• ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফর ২০২০
  • " />

     

    ১২ দেশের টেস্ট 'মর্যাদা' : অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের 'অজানা' থেকে বাংলাদেশের 'ব্যক্তিগত' গল্প

    ১২ দেশের টেস্ট 'মর্যাদা' : অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের 'অজানা' থেকে বাংলাদেশের 'ব্যক্তিগত' গল্প    

    ২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট স্ট্যাটাস বা মর্যাদা পেয়েছিল বাংলাদেশ। আইসিসির ১০ম পূর্ণ সদস্য ছিল তারা। ১৮৭৭ সালে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, তবে তখন ‘মর্যাদার’ প্রশ্নই ওঠেনি। ধীরে ধীরে সামনে এসেছে সেটি। সামনে এসেছে একে একে আরও ১০টি দেশ। সেসব দেশেরই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার এবং না পাওয়ার গল্প...


    অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড
    টেস্ট ক্রিকেট? 

    শুধু ক্রিকেটের নয়, খেলার জগতেরই তিনি প্রথম ‘তারকা’ ছিলেন বলা যায়। কোনও খেলোয়াড় কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপন করেছেন, এমন ইতিহাসও বোধহয় সবার আগে তিনিই গড়েছিলেন। তিনি ব্যাটিংকে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন ফুটওয়ার্ক চালু করে। 

    ডব্লিউ জি গ্রেসের জন্য তিনটি বাক্য কি যথেষ্ট? না। তার ছবির ক্যাপশন লেখার জন্যও হয়তো আগের কয়েক শব্দ যথেষ্ট নয়। তবে সেই গ্রেস ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলেননি। খেলবেন কীভাবে, গ্রেস তো জানতেনই না যে পৃথিবীর ওপ্রান্তে একটা টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে। অবশ্য যে ২২ জন সেদিন ভিক্টোরিয়ার রাজধানী মেলবোর্নের এমসিজিতে খেলছিলেন, তারাই কীবা জানতেন! টেস্ট ক্রিকেটের শুরুটা ছিল এমনই। 

    ১৮৭৭ সালের আগেই ইংল্যান্ড থেকে ক্রিকেট দল সফর করা শুরু করেছে, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছে তারা চারবার। তবে সেবার জেমস লিলিহোয়াইটের নেতৃত্বে যাওয়া দলটা একটু ব্যতিক্রমী ছিল, তারা গিয়েছিল ব্যবসায়িক ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে। এই প্রথম ইংল্যান্ড থেকে কোনও দল অস্ট্রেলিয়া গেল, যেখানে কোনও ‘জেন্টলম্যান বা শৌখিন’ ক্রিকেটার নেই, সবাই ‘পেশাদার’। যতো বেশি ম্যাচ, তত বেশি টাকা।

    অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা এর আগ পর্যন্ত এতোটাই দূর্বল ছিলেন, মাঝে মাঝে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ জন খেলতে নামতেন। আলফ্রেড শ একবার নিউক্যাসেলের বিপক্ষে ৫০ রানে নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট, ১ ইনিংসেই। তবে তারা উন্নতি করছিলেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে ম্যাচ খেলার পর ইংল্যান্ডের সেই দল গেল নিউজিল্যান্ডে। ১২ জনের স্কোয়াড ছিল, তারা অস্ট্রেলিয়া ফিরলেন ১১ জন নিয়ে। উইকেটকিপার টেড পুলি জুয়ার গ্যাঁড়াকলে পড়ে আটকা পড়লেন ক্রাইস্টচার্চের কারাগারে। 
     


    প্রথম টেস্টে সদস্য ছিলেন এরা ইংল্যান্ড স্কোয়াডের/ক্রিকইনফো


    ১৫ মার্চ মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নামলো ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলসের সমন্বিত একাদশ। ২৪ ঘন্টাও হয়নি, লিলিহোয়াইটের দল এসে পৌঁছেছে তখন অস্ট্রেলিয়ায়। ১০টায় খেলা শুরু হবে ভেবে দর্শকরা এলেন, খেলা শুরু হলো ১.০৫-এ। প্রথম বলটা ফেস করলেন চার্লস ব্যানারম্যান। অস্ট্রেলিয়ার সমন্বিত একাদশের ইনিংসে আর কেউ ২০ পেরুতে পারলেন না, ব্যানারম্যান করলেন ১৬৫। আউট হলেন না, তর্জনী ফেটে গিয়ে উঠে যেতে হলো। দলের ৬৭.৩৪ শতাংশ রান একাই করেছিলেন এই ডানহাতি। ব্যানারম্যান এর আগে-পরে প্রথম শ্রেণিতে আর কোনও সেঞ্চুরি করেননি। 

    ২য় ইনিংসে ১৫৪ রানের লক্ষ্যে ১০৮ রানে থামলো লিলিহোয়াইটের দল। যে ম্যাচে প্রথম বলটা করেছিলেন আলফ্রেড শ, প্রথম বল খেলেছিলেন ব্যানারম্যান, সেঞ্চুরিও করেছিলেন তিনি। প্রথম ৫ উইকেট নিয়েছিলেন বিলি মিডউইন্টার। প্রথম স্টাম্পিং করেছিলেন জ্যাক ব্ল্যাকহ্যাম। সে ম্যাচের সময় জেমস সাউথার্টনের বয়স ছিল ৪৯ বছর ১১৯ দিন। তারা সবাই ঢুকে গেছেন ইতিহাসে।

    দলের সবচেয়ে বেশি শতাংশ রানের ব্যানারম্যানেরটা বা সাউথার্টনের সবচেয়ে বেশি বয়সে অভিষেকের রেকর্ডটা টেস্ট ক্রিকেটে টিকে আছে এখনও। 

