• এশিয়া কাপ ২০১৮
  • " />

     

    এশিয়ায় ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- প্রথম পর্ব

    এশিয়ায় ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- প্রথম পর্ব    

    ফুটবলের মত ক্রিকেটে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের কোন বালাই নেই। প্রত্যেক মহাদেশে আইসিসির পূর্ণ সদস্যই যে মাত্র হাতে গোণা! ক্রিকেট পাগল উপমহাদেশীয়রা তাই দুনিয়ার একমাত্র মহাদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে বড়াই করতেই পারে! দু'বছর বাদে আবার দুয়ারে এশিয়া কাপ। প্রথা ভেঙ্গে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে আসা এই টুর্নামেন্ট শুরুর প্রাক্কালে চলুন ঘুরে আসা যাক এর ইতিহাস থেকে। ৩২ বছরের পুরনো এই টুর্নামেন্টে কালের ধুলো কম পড়েনি আসলে।  


     

    দৃশ্যপটে এশিয়া

    ক্রিকেট তখন শুধু ক্যালিপসো সুরে আচ্ছন্ন, টেস্ট ক্রিকেট তখন কেবল অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেতারে বাঁধা। সময়টা ১৯৮৪ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকা নির্বাসিত; নিউজিল্যান্ড পায়ের নিচে মাটি শক্ত করতে ধুঁকছে; ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেললেও আবেগটা ঠিক আজকের মত কাজ করত না। শ্রীলঙ্কা টেস্ট আঙিনায় একেবারেই শিশু আর বাংলাদেশ তো কেবল ক্রিকেট খেলা শিখছে। তবুও এশিয়ার এই চারটি দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে নিয়েই গঠিত হল এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্স, আজকের এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের সেটাই ছিল প্রাক্তন রূপ। উদ্দেশ্য অবশ্য মহৎ ছিল- ক্রিকেট মর্যাদাকে কেবল ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে পুরো এশিয়াতে ছড়িয়ে দেয়া। আজকের দিনে এসে সেই উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে তা বিন্দুমাত্র ঝুঁকি না নিয়ে বলাই যায়।

     

    এই এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্সেরই প্রসূত ধারণা হচ্ছে এশিয়া কাপ। প্রথম আসর বসেছিল শারজাহতে। রাউন্ড রবিন লিগে খেলা, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা খেলেছিল। ওয়ানডে ফরম্যাটে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে এই কাপটা জমবে কিনা তা নিয়ে প্রাথমিক উৎকণ্ঠা টুর্নামেন্ট শুরুর সাথে সাথেই ব্যাপক দর্শক সমাগমের মাধ্যমে মিলিয়ে যায়। একদিক থেকে এই টুর্নামেন্টটাকে একটা বিদ্রোহও বলা যায়। বিশ্বকাপের বাইরে ওয়ানডে টুর্নামেন্ট হত কেবলমাত্র অস্ট্রেলিয়ায় এবং সেখানে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের জায়গা একেবারে পাকা। তৃতীয় দল হিসেবে অন্য কোন দেশ ডাক পেত। বেনসন-হেজেস ট্রফির সে ম্যাচগুলোতে ডাক পেতে হাপিত্যেশ করা এশিয়ান দলগুলোর এই টুর্নামেন্ট তাই ক্রিকেট রক্ষণশীলদের প্রতি একটা জবাব হিসেবে আবির্ভূত হয়। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলও উদ্বুদ্ধ হয় প্রতি দু বছর পরপর এটা আয়োজন করার।

     

    শারজায় ট্রফি হাতে সুনীল গাভাস্কার- প্রথম এশিয়া কাপ জয়ের পর

     

    তবে টুর্নামেন্টে অনেক সময়ই মাঠের ক্রিকেট নয়, আলোচিত হয়েছে মাঠের বাইরের ব্যাপার-স্যাপার। প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারত দ্বিতীয় আসরে খেলেইনি। শ্রীলঙ্কার সাথে তামিল ইস্যুতে চাপান-উতোর চলতে থাকা ভারত সরকার ক্রিকেট দলকে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তাই গেল এশিয়া কাপ খেলতে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। বাংলাদেশ তখন সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে উঠতি শক্তি; কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তানের সাথে খেলা ম্যাচ দুটোই তার প্রমাণ- পাকিস্তানের সাথে একশ'র নিচে (৯৪) আর শ্রীলঙ্কার সাথে ১৩১ রানে গুটিয়ে যাওয়া। এই টুর্নামেন্ট শুধু রাউন্ড রবিন লিগ ছিলনা, গ্রুপ পর্বের শীর্ষ দুই দল নিয়ে ফাইনাল ম্যাচও ছিল - তাতে শ্রীলঙ্কা জিতে পেল এশিয়া সেরা হবার স্বাদ। এশিয়া কাপের এর পরের গল্পটা শুধু শ্রীলঙ্কা-ভারতের চ্যাম্পিয়ন হবার লড়াই। বিস্ময়কর হলেও সত্য পাকিস্তান ওই দশকে আর একবারও ফাইনাল উঠতে পারেনি!

