণে আরও আধ ডজন গোলই দিয়েছিল মনশেনগ্লাডবাখ। আর ডর্টমুন্ড ছিল শুন্যই। হেইঙ্কেস একাই দিয়েছিলেন ৫ গোল। ৯-০ তে এগিয়ে যাওয়ার পর মাঠের দর্শকরা আঙুল গুণছিলেন। আর লাগে মোটে ৩ গোল! হেইঙ্কেস সাইডলাইন থেকেই তাদের জবাব দিয়েছিলেন, “এই তোমরা কী পাগল নাকি? এসব হয় নাকি!”

    ওসব হলেও অবশ্য হতে পারত। ৬৬ মিনিটেই ১০-০ তে এগিয়ে ছিল গ্লাডবাখ। এরপর হুট করে থেমে গেল গোলমেশিন। বাকি সময়ে গ্লাডবাখ আর যোগ করতে পারল মোটে ২ গোল। আর কোলন বাকি সময়ে জাগল, আরও ৪ গোল দিয়ে শিরোপা নিশ্চিত তাদের। শেষ পর্যন্ত কোলন শিরোপা জিতল +৪৫ গোলব্যবধান নিয়ে। আর গ্লাডবাখ পিছিয়ে থাকল ৩ গোলে।

    ম্যাচের পর অবশ্য ডর্টমুন্ড খেলোয়াড়দের জন্য সমালোচনাটা প্রাপ্যই ছিল। ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগও উঠেছিল। গ্লাডবাখের ডেলহায় তো মোটামুটি একটি গোল দিয়েছেন হেঁটে হেঁটে। মাঝমাঠ থেকে দৌড় শুরু করে এগিয়ে গিয়েছিলেন, কোনো ডিফেন্ডার তাকে বাধাও দেননি। তিনিও কাউকে পরোয়া করেননি। ম্যাচে একটা সময় গ্লাডবাখ শুধু শট করেছে আর গোল পেয়েছে। বল বয় না থাকায়, যে শটগুলো বাইরে দিয়ে গেছে সেগুলো আবার রেফারি গিয়ে কুড়িয়ে এনে খেলা শুরু করেছেন। ম্যাচ পাতানোর গন্ধ না পাওয়াই তো বরং সন্দেহজনক। অবশ্য সে অভিযোগ বেশিদূর গড়ায়নি। তদন্তেও তেমন কোনো ইঙ্গিতও মেলেনি। ডর্টমুন্ডের জন্য শেষ ম্যাচটা ছিল শুধুই খেলার জন্য খেলা। সেজন্যই নাকি গা লাগায়নি তারা।

    ম্যাচ শেষে রেহাগেল হয়েছিলেন বরখাস্ত। আর ডর্টমুন্ডের ইতিহাসে ওই ম্যাচটা হয়ে আছে সবচেয়ে বড় ব্যবধানের হার। চতুর্থবারে শিরোপা হারিয়ে বুন্দেসলিগায় এর পর আর গ্লাডবাখের কখনও শিরোপাই জেতা হয়নি। এক ডজন গোলের জয়ে হেইঙ্কেসদের শেষের শুরুটা হয়েছিল সেদিন কোলনও এর পর আর শিরোপা ছুঁয়ে দেখেনি বুন্দেসলিগায়। অমন উত্তেজনার পর বোধ হয় শান্ত হতে লম্বা সময়ই লাগে!