    ১৮৯৮ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট নামের এক বই লিখেছিলেন ক্ল্যারেন্স মুডি নামের এক ক্রীড়া-সাংবাদিক, যিনি সাউথ অস্ট্রেলিয়ান রেজিস্টারে লিখতেন ‘পয়েন্ট’ ছদ্মনামে। সেই বইয়ে তখন পর্যন্ত খেলা ‘টেস্ট ম্যাচ’-গুলির এক তালিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তখন লর্ডসের এমসিসি বা মেলবোর্নের এমসিসি- মুডি কাজ করতেন না কারও হয়েই। 

    যদি ইংল্যান্ডের দুটি দল একই সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া সফরে থাকে, এমন পরিস্থিতিতে তাহলে কারও ম্যাচকেই টেস্টের ‘মর্যাদা’ দেননি তিনি। ১৮৭৮ সালে এমসিসির বিপক্ষে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া, সেটিও মুডির তালিকায় প্রকাশ পায়নি। 

    তার তালিকার প্রথমে ছিল ১৮৭৭ সালের ১৫-১৯ মার্চ হওয়া সেই ম্যাচ। প্রথম টেস্ট। 

    গ্রেস যদি জানতেন! 


    আরও পড়ুন-- ঈশ্বরের ক্রিকেট, শয়তানের অ্যাশেজ 

     

    দক্ষিণ আফ্রিকা
    সেই শূন্যতার আগে-পরে 

    ১৮০৮। কেপ কলোনি। এখনকার দক্ষিণ আফ্রিকা। 

    কেপটাউন গ্যাজেটে ক্রিকেট ম্যাচের বিজ্ঞাপন। ১৮৪৩ সালে পোর্ট এলিজাবেথের নিজস্ব ক্রিকেট ক্লাবও হয়ে গেল। সেই শতকেও ক্রিকেট ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে গায়ের রঙের বিভেদ ছিল তখনও, ক্রিকেটকে রাখা হতো ‘সাদা’দের মাঝেই। তবে আফ্রিকান বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী ক্রিকেট খেলছে, খবর আসতো এমন। 

    ১৮৮৯ সালের মাঝে নিজস্ব প্রথম শ্রেণির কাঠামো পেয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। সঙ্গে টেস্ট খেলার ‘অধিকার’। সে বছরের ১২ মার্চ চার্লস অরব্রি স্মিথের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্কে নিজেদের প্রথম টেস্টও খেলে ফেললো তারা। অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকানরাও তখনও জানতেন না তারা টেস্ট খেলছেন, মুডি তো তখনও সেই ‘শ্রেণিবিভাগ’ করেননি। 

    ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে যান ১৯৬১ সালে। কমনওয়েলথের সদস্যপদ হারালো দক্ষিণ আফ্রিকা। আইসিসিরও। তবে তারা টেস্ট খেলতে লাগলো। ভারত-পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে নয়, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে, তারা যে একই ক্লাবের সদস্য-- যারা আন্তর্জাতিক টেস্ট চালু করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে অলিম্পিক থেকে নিষিদ্ধ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৬৬ ফুটবল বিশ্বকাপে থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকা একসময় শুধু মাত্র শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে দল গঠন করা শুরু করলো। 
     


    ব্যারি রিচার্ডস : অজানা গল্প


    ১৯৬৬-৬৭ সালে অস্ট্রেলিয়া গেল দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিন বছর পর আবার। এর মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেনি কোনও সিরিজ। আগেরবার অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল ৩-১ ব্যবধানে, এবার হারলো ৪-০তে। 

    দক্ষিণ আফ্রিকার দল তখন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারে যাকে বলে ঠাসা। এডি বার্লোর ব্যাটিংয়ের গড় ৪৫.৭৪, বোলিংয়ে ৩৪.০৫। ট্রেভর গোডার্ডের ৩৪.৪৬ ও ২৬.২২। মাইক প্রোক্টরের ২৫.১১ ও ১৫.০২। এরপর গ্রায়েম পোলক। কমপক্ষে ২০০০ রান করে ৬০-এর ওপরে গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান তিনি ইতিহাসের। ব্যারি রিচার্ডসের গড় পোলকের চেয়েও বেশি-- ৭২.৫৭। তবে রিচার্ডস ম্যাচ খেলেছেন ৪টি। পোলক ২৩টি। প্রোক্টর খেলেছিলেন ৭টি। বার্লো সুযোগ পেয়েছিলেন ৩০ ম্যাচ খেলার। 

    রিচার্ডসের যে সিরিজে অভিষেক, সে সিরিজের পর ২২ বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেনি আর দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৭০ সালের সেই দক্ষিণ আফ্রিকা দল কেমন ছিল, সেটির আভাস পেলেও আর জানা হয়নি কারও।  

    সেই প্রথম টেস্টের প্রায় ৮০ বছর পর, সেই পোর্ট এলিজাবেথের ওই মাঠেই থমকে যেতে হয়েছিল তাদের, বর্ণবাদের দায়ে তাদের নিষিদ্ধ করলো আইসিসি। দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের লিম্বো-তে চলে গেল, প্রায় ২২ বছর। যে লিম্বোতে পড়ে হারিয়ে গেলেন গ্রায়েম পোলকরা। 

    ১৯৯২ সালের ৫ এপ্রিল বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে আরেকবার টেস্ট খেলতে নামলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ‘মর্যাদা’ ফিরে পেলো তারা আরেকবার। 

    প্রক্টর বলেছিলেন, “আমরা ২২ বছর না খেলাতে যদি ৪৪ মিলিয়ন মানুষের জীবনের একটু উন্নতি হয়, তাহলে ক্ষতি নেই।”

    ক্ষতিটা আদতে কার ছিল?  


