• অ্যাশেজ ২০১৯
  • " />

     

    স্মিথ যেভাবে স্মিথ হলেন

    স্মিথ যেভাবে স্মিথ হলেন    

    মার্চ ২৪, ২০১৮। কেপটাউনে চলছিল অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার তৃতীয় টেস্ট। তৃতীয় দিন দ্বিতীয় সেশনের পর টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ল অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। পকেট থেকে সেই হলুদ রঙের বস্তু বের করে ডান হাত দিয়ে বল ঘষেছেন ব্যানক্রফট, টিভি ক্যামেরায় সেটি ধরা পড়েছিল গুঞ্জন উঠল, তাহলে ব্যানক্রফট কি বল টেম্পারিং করেছেন? ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী, বলের আকার বা আকৃতি পরিবর্তন করা যাবে এমন কিছু করা যায় না। আগের বছর ডু প্লেসির বিরুদ্ধে এরকম একটা অভিযোগ উঠেছিল। এমনিতে ক্রিকেটে টেম্পারিং নতুন কিছুও নয়। সব গল্প বলতে হলে এক দুইটি বই অনায়াসেই লিখে ফেলা যাবে। তবে সেদিনের ঘটনা একটু অন্যরকম ছিল। দুই আম্পায়ার ব্যানক্রফটকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন আলাদা করে, তবে মাঠে কিছু করেননি। বলও পরিবর্তন করেননি দুজন।

     

    বোমাটা ফাটল সংবাদ সম্মেলনে এসে। ব্যানক্রফটের সঙ্গে এলেন অধিনায়ক স্মিথও। স্বীকার করে নিলেন, স্যান্ডপেপার দিয়ে বল টেম্পারিংয়ের একটা চেষ্টা করেছিলেন তারা। পুরো অস্ট্রেলিয়া হতবিহবল হয়ে আবিষ্কার করল, তাদের অধিনায়ক প্রতারণা করেছে তাদের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বললেন, স্মিথকে সরিয়ে দেওয়া হোক অধিনায়কত্ব থেকে। স্মিথ আর ওয়ার্নারকে অধিনায়কত্ব ও সহ-অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে হলো সেদিনই। পরের দিন ঘোষণা এলো, এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন স্মিথ। তবে ব্যানক্রফটকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি।

    তবে অস্ট্রেলিয়ানদের অহমটা আহত হলো ভীষণভাবে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ঘোষণা দিল, তারা নিজেদের মতো তদন্ত চালিয়ে যাবে। স্মিথ আবিষ্কার করলেন, পায়ের নিচ থেকে একটু একটু করে মাটি সরে যাচ্ছে। সাবেক অনেক অস্ট্রেলিয়ান শাস্তির দাবি জানালেন। এমনিতেই খেলা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের আলাদা একটা গর্ব আছে, ইংল্যান্ডের মতো ক্রিকেটও তাদের কাছে কালিমাহীন একটা গর্বের জায়গা। সেখানে কালো দাগ লাগার পর স্মিথ আর ওয়ার্নারকে যাবজ্জীবন নিষিদ্ধ করার গুঞ্জনও উঠল। শেষ পর্যন্ত সেটা হলো না, তবে এক বছর করে নিষিদ্ধ হলেন স্মিথ-ওয়ার্নার-ব্যানক্রফট। একের পর এক বিজ্ঞাপন থেকে নাম কাটা গেল স্মিথের, আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হলো তার কাছ থেকে। কোচ ড্যারেন লেম্যানকে সরে যেতে হলো। পুরো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট যেন ভেঙে পড়তে শুরু করল তাসের ঘরের মতো।

     

     

    স্মিথ দেশে ফিরলেন, সিডনি বিমানবন্দরে মুখোমুখি হলেন সংবাদমাধ্যমের। প্রতিটা কথার সঙ্গে দমকে দমকে উঠছিল কান্নার বাষ্প। স্কুলে অপমানিত হওয়ার পর পুরোপুরি ভেঙে পড়া কিশোরের মতো স্মিথের কথা জড়িয়ে আসছিল। সেই কান্নাভেজা গলাতেই স্বীকার করলেন নিজের দায়, মাথা পেতে নিলেন নিজের সব দোষ। ‘লিডারশিপ গ্রুপের’ ভাবনা থেকেই কাজটা করেছিলেন তারা, সেটা যে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল স্বীকার করে নিলেন। কান্নার জন্য শেষ পর্যন্ত কথা আর শেষ করতে পারলেন না, বাবা পিটার এসে সরিয়ে নিয়ে গেলেন তাকে। ছোটকাল থেকে ছেলেকে শক্তপোক্ত করে মানুষ করেছেন পিটার, একটু চুপচাপ হলেও স্মিথ ঠিক দুর্বল ছিলেন না। কিন্তু সেদিন কোনো সান্ত্বনা দিয়েই ছেলেকে শান্ত করতে পারছিলেন না পিটার। বাবা-মার সম্মান রাখতে পারেননি, বার বার কথাটা বলছিলেন স্মিথ।

