• ফুটবল, অন্যান্য
  • " />

     

    ডেভিড বেকহ্যাম, আর্জেন্টিনা, নায়ক আর খলনায়ক

    ডেভিড বেকহ্যাম, আর্জেন্টিনা, নায়ক আর খলনায়ক    

    ব্রিটিশ সংস্কৃতির অন্যতম এক প্রতিচ্ছবি এখন ডেভিড বেকহ্যাম। বাকিংহাম প্যালেসে তার যাত্রা এখন নিয়মিত, অলিম্পিকের মশাল ধরেন তিনি, ইউনিসেফেরও দূত। বেকহ্যাম তার ফুটবলার পরিচয় ছাপিয়ে গেছেন বহু আগেই। এখন তিনি ব্যবসায়ী, ক্লাবের মালিক- সঙ্গে আরও কতো পরিচয়ে পরিচিত হন। পেছন ফিরে তাকালে ক্যারিয়ারটা তার পথটা মসৃণ মনে হতে পারে। অমন নায়কের মতো চেহারা আর হরেক রকম চুলের বাহার হয়তো ছাপিয়ে যেতে চায় অনেক কিছু। ম্যানচেস্টারের এক ছোকড়া বেকহ্যাম হয়ে উঠেছিলেন স্বমহিমায়- সে গল্পও ভুলে যেতে পারেন চাইলে।

    তবে ২০০২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয়টা এনে দিতে না পারলে বেকহ্যাম কি আজকের বেকহ্যাম হতে পারতেন?

    সম্ভবত উত্তরটা ‘না’ হওয়ারই কথা। সংবাদমাধ্যম একবার পেছন ধরে হ্যাঁচকা টান দিলে রাতারাতি জীবন কেমন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সেটা বেকহ্যামের ভালোই জানা। জশ-খ্যাতির চূড়ায় ওঠার আগে বেকহ্যাম সেসব দেখে এসেছেন।

    এতোদিন পর বেকহ্যামকে ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। সম্ভবত জবাব আসবে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ। আরও স্পষ্ট করে বললে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচটা, লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়াটা।
     


    ফ্রান্স বিশ্বকাপে বেকহ্যামের বয়স ছিল ২৩। ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছিলেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ততোদিনে জায়গা পোক্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু জাতীয় দলে তার সুযোগ মেলে না। ইংলিশ কোচ জেমস হাডলও বেকহ্যামকে খুব একটা পছন্দ করেন না। তার মতে বেকহ্যামের মনোযোগ নেই মাঠে। তার কাছ থেকে যা আশা করেন কোচ, বেকহ্যাম তা দিতে পারেন না। গ্রুপপর্বের প্রথম দুই ম্যাচ- তিউনিসিয়া আর রোমানিয়ার বিপক্ষে বেকহ্যাম দলের খেলা দেখলেন সাইডবেঞ্চ গরম করে।

    শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ কলম্বিয়া। আগের দুই ম্যাচে ৩ পয়েন্ট পাওয়া ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে হলে জিততেই হবে। সে ম্যাচে অবশেষে সুযোগ হলো বেকহ্যামের। একাদশে নামলেন, ম্যাচের আধ ঘন্টার ভেতর গোলও করলেন। তাও ফ্রি-কিক থেকে। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে করা ওই গোলের নাম “বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম”। যদিও এসব বিশেষণ তখনও যুক্ত হয়নি বেকহ্যামের নামের সঙ্গে।

    কলম্বিয়াকে ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত হারাল ২-০ তে, আর ইংল্যান্ড হলো গ্রুপ রানার্সআপ। দ্বিতীয় রাউন্ডে তাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা। সেই ১৯৮৬-এর আর্জেন্টিনা। এরপর আর দুই দেশের দেখাই হয়নি। ১৯৮৬ এর পান্ডুলিপি হাজির করে ইংলিশ মিডিয়া ততক্ষণে ফুঁসছে প্রতিশোধ স্পৃহায়। কিন্তু ছিয়াশির পর আটানব্বইতেও শেষ পর্যন্ত গ্লানিই জুটেছিল ইংল্যান্ডের। আর সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম।