    আরও পড়ুন-- নো কান্ট্রি ফর ওল্ড গ্রাউন্ডস

     

    ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ভারত-নিউজিল্যান্ড 
    ‘আইসিসি’ এবং আরও তিন 

    যে আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করেছিল, সে সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন একজন দক্ষিণ আফ্রিকান। 

    ১৯০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিল ইংল্যান্ড সফরে, ততদিনে খেতাব পাওয়া ‘অফিশিয়াল টেস্ট’ও ছিল সে সফরে। সে সফরে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যাবি বেইলি। ৩০ নভেম্বর এমসিসির সেক্রেটারি এফই লেসিকে একটা চিঠি লিখলেন বেইলি, যতোদিনে দক্ষিণ আফ্রিকা ঘরে ফেরার পথে। সে চিঠিতে একটা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি, যার নাম হবে ‘ইমপেরিয়াল ক্রিকেট বোর্ড’। যেটি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝে সফরগুলির জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করবে। ১৯০৯ সালে এই তিন দেশকে নিয়ে একটা ‘ত্রিদেশীয় টেস্ট সিরিজ’ আয়োজনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন বেইলি। তবে অস্ট্রেলিয়া আর্থিক কারণে রাজি হয়নি, তাদের সফরের ভাগ দিতে চান না তারা। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯০২ সালেই টেস্ট খেলে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। 

    ১৫ জুন, ১৯০৯ সালে তিন দেশের প্রতিনিধিকে নিয়ে মিটিং করলেন এমসিসির চেয়ারম্যান, ‘দ্য আর্ল অফ চেস্টারফিল্ড’। এর মাসখানেক পর লর্ড হ্যারিসের নেতৃত্বে আরেকটা মিটিং হলো, সেখানেই সিদ্ধান্ত এলো ১৯১২ সালে ত্রিদেশীয় টেস্ট সিরিজ আয়োজনের, সঙ্গে কোন দল কোথায় সফর করবে তার একটা নীতিমালা গঠনের। 

    তবে বাজে আবহাওয়া আর অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি হওয়া ঝামেলার কারণে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান ক্রিকেটাররা সে সফরে এলেন না। ত্রিদেশীয় সিরিজ সাফল্যের মুখ দেখলো না। ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট বোর্ডও থমকে গেল, প্রায় ৯ বছরের জন্য। ১৯২১ সালে আরেকদফা মিটিং হলো তাদের, এবার আলোচনা ছিল ৮ বলের ওভার নিয়ে। এরপর আরও ৫ বছর চুপচাপ তারা।  

    এর মাঝে এমসিসি দল পাঠিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে, সেটিও হয়েছিল লর্ড হ্যারিসের উৎসাহেই। এর আগে ত্রিনিদাদে ছিলেন তিনি। জর্জটাউনে এমসিসির দলকে প্রায় হারিয়ে দিতে বসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইম্পেরিয়ারল বোর্ডের পরের মিটিংয়ে ডেকে পাঠানো হলো তাদের প্রতিনিধিদের। 

    সঙ্গে ভারত, নিউজিল্যান্ড থেকেও প্রতিনিধি এলেন। তিন দলকেই দেওয়া হলো টেস্ট মর্যাদা। 
     

    আরও পড়ুন-- ক্রিকেট-ধর্মের দেশের প্রথম সব টেস্ট


    ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঠিক দেশ নয়, তবে যেসব দেশ নিয়ে গঠিত-- সেগুলো কমনওয়েলথের সদস্য। ১৮০৬ সালের দিকে সেখানে ক্রিকেট শুরু হয়েছিল, এমন জানা যায়। শুরুতে কৃষ্ণাঙ্গদের তেমন প্রবেশাধিকার ছিল না ক্রিকেটে, তবে ক্রিকেট তাদের আকৃষ্ট করেছিল। সিএলআর জেমস তার ‘বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি’তে লিখেছেন, কীভাবে বাল্যবয়সে ইংলিশ শুদ্ধাচার, ইংলিশ সাহিত্য আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাস্তবতা মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল তাকে। 

    জেমসের মতো অনেকেই ক্রিকেটকে বেছেছিলেন। তবে সেটি ছিল তাদের একটা জবাব দেওয়ার উপায়ও। ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজরা ইংলিশদের বিপক্ষে খেলার সময় এটা মনে করতেন, ‘সাবেক প্রভু’দের বিপক্ষেই তারা খেলছেন, যে মাঠে সবাই সমান। যেখানে সবাই সমান, সেটির চেয়ে কোনও কিছুর জবাব দেওয়ার মোক্ষম আর কোন ক্ষেত্রই বা থাকতে পারে! 

    নিউজিল্যান্ডেও ক্রিকেট ছিল আগে থেকেই। ১৮৩৫ সালে সেখানে গিয়ে চার্লস ডারউউইন দেখে এসেছিলেন, ক্রিকেটের ‘বিবর্তন’ ঘটছে সেখানে। মাওরিরাও খেলতেন, ১৮৯৪ সালে নিজেদের ঘরোয়া লিগের পর ১৯০৬ সালে প্রথম শ্রেণির প্রতিযোগিতা প্লাঙ্কেট শিল্ডও শুরু করেছিল তারা। অবশ্য নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটাররা দূর্বল ছিলেন, ২২ জন নিয়েও পেরে উঠতেন না ইংলিশদের সঙ্গে। 

    ১৯৩০ সালের ১০ জানুয়ারি ক্রাইস্টচার্চের ল্যাঙ্কাস্টার পার্কে নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ঠিক পরদিন নিজেদের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে। তাদের প্রতিপক্ষও ইংল্যান্ড! 
     