     

    **

    এরপর জীবন বদলে গেল অনেকখানিই। ম্যাচ পাতানোর মতো অপরাধের সঙ্গে বল টেম্পারিংকে মেলানো যাবে না কোনোভাবেই। কিন্তু অন্যায়ের প্রশ্নে একচুল ছাড় না দেওয়া অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে যে এই ভুলটাও একটা অপরাধ।কিন্ত প্রশ্ন তো আর চাপা থাকে না, কেন সেদিন ব্যানক্রফটকে নিয়ে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন স্মিথ? বল টেম্পারিং অবৈধ হলেও কাজটা যে তলে তলে চলে, সেটা তো ক্রিকেটে একরকম ওপেন সিক্রেট। বহু ক্রিকেটার কাজটা করেছেন, বিশেষ করে রিভার্স সুইং করানোর জন্য বলকে একটু বদলে ফেলার রীতি অনেক পুরনো। ‘বল বানানো’ যে একটা ‘শিল্প’, মোটামুটি পেশাদার ক্রিকেটারদের সবাই তা কমবেশি জানেন। কিন্তু বাইরে থেকে কোনো কিছু এনে সেটা ব্যবহার করার দুর্মতি কেন হলো স্মিথদের? আর হলোও বা যদি, সেটা স্বীকার না করলে হয়তো নিজেদের বোর্ড থেকে এত বড় শাস্তি পেতে হতো না। আইসিসি তো স্মিথকে বেশি শাস্তি দেনওনি। পুরো পরিকল্পনাটা ওয়ার্নারের, আর স্মিথই বা তাতে সায় দিলেন কেন? পুরো প্রক্রিয়ার পর প্রশ্ন ওঠে, স্মিথ কি ওয়াহ-পন্টিং-ক্লার্কদের যোগ্য উত্তরসূরি, অন্তত হাল না ছাড়া দেওয়া সেই দুর্দম অসি-মানসিকতার দিক দিয়ে? এক বছর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আদৌ কীভাবে ফিরবেন, সেই প্রশ্নও তো উঠেছিল। সেটার জবাব স্মিথ কীভাবে দিয়েছেন, সেটা বোধ হয় আপনার জানা থাকতে পারে। না জানা থাকলে অ্যাশেজে স্মিথের ইনিংসের হাইলাইটস ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন। ফেরা তো অনেক রকমই হয়, কিন্তু এমন দিগ্বিজয়ীর মতো ফেরা খেলাধূলার ইতিহাসেই আর হয়েছে কি না সন্দেহ। ‘ওয়ান ম্যান শো’ কথাও তো আসলে কম হয়ে গিয়েছিল তার জন্য।

    এজবাস্টনে দুর্দান্ত ১৪৪ রান দিয়ে শুরু, পরের ইনিংসে আবার করলেন ১৪২। সেই টেস্টে আক্ষরিক অর্থে একাই হারিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে, লর্ডসে পরের টেস্টে করলেন ৯২। এরপর আবার আরেকটা ধাক্কা, এবার অবশ্য নিজের কোন হাত নেই তাতে। জফরা আর্চারের বাউন্সারে লুটিয়ে পড়েছিলেন মাটিতে। ফিল হিউজের শোক-ভারাক্রান্ত অস্ট্রেলিয়া আরেকটি ট্র্যাজেডির ভার বইতে পারত না। স্মিথ বিশ্রামে গেলেন তৃতীয় টেস্টে, আর সুযোগটা নিয়ে হেডিংলিতে মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে ফেললেন স্টোকস। তবে স্মিথ ফিরলেন পরের টেস্টেই, এবার আরও দারুণভাবে। ডাবল সেঞ্চুরিতে নিশ্চিত করলেন, ভস্মাধার থাকছে অস্ট্রেলিয়ার কাছেই।

     

     

    প্রথমবার এই ইংল্যান্ডে এসে কত নাকানি চুবানি খেতে হয়েছিল তাকে। ২০১৯ সালে স্মিথের ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল না, তাঁকে আউট করা সম্ভব। অথচ তার আগের বছর প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে অসহ্য কষ্টের ভেতর দিয়ে। জাতীয় দল থেকে নির্বাসিত হয়ে খেলেছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে, বিপিএলেও খেলে গেছেন কুমিল্লার হয়ে- কিন্তু তাতে আর ব্যাগি গ্রিনে খেলার তৃপ্তি মিটে? টেনিস এলবোর চোটের জন্য যখন বিপিএল ছাড়লেন, তখন ডুবে গিয়েছিলেন বিষাদের অতলান্তে। একটা সময় নিজের মনে হয়েছিল, ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা যেন আগের মতো নেই। মুহূর্তের জন্য খেলা ছাড়া চিন্তাও এসেছিল মাথায়।অথচ সারাজীবন ক্রিকেট ছাড়া কিছু ভাবেননি। ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় সতীর্থেরা যখন অবসরে পুলে বা বারে সময় কাটাতেন, স্মিথের সময় কাটত টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখে।ভাগ্য ভালো, ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেননি। নইলে একজন ব্যাটসম্যান ২২ গজে কী করতে পারেন, এই যুগে এসে স্মিথ ছাড়া সেটা আর কে-ই বা বোঝাত?