    সেন্ট এতিয়েনে আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ডকে বিদায় করেছিল টাইব্রেকারে। আগেরবার খলনায়ক ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এবার খলনায়ক ইংলিশ পুত্র বেকহ্যাম নিজেই। ডিয়েগো সিমিওনে একেবারে শুরু থেকেই লক্ষ্য করে রেখেছিলেন বেকহ্যামকে। সিমিওনের বিচক্ষণতা সেই বয়সেও ছিল ইর্ষণীয় পর্যায়ে। বয়সে তরুণ আর বেকহ্যামের রগচটা ভাবটা বোধ হয় টের পেয়েছিলেন। সিমিওনে তাকে ঘিরে উৎপাত শুরু করেছিলেন একের পর এক ফাউল করে। ম্যাচের ৪৭ মিনিটেও আরেকটি ফাউল করেছিলেন। ম্যাচে ততোক্ষণে এমন ঘটনা সাধারণ হয়ে গেছে। রেফারিও ফ্রি কিকের বাঁশি বাজিয়েছেন।

    কিন্তু বেকহ্যামের ধৈর্য্য ততোক্ষণে লাগাম ছিঁড়েছে। মাটিতে পড়ে গিয়ে এক পা উঁচিয়ে সিমিওনে গুঁতো মেরে বসলেন। সিমিওনের জন্য ওইটুক ছোঁয়াই যথেষ্ট। মাটিতে পড়ে তিনিও কাতরাতে থাকলেন। রেফারি ফ্রি-কিক দিতেই ওদিকটায় দৌড়ে আসছিলেন, মাঝমাঠের ওই নাটকের প্রথম দর্শক তিনিই। চার দিন আগের ইংল্যান্ডের জার্সিতে প্রথম গোল করা বেকহ্যামকে এরপর ড্রেসিংরুমের পথ ধরালেন রেফারি।

    ম্যাচে তখন সমতা ছিল ২-২ এ। বাকি সময় ইংল্যান্ড একজন কম নিয়েই শেষ করল। খেলাও গড়াল টাইব্রেকারে। নিয়ম মাফিক তাতে হেরে যাওয়াদের দলে ইংল্যান্ড। বেকহ্যামের লাল কার্ডের মাহাত্ম্য বাড়ল ওই বিদায়েই। কোচও ম্যাচ শেষে আগুনে ঘি ঢাললেন লাল কার্ডের ঘটনায় দোষ চাপিয়ে। বাকি কাজের জন্য ইংলিশ মিডিয়া তো ছিলই।


    ডেইলি মিরর শেষ পাতায় পাঠকদের জন্য একটা ডার্টবোর্ডই ছাপিয়ে দিল। বেকহ্যামের ছবি থাকল একেবারে মাঝে। বাকিরাও তাদের সৃজনশীলতার ছাপ রেখে বেকহ্যামকেই দুষলেন। এক ২৩ বছর বয়সী রাতারাতি হয়ে গেলেন ইংল্যান্ডের ভিলেন নাম্বার ওয়ান। যে মাঠেই বেকহ্যাম যান, দুয়ো শোনেন। ২০০০ ইউরো পর্যন্ত বিরতিহীন চলল সেই দুয়ো। সমালোচনার বিস্তৃতি এতদূর গেল যে সেই ইংলিশ মিডিয়াকেই আলাদা কলাম ছেপে অনুরোধ করতে হলো, “আপনারা দুয়ো বন্ধ করুন।”

    লাগামহীন সমালোচনা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থামানো গেলে অবশ্য মন্দ হত না। আদতে তা হয় না। ফুটবলার হলে জবাব দিতে হয় পায়ে। আর লাগে একটা মঞ্চ। বেকহ্যাম অধিনায়ক হওয়ার পরও তাই দুয়ো থামেনি। হাইবুরি থেকে এলান রোড- যেখানেই যান বেকহ্যামের কপালে জোটে একরাশ তিক্ততা। ওল্ড ট্রাফোর্ডেই শুধু ধীর স্থির হয়ে পায়ের কারিকুরি দেখানোর সুযোগ মেলে।

    মাঝে মধ্যে ভাগ্যের সাহায্যও বোধ হয় লাগে খানিকটা। ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ইংল্যান্ডের শেষ ম্যাচটাও পাকে চক্রে পড়ল ওল্ড ট্রাফোর্ডেই। বিশ্বকাপে খেলতে হলে ইংল্যান্ডের দরকার হার এড়ানো। সভেন গোরান এরিকসনের দল ওল্ড ট্রাফোর্ডে শেষটা প্রায় দেখেও ফেলেছিল। ২-১ এ হারতে থাকা ম্যাচে একেবারে অন্তিম মুহুর্তে ২৫ গজ দূর থেকে ফ্রি-কিক পেল ইংল্যান্ড। ওই মঞ্চটাই দরকার ছিল বেকহ্যামের।