    এখানেই নিজেদের প্রথম টেস্ট খেলেছিল নিউজিল্যান্ড


    নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিল যে ইংল্যান্ড, সেটিকে বলা যায় ‘ইংল্যান্ড এ’। নিউজিল্যান্ড ছিল ‘ছোট’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাত্র ৫টি সিরিজ খেলেছিল তারা। প্রথম টেস্ট জিততে ২৬ বছর লেগেছিল তাদের, তবে সেটি ছিল তাদের ৪৫তম টেস্ট। ১৯৪৬ সালে এসে তাদের সঙ্গে প্রথমবার খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া, যে ম্যাচে নিউজিল্যান্ড দুই ইনিংসে অল-আউট হয়েছিল ৪২ ও ৫৪ রানে। অস্ট্রেলিয়া নিজেদের প্রতিবেশীর সঙ্গে এরপরের টেস্টটি খেলেছিল ১০,১৩৬ দিন পর!

    অবশ্য নিউজিল্যান্ডকে এমন ‘অবহেলার’ হয়তো আরেকটি কারণ ছিল-- ভারত। 

    ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসও ছিল বেশ পুরোনো। ১৭২১ সালে সেখানে ব্রিটিশ নাবিকরা ক্রিকেট খেলেছিলেন, জানা যায় এমন। ১৭৮০ সালে তৈরি হয়েছিল ‘ক্যালকাটা’ ক্রিকেট ক্লাব, সে হিসেবে সেটি এমসিসির চেয়েও পুরোনো। ১৭৯২ সাল থেকে তারা এখনকার ইডেন গার্ডেনসে খেলা শুরু করেন। তবে সেসব খেলোয়াড় ছিলেন ব্রিটিশরাই, নিজেদের খেলা খেলতেন তারা। 

    ১৮৪৮ সালে পার্সিরাও আসেন ক্রিকেটে। এক ইংলিশ সাংবাদিক তাদের ক্রিকেট খেলতে দেখেছিলেন পায়জামা পরে। এরও প্রায় ১০০ বছর পর ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজেরও নাম দেওয়া হয়েছিল-- পায়জামা ক্রিকেট। 

    ভারতে ক্রিকেট ছিল, তবে বিভক্ত। জাতি, গোষ্ঠি, বর্ণ, ধর্মভেদে। বোম্বে জিমখানা তৈরি হয়েছিল ১৮৭৫ সালে, তবে সেটি ছিল ‘ইউরোপিয়ান’দের। সেখানে ঢুকতে না পেরে পাতিলায়ালার মহারাজা তৈরি করেছিলেন ব্র্যাবোর্ন্ড স্টেডিয়াম। ভারত নিজেদের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলেছিল অবশ্য বোম্বে জিমখানাতেই, যেদিন সে মাঠের নিয়ম বদলাতে হয়েছিল। 

    তবে তখন বোম্বেতে ইউরোপিয়ান, পার্সি, হিন্দু, মুসলিমদের নিয়ে তৈরি আলাদা চারটি দল নিয়ে হতো ‘ট্রায়াঙ্গলার’ টুর্নামেন্টে। পরে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল আরেকটি দল, সে টুর্নামেন্ট হয়েছিল পাঁচ জাতির। বলা হয়, সেই টুর্নামেন্টের জ্বরই এসে লেগেছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশে, যারা তখনও ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অংশ। 


    পাকিস্তান 
    টেস্ট ক্রিকেটার আছে, মর্যাদা কই?

    জন্মের আগে থেকেই পাকিস্তানে টেস্ট ক্রিকেটার ছিল। যারা ভারতের হয়ে ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগেই টেস্ট খেলেছিলেন। 

    তবে পাকিস্তানকে অপেক্ষা করতে হলো, নিজেদের টেস্ট খেলতে। 

    শুধু টেস্ট ক্রিকেটার থাকা নয়, পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসও পুরোনোই। ১৮৭৮ সালে তৈরি হয়েছিল লাহোর জিমখানা, ১৮৮০ সাল থেকে যেখানে নিয়মিত হতো ক্রিকেট। সঙ্গে ছিল মুসলিম, হিন্দু, তাভি জিমখানা, মামদোত ক্লাব। তৈরি হয়েছিল গভর্নমেন্ট কলেজ ও ইসলামিয়া কলেজের দ্বৈরথ। এ দুই কলেজ ছিল পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। 

    দিলোয়ার হুসাইন, ওয়াজির আলি, নাজির আলি, জাহাঙ্গীর খান, বাকা জিলানি, মোহাম্মদ নিসার-- ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা এরা সবাই ছিলেন ওই দুই কলেজের। তখন উত্তর ভারত, পাতিয়ালা ও লাহোর থেকেই আসতেন ভারতের বেশিরভাগ ক্রিকেটার, প্রথম ২৬ জনের মাঝে ৯ জনই ছিলেন সেসব অঞ্চলের। এসব অঞ্চল মুসলিম অধ্যুষিত ছিল বলে ভারত দলেও তাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। ১৯৩৬ সালে ওভাল টেস্টে ভারতের একাদশের ৬ জন ক্রিকেটারই ছিলেন মুসলিম। 

