• লা লিগা
  • " />

     

    আর্থুর-পিয়ানিচের দল-বিনিময়: বার্সার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী?

    আর্থুর-পিয়ানিচের দল-বিনিময়: বার্সার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী?    

    আর্থুর-পিয়ানিচের ‘সোয়াপ ডিল’ সম্ভবত  এখন পর্যন্ত মৌসুমের সবচেয়ে আলোচিত দলবদল। দুই বছর আগে আর্থুরকে যখন বার্সেলোনা এনেছিল, তার মধ্যে অনেকেই দেখেছিলেন জাভির ছায়া। বার্সার মিডফিল্ডের জাভির রেখে যাওয়া স্থানটা তখনও পূরণ হয়নি সেভাবে, আর্থুরের ঠাণ্ডা মাথার পাসিংয়ের মধ্যে সেই শুন্যতা ঘোঁচানোর ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু দুই বছর গড়াতে না গড়াতেই কেন স্বপ্নভঙ্গ হলো বার্সার? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন আর্থুরের জায়গায় পিয়ানিচকেই আনতে হলো?

    খেলোয়াড়-বিনিময় ধরনের দলবদলটা সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটা হচ্ছে সরাসরি খেলোয়াড় বিনিময়, আরেকটা বিনিময়ের সঙ্গে থাকে কিছু অর্থের লেনদেনও। আর্থুর-পিয়ানিচের ক্ষেত্রে হচ্ছে দ্বিতীয়টি। আর্থুরকে জুভেন্টাসে দেওয়ার বদলে পিয়ানিচকে পাচ্ছে বার্সেলোনা, আর সঙ্গে পাচ্ছে আরও ১০ মিলিয়ন ইউরো। এক অর্থে মনে হতে পারে, লাভটা তো বার্সারই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ২৩ বছর একজনকে মাত্র ১০ মিলিয়নের জন্য ছেড়ে ৩০ বছর বয়সী একজনকে নেওয়া কতটা পরিকল্পনাপ্রসূত? বার্সেলোনা বোর্ড কি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে?

     

    এই দলবদলে আসলে চারটি প্রশ্ন জড়িত, যেগুলো ব্যাখ্যা করলে এরকম হয়-

    ১) জুভেন্টাস কেন আর্থুরকে চাইছে? এবং পিয়ানিচকে কেন ছেড়ে দিচ্ছে?

    ২) বার্সেলোনা কেন পিয়ানিচকে চাইছে? এবং আর্থুরকেই কেন ছেড়ে দিচ্ছে?

     

    আগে একটু এক ও দুই নম্বর প্রশ্নটা খতিয়ে দেওয়া যাক।

    জুভেন্টাসে যখন মারিজিও সারি কোচ হয়ে এলেন, এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি ইতালির দলটি। এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত তারা শীর্ষে আছে বটে, কিন্তু তাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে লাৎসিও। এই বছর কোপা ইতালিয়া পাওয়া হয়নি তাদের। সারির একটা দর্শন আছে, সেই সারিবলের প্রভাব অবশ্য কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। পাসিংয়ের হিসেবে আগের মৌসুমের চেয়ে সাফল্যের হার বেড়েছে জুভেন্টাসের (৮৬.২ থেকে ৮৯.৯)। কিন্তু মাঠের খেলায় সেই ছন্দ ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। সারি তার ধরনে খেলার জন্য একজন পাসিং মিডফিল্ডারের ওপর তীব্রভাবে নির্ভর করে থাকেন। নাপোলি বা চেলসিতে যেটা করেছিলেন জর্জিনহো, তবে তাকে চেলসি থেকে আনেননি। সেই কাজটা জুভেন্টাসে পিয়ানিচকে দিয়েই হয়তো করাতে চেয়েছিলেন, তবে দৃশ্যত সারি সেটা ঠিকঠাক পারেননি। পরিসংখ্যান যদিও বলছে আগের মৌসুমের চেয়ে ০.১% শতাংশ পাসিং সাফল্য বেড়েছে পিয়ানিচের, কিন্তু মাঠের খেলাটা ঠিক কার্যকর ছিল না। বরং ছোট কিছু দলের সঙ্গে রদ্রিগো বেন্টাঙ্কুর কাজটা করেছেন বেশি। তাহলে কি সারির সিস্টেমে ফিট হচ্ছেন না বলেই পিয়ানিচকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে? এখানে কি জর্জিনহোর বিকল্প হিসেবে আর্থুরকে বেছে নেওয়া হচ্ছে? রাবিওট আর রামসেও সেই কাজটা করতে পারেননি এই মৌসুমে। ওদিকে আর্থুর মূলত তার পাসিংয়ের জন্যই পরিচিত। পরিসংখ্যান, ফাইনাল থার্ডে পাস আর ফরোয়ার্ড পাসেও তার পরিসংখ্যান চেলসির জর্জিনহোর কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে ২৩ বছর বয়সী একজনকে জুভেন্টাস কোচ সারি চাইতেই পারেন।

     

    এবার প্রশ্ন হচ্ছে তিন ও চার। কেন বার্সা আর্থুরকে ছেড়ে পিয়ানিচকে চাইছে?