    “কামেথ দ্য আওয়ার, কামেথ দ্য ম্যান”- সময় যতই বিপরীতে থাক, এমন একজন আসবেন যিনি সবকিছু জয় করে নেবেন। ইংল্যান্ডকে সেদিন ফ্রি-কিক থেকেই বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেই বেকহ্যাম। বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম সেই প্রথম জুড়ল তার নামের সঙ্গে। আর ইংল্যান্ডের মেসাইয়াহ ইংল্যান্ডকে নিয়ে গেলেন বিশ্বকাপে। সান্তিয়াগো মুনিয়েজ সিনেমার পান্ডুলিপিতে থাকেন, আর বেকহ্যামরা প্রমাণ করেন, বাস্তবতা সিনেমাকে হার মানায়। 

    ডিসেম্বরে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে আবার এক গ্রুপে ইংল্যান্ড আর আর্জেন্টিনা। সুইডেন, নাইজেরিয়া গ্রুপের বাকি দুই দল। গ্রুপ অফ ডেথ নাম হয়ে গেল ড্রয়ের দিনই। আর বেকহ্যাম ড্র দেখে বললেন, “আমি আসলে ৭ জুনের জন্য অপেক্ষা করছি।”

    ৭ জুনের অপেক্ষায় থাকা বেকহ্যাম অবশ্য আরেকটু হলেই বিশ্বকাপ মিস করতে বসেছিলেন। এপ্রিলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলতে গিয়ে পায়ে মেটাটারসাল ভাঙলেন। যার ট্যাকেলে পা ভাঙল, তিনি আবার আর্জেন্টাইন। দেশাত্মবোধের রসদের অভাব নেই।  আর ইংল্যান্ডে তো তখন নায়ক বেকহ্যাম, তিনি খেলতে পারবেন কি পারবেন না- সেই খবর ইংলিশ পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে আর  সরেই না।

    সংশয় কাটিয়ে বেকহ্যামের নাম বিশ্বকাপ স্কোয়াডে দেখে হাঁপ ছেড়েছিল ইংলিশরা। হাঁপ ছেড়েছিলেন বেকহ্যামও। তার শাপমোচন তো বাকি তখনও। প্রথম ম্যাচে সুইডেনের সঙ্গে ড্র করল ইংল্যান্ড, আর আর্জেন্টিনা পুরো ৩ পয়েন্ট নিয়ে নামল দ্বিতীয় ম্যাচে। আর্জেন্টিনার কাছে হার মানে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়।


    জাপানে খেলার ফল নির্ধারণ হলো এক পেনাল্টিতে। মাউরিসিও পচেত্তিনো ফাউল করেছিলেন মাইকেল ওয়েনকে। পেনাল্টি আর কে নেবেন? বেকহ্যামই নিলেন। মারলেন মাঝামাঝি জায়গায়। বেকহ্যাম এমন কিক মারার লোক নন। আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক পাবলো কাভায়েরো জায়গা থেকেই নড়তে পারেননি। নইলে হয়ত ঠেকিয়েও দিতে পারতেন বেকহ্যামের শট। বেকহ্যাম কতোখানি চাপে ছিলেন ওই কিক তার প্রমাণ।

    গোলের পর বেকহ্যাম দৌড়ালেন কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। জার্সিতে চুমু খেলেন, স্বপ্ন সত্যি হলে বোধ হয় মুহুর্তের জন্য তালগোল পাকিয়ে যায় সব কিছু। বেকহ্যাম হয়ত ভেবেও রেখেছিলেন কীভাবে উদযাপন করবেন গোল, কিন্তু ওই মুহুর্তে কোনোকিছুই আর কাজ করেনি।

    ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ড মেতেছিল বিশ্বজয়ের আনন্দে। ১৯৬৬ এর পর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে প্রথম জয়। এর মাঝে ঘটেছে ম্যারাডোনার ঈশ্বরের হাত, বেকহ্যাম রেড হ্যান্ড-  ইংলিশদের উদযাপনটা অনুমিতই ছিল। অনুমিত ছিল না আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়াটা। আর্জেন্টিনাকে বিদায় দেওয়ার বড় কাজটা করে রেখেছিলেন বেকহ্যামই। সেদিন মাঠে সিমিওনেও ছিলেন, ম্যাচ শেষে বেকহ্যামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়েছিলেন তিনি। এই বেকহ্যামের সঙ্গে আর কুটবুদ্ধিতে কাজ হবে না- সিমিওনে সেটা চার বছর পরের বিশ্বকাপে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন।

    আর বেকহ্যাম? বেকহ্যাম এরপর ছুটেছেন। জীবনের প্যাঁচ একবার খুলে গেলে বোধ হয় এভাবেই ছোটা যায়।