    সঙ্গে করাচিতেও ছিল ক্রিকেটের উপস্থিতি। বোম্বের মতো সেখানকার ক্রিকেটও গড়ে উঠেছিল পাঁচজাতির এক টুর্নামেন্ট দিয়ে-- সিন্দ পেন্টাঙ্গুলার শুরু হয়েছিল ১৯১৬ সালে। মুসলিম, পার্সি, ইউরোপিয়ান, হিন্দু ও বাকিদের নিয়ে তৈরি দলগুলি নিয়ে এ টুর্নামেন্টে হয়েছে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। অনেকের মতে, ভারতের ক্রিকেট কেন্দ্রিবিন্দু ১৯২০-এর দিকে ছিল সিন্দই।

    ১৯৪৮ সালে ভারতে প্রথমবারের মতো সফরে এলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিসিসিআইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানালো পাকিস্তান। ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এলো পাকিস্তানে। সে সফরের জন্য ৩০ হাজার রুপি যোগাড় করতে হতো তাদের, শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের অনুদানে সংগৃহিত হয়েছিল সেটি। সে সফরের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা প্রশংসা করেছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেটারদের সামর্থ্যকে।

    পাকিস্তানের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সেক্রেটারি এমকেআর কন্ট্রোলার নিজ খরচে লন্ডনে গিয়ে আইসিসির সদস্যপদের আবেদন করেছিলেন। তবে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল দুটি কারণে-- পাকিস্তান সদস্যপদের ফি দেয়নি, তাদের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোও নেই। 

    ১৯৫১ সালে দুটি আন-অফিশিয়াল টেস্টের জন্য গিয়েছিল এমসিসি। প্রথমটি ড্র হয়েছিল, পরেরটিতে এমসিসিকে হারিয়ে দিয়েছিল আব্দুল হাফিজ কারদারের (যিনি আগেই ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছিলেন) পাকিস্তান। 

    এবার আর পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলো না আইসিসি। ১৮ জুলাই, ১৯৫২ সালে তাদেরকে ৭ম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে জায়গা দেওয়া হলো, সে বছরের অক্টোবরে দিল্লীতে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নামলো পাকিস্তান। 


    শ্রীলঙ্কা
    সিলন থেকে শ্রীলঙ্কা, উপেক্ষিত থেকে বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন

    হয়তো ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন স্টেশনে। লাউডস্পিকারে ঘোষণা আসছে। ট্রেনের সময়সূচি নয়। প্রথম শ্রেণির ম্যাচের স্কোর। 

    শ্রীলঙ্কায় ক্রিকেট ছিল এমনই। অথবা বলা উচিৎ, তখনকার সিলনে ক্রিকেট ছিল এমনই। 

    ১৮৬৩ সালে কলম্বো ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে শ্রীলঙ্কানদের সেখানে প্রবেশে অনুমতি পেতে লেগেছিল ৯৮ বছর। শ্রীলঙ্কা ছিল অ্যাশেজ খেলতে যাওয়ার পথে যাত্রাবিরতি। নিউজিল্যান্ড সফরের পথে খেলে যাওয়া। ভারত-পাকিস্তানে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া। 

    শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে থেকেও থাকেনি যেন। ক্রিকেট তাকে উপেক্ষা করে গেছে বরাবর। 

    ১৯৭৫ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা খেলে হেরেছিল ৩ ম্যাচই। ১৯৭৯ ও ১৯৮৩ সালে জিতেছিল একটি করে। ১৯৭৯ সালে হারিয়েছিল ভারতকে। ১৯৮২ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। 

    সে বছর কলম্বোর পি সারা ওভালে প্রথম টেস্ট খেলেছিল তারা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ইংল্যান্ড অধিনায়ক কিথ ফ্লেচার শ্রীলঙ্কার নামই ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারছিলেন না, আগেরবার শুনে যাওয়া সিলন আর এবার শ্রীলঙ্কা-- দুই যোগ করে বলছিলেন ‘শ্রী লন’। 

    প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার ২১৮ রানের মাঝে ৫৪ রান করেছিলেন এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তখন তার  বয়স ১৮ বছর ৭৮ দিন। নাম-- অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

    ১৯৮৩ সালের চ্যাম্পিয়ন ভারত এসেছিল শ্রীলঙ্কায়, ১৯৮৫ সালে। প্রথম ও শেষ টেস্ট ড্রয়ের মাঝে দ্বিতীয় টেস্ট জিতেছিল শ্রীলঙ্কা। ক্রিকেটবিশ্ব তাদের ‘স্বীকৃতি’ দিতে সময় নিয়েছিল প্রায় ১০০ বছর। বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে সিরিজ হারাতে শ্রীলঙ্কার লেগেছিল ৩ বছর। সে সিরিজের আগে অরভিন্দ ডি সিলভা খেলেছিলেন মাত্র একটি টেস্ট। 

    এর ১১ বছরের মাথায় লাহোরে অস্ট্রেলিয়াকে স্তব্ধ করে গর্জন করে উঠেছিল শ্রীলঙ্কা। একসময় ক্রিকেটে থেকেও না থাকা দলটি হয়েছিল বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ১৪ বছরের মাথায়। শ্রীলঙ্কার রূপকথার দুই কারিগরের নাম ছিল-- অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরভিন্দ ডি সিলভা। 


    জিম্বাবুয়ে 
    দক্ষিণ আফ্রিকার পথেই!