     

    **

    ক্রিকেটে একটা কথা মোটামুটি প্রবাদের মতো হয়ে গেছে, ‘কখনো কখনো পরিসংখ্যান আস্ত একটা গাধা’। স্মিথকে বুঝতে হলে অবশ্য পরিসংখ্যান একটু সাহায্য লাগবেই। টেস্টে অন্তত ২০ ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানের মধ্যে স্মিথের চেয়ে বেশি গড় আর শুধু একজনেরই আছে কিছুদিন আগে ল্যাবুশেন টপকে গেছেন স্মিথকে)। স্যার ডনকে অবশ্য সব ধরনের পরিসংখ্যান থেকে বাদ দেওয়া উচিত, তাঁর কীর্তি ছিল এতোটাই অতিমানবীয়। সেটা হলে স্মিথের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো তো আর কেউ নেই। একটা সময় কোহলি, রুট আর উইলিয়ামসনের ফ্যাবুলাস ফোরের মধ্যে একটা জোর লড়াই চলছিল। টেস্টে অন্তত বাকি তিনজনকে ছাড়িয়ে চলে গেছেন স্মিথ। এক বছর নিষিদ্ধ থাকার পরও টেস্ট র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থান ফিরে পেতে স্মিথ খুব একটা সময় নেননি। তবে ওই যে, পরিসংখ্যান দিয়ে পুরোটা বিচার করা যাবে না!

     

    স্মিথের ব্যাটিং নিয়ে একটা কথা প্রায় নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায়, আর যাই হোক টেকনিকের দিক দিয়ে অন্তত কোচরা তাঁর মতো ব্যাট করতে বলবেন না কিশোর ক্রিকেটারদের। গতানুগতিক কোচিং ম্যানুয়ালের সঙ্গে যাঁর অনেক কিছু মেলানো যায় না, তাঁকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করানো তো কষ্টকর। অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন চিকিৎসক পিটার ব্রুকনার। তিনি বলেছিলেন, ১৩ বছর বয়সী একটা ব্যাটসম্যান যদি স্মিথের মতো ব্যাটিং করা শুরু করে তাহলে কোচ সাথে সাথেই বলে উঠবেন, ‘এভাবে নয়, এভাবে নয়। এরকম ব্যাটিং করলে বেশিদূর যেতে পারবে না তুমি।’ কথাটা আসলে মিথ্যে নয় মোটেই। স্মিথের ভাগ্য ভালো, জাতীয় দলে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে পেয়েছিলেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান কোচ মাইকেল ডি ভেনুটোকে। স্মিথকে তাঁর মতো করেই ব্যাট করতে বলেছিলেন। নিজের ধরন ঠিক রেখেই কিছু ছোটোখাটো পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলেন ভেনুটো। স্মিথের স্টান্সই তো আপনার ধন্দ জাগাবে, বোলাররা এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন- ওকে বল করার আসল লাইন কোনটা? এত দ্রুত শাফল করবেন স্মিথ, বোলারদের মনযোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাই নড়ে যায়। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে লারা বা টেন্ডুলকারসুলভ ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য হয়তো নেই। কিন্তু ভালোমতো খেয়াল করলে একটা ছন্দ ঠিকই টের পাওয়া যায়। এ যেন মধুসূদন দত্তের চতুর্দশপদী সনেটের মতো- কবিতার মধ্যেও একটা অদৃশ্য শৃঙ্খলা আছে। স্মিথের সবচেয়ে বড় সিক্রেট রেসিপি আসলে তার এই অন্যরকম টেকনিকটাই। সেজন্যই প্রতিপক্ষ বোলারদের কখনো ঠিক থিতু হতে দেন না, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেন তাদের। ২০১৯ অ্যাশেজই বোধ হয় সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাকিদের যখন শর্ট বলে জেরবার করে ফেলছেন জফরা আর্চার, স্মিথকে সেটা দিয়ে বধ করা যায়নি- সর্বোচ্চ আহত করা গেছে বরং। অ্যাশেজের পর অবশ্য নিজের তুলনায় ফর্ম খানিকটা পড়তির দিকে গেছে (পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৬ গড় স্মিথের জন্য অফ-ফর্মই), তবে সেসব নিজেও বেশিদিন মনে রাখতে চাইবেন না। স্টিভেন স্মিথকে আউট করা এখনও এই সময়ের টেস্ট বোলারদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।