    এখানে এসেই একটু ধন্দে পড়ে যেতে হয়। আর্থুর গত মৌসুমে লা লিগা জয়ে অবদান রেখেছিলেন বেশ। এই মৌসুমটা অবশ্য ভালো কাটেনি তার। চোটের জন্য মাঠের বাইরে ছিলেন বেশ কিছুটা সময়। এখন তার ফিটনেস আর গতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। সেতিয়েন আসার পর দলে জায়গাটা একটু পোক্ত হবে বলে ভাবা হচ্ছিল, সেটাও হয়নি। কয়েক দিন আগে বিলবাওয়ের বিপক্ষেও তার জায়গায় নেমে রিকি পুই গড়ে দিয়েছেন ব্যবধান। তাহলে মাত্র দুই মৌসুমের মধ্যেই আর্থুরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বার্সা? আপাতত সেরকমই মনে হচ্ছে।  

    সম্পূরক প্রশ্ন, পিয়ানিচকে কেন চাইছে তারা? বার্সার দলবদলে সবসময় ‘আইডেন্টিটি’ বা স্বকীয়তা একটা বড় ব্যাপার। বার্সা তাদেরকেই নেওয়ার চেষ্টা করে সাধারণত, যাদের খেলার ধরনটা নিজেদের সঙ্গে যায়। সেই হিসেবে পিয়ানিচের মান নিয়ে প্রশ্ন নেই। রোমা আর জুভেন্টাসের হয়ে নিজেকে বিশ্বসেরা মিডফিল্ডারদের একজন হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ফ্রাংকি ডি ইয়াংয়ের সাথে বার্সা মিডফিল্ডে কিছুটা অভিজ্ঞতার জন্য তাকে নেওয়া, আপাতত সেরকম সিদ্ধান্তে আসা যায়। কিন্তু ৩০ বছর বয়সে কতটা সার্ভিস দিতে পারবেন বার্সাকে? নিজের সেরাটা কি তিনি পেছনে ফেলে আসেননি? শর্টটার্ম লাভের জন্য তাহলে কি ‘লংটার্মে’ ক্ষতি হলো বার্সার? পিয়ানিচ কি বরং পুই বা আরও তরুণদের জায়গাটা আটকে রাখবেন না? এসব দিকে বিবেচনা করলে বার্সার দিক দিয়ে এই দলবদল ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

    তাহলে কারণটা কি অর্থনৈতিক?

    আপাতত শুধু এই একভাবেই এই সোয়াপ-ডিলের ব্যাখ্যা করা যায়। আর্থুরকে যখন দুই বছর আগে কিনেছিল বার্সা, খরচ হয়েছিল ৩০ মিলিয়ন ইউরো। চুক্তি হয়েছিল ছয় বছরে, তার মানে প্রতি বছর তার জন্য পাঁচ মিলিয়ন ইউরো করে খরচ হচ্ছিল। দুই বছরে তাই ১০ মিলিয়ন ইউরো কমেছে। এই মুহূর্তে তার দাম বার্সার হিসেবে ২০ মিলিয়ন ইউরো। এখন যেহেতু তাকে ৮০ মিলিয়ন ইউরোতে ছাড়ছে, তাই লাভ হচ্ছে ৬০ মিলিয়ন ইউরো।  যে খেলোয়াড়ের ওপর তাদের ভরসা কম, তাদের জন্য এই লাভের অংকটা বার্সার কাছে বেশ বড়ই।

    অন্যদিকে পিয়ানিচের ক্ষেত্রে জুভেন্টাসের লাভ আরও বরং বেশি। সাধারণভাবেই বোঝা যায়, ৩০ বছর বয়সী একজনের জন্য ৭০ মিলিয়ন ইউরো অনেক বেশি। ২০১৬ সালে রোমা থেকে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে তাকে এনেছিল জুভেন্টাস। তখন চুক্তি ছিল পাঁচ বছরের, তার মানে প্রতি বছরের জন্য খরচ সাত মিলিয়ন ইউরো। দুই বছর পর নতুন চুক্তি করল, তখন দাম কমে হলো ২১ মিলিয়ন ইউরো। এবার চুক্তি হলো আরও পাঁচ বছরের জন্য, প্রতি বছরের জন্য খরচ হচ্ছে ৪.২ মিলিয়ন। দুই বছর চলে যাচ্ছেন পিয়ানিচের, তাহলে দাম কমেছে ৮.৪ মিলিয়ন। এই মুহূর্তে পিয়ানিচের দাম জুভেন্টাসের কাছে প্রায় ১৩ মিলিয়ন। বার্সা তার দাম ধরেছে ৭০ মিলিয়ন, তার মানে পিয়ানিচের জন্য জুভেন্টাসের লাভ হচ্ছে ৫৭ মিলিয়ন। ৩০ বছর বয়সী একজনের জন্য লোভটা এড়ানো জুভেন্টাসের জন্য কঠিনই।

    আর্থিক দিক দিয়ে দুই দল এখন পর্যন্ত ‘উইন উইন’ অবস্থায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত কারা জিতবে, বলে দেবে সময়।