    শ্রীলঙ্কা ছিল সিলন। জিম্বাবুয়ে ছিল রোডেশিয়া। 

    দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া টুর্নামেন্ট কুরি কাপে যাতায়াত ছিল তাদের। উন্নতি হচ্ছিল তাদের। ক্রিকেটাররা যাচ্ছিলেন কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে। তবে শ্রীলঙ্কার মতো তাদেরকেও গোণার ভেতর ধরছিলেন না যেন কেউ। 

    স্বাধীনতার পর জিম্বাবুয়ে হয়ে গেল তারা। আইসিসি ট্রফি জিতে খেলতে গেল ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। ৯ জুন ছিল তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। জিম্বাবুয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে সময় নিল ১২০ ওভার। 

    ডানকান ফ্লেচারের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে জিম্বাবুয়ে হারিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়ানদের। কদিন পর সে বিশ্বকাপে পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ভারতকে হারাতে ধরেছিল তারা। কপিল দেব হতে দিলেন না সেটা, খেললেন ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস। 

    পরের বিশ্বকাপে অবশ্য তাদের ফিরতে হলো খালি হাতেই। ১৯৯২ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের সঙ্গে লড়াই করলেও ভুগছিল তারা। শেষ ম্যাচ খেলতে নামলো তারা জয়ের কলাম শূন্য রেখেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও নিজেদের শেষ ম্যাচে তারা গুটিয়ে গেল ১৩৪ রানে। কিন্তু সেই ম্যাচই গেল ৫০তম ওভারে। 
     


    স্বেচ্ছা-নির্বাসনে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে


    শেষ ওভারের প্রথম বলে যখন ম্যালকম জার্ভিসের বলে গ্ল্যাডস্টোন স্মল ক্যাচ দিলেন অ্যান্ডি পাইক্রফটের হাতে, ইংল্যান্ড তখনও জয় থেকে ৯ রান দূরে। 

    প্রায় বিভীষিকার বিশ্বকাপ জিম্বাবুয়েকে এনে হাজির করলো টেস্ট-অঙ্গনে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই জয়ে। তাদের টেস্ট-স্ট্যাটাস প্রাপ্তির বিরোধিতা করেছিল ইংল্যান্ড, তবে ধোপে টেকেনি সেটা। 

    সে বছরই ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল তারা হারারেতে। 

    তবে ঠিক বছর দশেক পর জিম্বাবুয়েকেও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেটা কে ভেবেছিল! ২০০৩ বিশ্বকাপের আগ দিয়ে তাদের অবস্থা টালমাটাল, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সহ-আয়োজক ছিল তারাও। তবে ইংল্যান্ড খেলতে গেল না সেখানে। 

    নামিবিয়ার সঙ্গে ম্যাচে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা নামলেন কালো আর্মব্যান্ড পরে, ‘প্রিয় জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্রের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে’। দুজনের কেউই সে বিশ্বকাপের পর জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলেননি আর। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট হয়তো এখনও সে ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। 

    ২০০৫ সালের পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে গিয়েছিল তারা। ২০১১ সাল থেকে ফেরার পর জিম্বাবুয়ে এখন পর্যন্ত খেলেছে মাত্র ১৬টি টেস্ট।


    বাংলাদেশ
    বাকিটা ব্যক্তিগত 

    গল্পটা এখন ব্যক্তিগত। 

    বাবার কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে প্রথম পেয়েছিলাম একটা ডায়েরি। সে ডায়েরিটায় ২০০২ বিশ্বকাপ ফুটবলের স্কোর, ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্কোরের রেকর্ড থেকে পরে রুপ নিয়েছিল পেপার-কাটিংয়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে। বড় বোন কিনে এনেছিলেন, বাবার পক্ষ থেকে কিছু একটা লিখে দিয়েছিলেন। 

    জন্মদিন না হলেও বছরের শুরুতে বাবা সব ভাই-বোনকে একটা করে ডায়েরি দিতেন নিজে সই করে, ডায়েরির সাইজ বড় থেকে ছোটদের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে কমতো। ফলে নিজের কাছে যা আসতো, তা ঠিক পেপার-কাটিংয়ের জন্য যুতসই নয়। সেসবের বেশিরভাগ পৃষ্ঠায় খালি পড়ে থাকতো। 

    আমার ঠিক বড় ভাই হোস্টেলে যাওয়ার পর তার ডায়েরি-সম্পদে আমার অবাধ বিচরণ ছিল। তার ডায়েরি দেখেই নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম, “বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে ২৬ জুন, ২০০০”, “বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলে ১০ নভেম্বর, ২০০০”। 

    ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি ছিল না বুঝেই দৌড়াদৌড়ির মতো, সবাই দৌড়াচ্ছে, বাংলাদেশ জিতে গেছে। এর তাৎপর্য-- এ শব্দের অর্থই তো বুঝি না-- বুঝে উঠার সময় নেই। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের স্কটল্যান্ড ঘুমচোখে লেগে আছে, পাকিস্তান সন্ধ্যা গড়ানো সময়ে। 
     


    সাকিব, তামিম : বাংলাদেশের নতুন দিন যাদের হাত ধরে... 


    তখনও এক ইনিংসের হিসাব রাখলেই চলতো, দ্বিতীয় ইনিংস, ফলো-অনের জটিল হিসাব-নিকাশে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ২০০০ সালের ২৬ জুনের পর থেকে পড়তো। 

    এরপর ধীরে ধীরে অবকাঠামো, বা কাঠামোর হাহাকারে হারিয়ে যাওয়া, সে-ও তো কতো পরে। তার আগে সাইকেল ছুটিয়ে যেতে যেতে খবর পাওয়া, বাংলাদেশ টেস্ট জিততে চলেছে। আগে-পরে মুলতান, ফতুল্লা। আরও পরে চট্টগ্রাম। 

    টেস্টের রঙ সাদা, দুই দলেরই তো। হয়তো কারোটা ধবধবে সাদা, কারওটা ঘিয়ে। কিন্তু পারফরম্যান্সে কেমন বিস্তর ফারাক। এরপর ২০১৬-এর অক্টোবর, মিরপুর। মেহেদি হাসান মিরাজের বলটা স্টিভেন ফিনের প্যাডে গিয়ে আছড়ে পড়া। শের-ই-বাংলার প্রেসবক্সে বসে অনেক কাঁপুনি সামলে শিরোনাম দেওয়া, যেটি ছিল খাতার আনাচে-কানাচে, “অতঃপর বাংলাদেশ।” সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালের যুগল গল্প লেখার বৃথা চেষ্টা। 

    ২০১৮-তে এসে তাইজুলের কোলে চড়ে বসা সাকিবের। এরপর রাতভোর থেকে শুরু করে নিউজিল্যান্ড সিরিজ হয়তো, অথবা ভোর পর্যন্ত চলা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ। 

    হতাশা। আক্ষেপ। প্রাপ্তি। উচ্ছ্বাস। সাদা রঙা সব গল্প। কখনও ধবধবে। কখনও ফ্যাকাসে। 

    তবে ২০০০ সালের ২৬ জুনের পর থেকে টেস্ট ক্রিকেটের গল্পটা ব্যক্তিগত।  


    (কুইজ) বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট : কতোটা জানেন আপনি?


    আফগানিস্তান
    রূপকথা...

    ‘জামা গুটাও, নেমে এসো রাস্তায় 
    শুরু করো নাচ
    কারণ গরীবদের জীবনে খুব বেশি সুখ নেই!’ 
    -আফগান কবিতা

    তাজ মালিক কাঁদছেন। আফগানিস্তান মাত্র জিতেছে জার্সিতে হওয়া আইসিসির ডিভিশন ফাইভ লিগ। সে খবরটা ফোনে তিনি দিচ্ছেন দেশে, একটু আগেও ঘন ঘন টানছিলেন সিগারেট। তাজ আফগানিস্তানের প্রথম কোচ, আফগানিস্তানে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম রূপকার, পাগলাটে একজন। তাজ আফগানিস্তান ক্রিকেটের রূপকথার অপরিহার্য সদস্য। তাকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্র আউট অফ দি অ্যাশেজ-এর শুরুতে তিনি বলেন, “জানেন তো, আজকের দুনিয়ায় কতো সমস্যা, জানেন তো! সব জায়গায় মারামারি, জানেন তো, অবিচার হচ্ছে। এসবের একমাত্র সমাধান? ক্রিকেট!” 

    হয়তো তাজের কাছে সমাধান এটাই। হয়তো আফগানদের কাছেও ক্রিকেট এটাই- সবকিছুর সমাধান। সেবার বিশ্বকাপ খেলা হয়নি আফগানিস্তানের, যেটা তারা খেলেছে ২০১৫ সালে এসে। সেদিন জার্সির ফাইনাল জেতার কিছুক্ষণ পর মাঠে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়া মোহাম্মদ নবি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের প্রথম বিশ্বকাপে, ততদিনে তাজকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আফগানিস্তান ক্রিকেট থেকে। 

    অবশ্য আফগান ক্রিকেট থেকে সরেনি রূপকথা। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপের পরই তারা জানতো, সহযোগী দেশগুলোর জন্য সামনে নাভিশ্বাস অবস্থা, আইসিসি ততদিনে নিয়ে ফেলেছে পরের বিশ্বকাপ দশ দলের করার সিদ্ধান্ত। আফগানিস্তানের সামনে আবার আরেকটি বাছাইপর্ব, আরেকটি হার্ডল, জার্সির সেই টুর্নামেন্টের মতো। 

    জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আফগানিস্তান লিখলো আরেকটি রূপকথা, ক্রিকইনফোর এক জরিপে যা ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা প্রত্যাবর্তন! টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট হয়েও প্রথম তিন ম্যাচে তারা হারলো স্কটল্যান্ড, হংকং, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে। নেপালকে হারিয়ে ঝুলে রইল তারা, হংকংকে নেপাল হারালেই শুধু গেল পরের পর্বে। 

    এরপর আফগানিস্তান জিতল টানা চার ম্যাচ, সঙ্গে তাদের সহায়তা করলো আরব আমিরাতের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের হার। যে আফগানিস্তান টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যাচ্ছিল, সেই তারাই শেষ পর্যন্ত ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বাছাইপর্বে হলো চ্যাম্পিয়ন। 

    ১০ দলের বিশ্বকাপেও গেল আফগানিস্তান। তবে তার আগেই আফগানিস্তান হয়ে গেছে টেস্ট ক্রিকেটের ১১তম সদস্য। ব্রিটিশরা আফগানিস্তানে ক্রিকেট খেলেছিল একসময়, তবে পাকিস্তানের শরণার্থী শিবির থেকে ক্রিকেট-জ্বর বয়ে এনেছিলেন মালিকরা। 

    ২০০৭ সালে আইসিসির ডিভিশন ফাইভ, ২০১৭ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস। আফগানিস্তানের গল্পটা যেখানেই, যতোবারই শুনুন, রূপকথা শব্দটা ফেলে দিতে পারবেন না। 


    আয়ারল্যান্ড
    নিষিদ্ধ ক্রিকেট, এরপর টেস্ট ক্রিকেট 

     
    জিএএ বা গ্যেলিক অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। আয়ারল্যান্ডের বাতাসে তখন জাতীয়তাবাদের সুর। নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত। জিএএ করলো সেটাই- ছড়িয়ে দিল মন্ত্র, খেলাধুলাতেও সবকিছু হবে আইরিশ। খেলা হবে মূলত হারলিং, গ্যেলিক ফুটবল। আর কিছু নয়। 

    ১৯০১ সালে ‘নিষিদ্ধ’ করা হলো ক্রিকেটকে। ক্রিকেটের মতো ‘বিদেশী’ খেলা শুধু খেলতে নয়, নিষেধাজ্ঞা এলো দেখাতেও। যারা এ নিয়ম ভঙ্গ করবেন, তাদেরকে জিএএ আয়োজিত কোনও খেলায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না। জাতীয়তাবাদের চাপে চাপা পড়ে গেল ক্রিকেট। 

    অথচ এর আগে ক্রিকেট ছিল আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। সেই ১৭৩০ সাল থেকে শুরু, উনবিংশ শতাব্দিতেও ৩২টা কাউন্টিতে খেলা হতো, ক্যাথলিক, প্রোটেসটান্টরা খেলতেন মিলেমিশে। সেই ক্রিকেটই মিলিয়ে যেতে লাগলো। তবে ঠিক হারিয়ে গেল না। কিছু পরিবার চালিয়ে গেলেন খেলা। 

    এই নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। তবে ক্রিকেট ততোদিনে টিকে আছে শুধু এর ছায়ায়। যারা তখনও ক্রিকেট খেলতেন, ব্যঙ্গ করে তাদের বলা হতো ‘ওয়েস্ট ব্রিটস’। ক্রিকেট তখন শুধুই মজার বিষয়, এ নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার কিছু ছিল না।

    তবে কেউ কেউ সিরিয়াস ছিলেন। ২০০৭ সালের সেন্ট প্যাট্রিকস ডে-তে স্যাবাইনা পার্কে পাকিস্তানকে থমকে দিল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা আয়ারল্যান্ড। এ বিশ্বকাপে আসতে কতো ব্যর্থতার গল্প জমা পড়েছিল তাদের! আয়ারল্যান্ড সুপার এইটে হারিয়ে দিল বাংলাদেশকেও। 

    বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য দুই জয় ‘যথেষ্ট’ হয়েছিল, আইরিশদের হলো না। ২০১১ বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে কেভিন ‘ওহ’ ব্রায়েন লাল চুল নিয়ে ছুটলেন, পিষ্ট হলো ইংল্যান্ড। তবে আইরিশদের জন্য যথেষ্ট হলো না সেটাও। 

    ২০১৫ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই তারা হারালো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। এরপর জিতলো আরও দুটি ম্যাচ, খাতা-কলমে ইংল্যান্ডের চেয়ে একটি বেশি। টুইটারে আয়ারল্যান্ডকে বলা হলো-- ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন। ২০০৪ সালে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের একমাত্র ফুলটাইম কর্মকর্তা ছিলেন তাদের হেড কোচ। ২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ড হয়ে গেল ১২তম টেস্ট খেলুড়ে দেশ। একসময় টেস্ট ক্রিকেটের টানে আয়ারল্যান্ড ছাড়তেন ক্রিকেটাররা। এখন হলে অইন মরগানদের আর যেতে হতো না।  

    আয়ারল্যান্ডে একসময় ক্রিকেট লুকিয়ে রাখতেন এড জয়েসরা। ক্রিকেট এবার আয়ারল্যান্ডকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না আর। 


    থাকতে পারতো তারাও... 

    শুধু ক্রিকেট নয়, বলা হয়, যে কোনও খেলারই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৪৪ সালে ম্যানহ্যাটনে খেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। দলগুলির নাম ছিল ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা, দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ারস কানাডিয়ান প্রভিন্স। তবে খেলোয়াড়রা ছিলেন যথাক্রমে নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জেস ক্লাব ও কানাডার টরোন্টো ক্রিকেট ক্লাবের। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় খেলাই ছিল ক্রিকেট। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি ডব্লিউ জি গ্রেসও সেখানে গেছেন খেলতে। একসময় ফিলাডেলফিয়াতে বদ্ধ হয়ে পড়েছিল ক্রিকেট। এমসিসিও যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি, আইসিসি পরে সেটিকে বলেছিল ‘দুর্ভাগ্যজনক’। 

    ক্রিকেট জনপ্রিয় ছিল আর্জেন্টিনাতেও। ১৯০০-১৯৩৯ সালের মাঝে তাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এমন ছিল, বলা হতো, দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ডের চেয়েও ভাল তারা। এমসিসি দুইবার সফর করেছিল সেখানে, দুইবারই একটি করে ম্যাচ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। তবে এরই মাঝে ব্রিটিশদের নিয়ে যাওয়া আরেকটি ‘ভাইরাস’-এ আক্রান্ত হয়েছিল আর্জেন্টাইনরা-- ফুটবল। তবে ক্রিকেটে আক্রান্ত না হওয়ার তেমন কারণ ছিল না। তবে এমসিসির ‘কমনওয়েলথে’ থাকার সিদ্ধান্ত বঞ্চিত করেছিল আর্জেন্টিনার ক্রিকেটকে। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশরা আর্জেন্টিনা ছাড়ে, ক্রিকেটও তাই। 

     

    তথ্যসূত্র 

    জ্যারড কিম্বার, টেস্ট ক্রিকেট : দ্য আন-অথোরাইজড বায়োগ্রাফি 
    ওসমান সামিউদ্দিন, দ্য আনকোয়াইট ওয়ানস : আ হিস্টোরি অফ পাকিস্তান ক্রিকেট 
    সিএলআর জেমস, বিয়োন্ড দ্য বাউন্ডারি 
    ক্রিকইনফো 
    আইসিসি আর্কাইভ