     

    সরকারি ছুটি

    ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলো ওই সময়ে ছিল সিগারেটের বিজ্ঞাপনী মোড়ক! অস্ট্রেলিয়ায় যেমন হত ‘বেনসন-হেজেস’ ট্রফি, এশিয়াতে আবার হত ‘জন প্লেয়ার গোল্ডলিফ’ ট্রফি! তামাক বিরোধীরা তখন নিজেদের ক্রিকেট বিদ্বেষী ভাবতেন কিনা কে জানে? শ্রীলঙ্কা তামাকবিরোধী ছিল কিনা সেটা বড় বিষয় নয়, তবে 'সিগারেটে মোড়ানো' এমনই এক টুর্নামেন্ট জিতেই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা তাঁদের জনগণকে দিয়েছিলেন এক দিনে ছুটি!

    টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর এশিয়া কাপ জেতা ছিল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের জন্যে বিশাল মাইলফলকই ছিল। একে তো আয়োজক, তার উপর চ্যাম্পিয়ন- জনতার প্রবল উল্লাসের দাবিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জয়াবর্ধনে পরদিন সরকারি ছুটিই ঘোষণা করে দেন! ত্রিদেশীয় কাপ জিতে সরকারি ছুটি পাবার দৃষ্টান্ত বোধহয় ঐ একটাই আছে এবং সম্ভবত একমাত্র নজির হয়েই থাকবে! ১৯৮৬ এর এশিয়া কাপ এ দিক দিয়েও অনন্য!

     

    আয়োজক বাংলাদেশ

    ১৯৮৮ সাল। বাংলাদেশের মানুষ এ বছরটাকে আর যাই ঘটুক না কেন বন্যার বছর হিসেবেই মনে রাখবে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর জুড়ে চলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল দেশের ৭০ শতাংশ অঞ্চল; আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিভাগ ছিল ঢাকা! খোদ রাজধানীই টানা ২০ দিন পানির নিচে ডুবে থাকে। অক্টোবরে পানি নেমে যাবার পর আর যাই হোক কারো মাথায় তখন ক্রিকেট থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বিসিবি (তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড) এর মধ্যেই মাঠে নামালো ক্রিকেট! আতিথেয়তা দিল আইসিসির তিনটি পূর্ণাংগ সদস্য দেশকে। প্রথমবারের মত আয়োজন করে ফেললো আইসিসি অনুমোদিত একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। মাঠের খেলা যাই খেলুক, আয়োজক হিসেবে সদ্য বন্যা-আক্রান্ত বাংলাদেশ ছিল সত্যিই অসাধারণ!

     

    উইলস এশিয়া কাপ-১৯৮৮ এর সবচেয়ে দুর্ভাগা দল হয়তো শ্রীলঙ্কা। টানা তিন ম্যাচ জিতে ফাইনালে ওঠা, এরপর ভারতের সাথে মাত্র ১৭৬ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া। অথচ গ্রুপ ম্যাচে এই ভারতের সাথেই তারা করেছিল ২৭৭ রান- এখনকার প্রেক্ষিতে যা ৩০০ ছাড়ানো স্কোর!

    ফাইনাল হারলেও শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বজয়ী দলটির ভিত খুব সম্ভবত এখান থেকেই রোপিত হয়। ৩০ গজী বৃত্তের নিয়ম ব্যবহার করার জন্যে প্রথম থেকেই চালিয়ে খেলার একটা প্রয়াস এই টুর্নামেন্টে ছিল শ্রীলঙ্কার ট্রেডমার্ক। সাথে ছিল রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে অসাধারণ দক্ষতা! অর্জুনা রানাতুঙ্গা পান অধিনায়ক হিসেবে ভবিষ্যতের সঞ্জীবনী; আর আবির্ভাব ঘটে একজন ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভার। তখনকার যুগে একজন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ৬০-৭০ স্ট্রাইক রেট নিয়েই যেখানে খুশি থাকতেন সেখানে গোটা টুর্নামেন্টে সিলভার স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৮! গ্রুপ পর্বে ভারতের সাথে ম্যাচটায় করেছিলেন ৩২ বলে ৪৯। ফাইনালে রানআউট হয়ে যান; ঐ ম্যাচেই তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল কেবল একশর নিচে। ঐ আউটটা না হলে হয়তো ফাইনালের চিত্রনাট্য অন্যরকম হতো। নভোজ্যত সিং সিধুর বদলে হয়তো সিলভাই হতেন ঐ এশিয়া কাপের সেরা খেলোয়াড়।

     

     

    আবার বরবাদ...

    এর পরের এশিয়া কাপেও চার দল হল না। ভারত আয়োজক হওয়ায় এবার খেলতে গেল না পাকিস্তান। তিন দলের টুর্নামেন্ট, ম্যাচ মাত্র চারটি। যেভাবে জমে উঠার কথা ছিল সেভাবে এই এশিয়া কাপ জমতে পারে নি। তবে বাংলাদেশের জন্য এই টুর্নামেন্টটা রয়েছে অনেক গর্বের স্মৃতি নিয়েই!

    ফারুক আহমেদের একমাত্র ওয়ানডে ফিফটি ভারতের সঙ্গে ঐ টুর্নামেন্টেই পাওয়া। তৃতীয় উইকেটে আতহার আলী খানের সাথে গড়েছিলেন ১০৮ রানের জুটি। স্কোর ছিল একসময় ৩ উইকেটে ১৩৬, কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিরুদ্ধে ২০০ পেরোনো ‘ফাইটিং স্কোর’ গড়াও তখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। কিন্তু শেষে আর দ্রুত রান তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৭০ রান তোলা- ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে কৃতিত্বটাও কম নয়!

    টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের আবিষ্কার ছিলেন আসলে আতহার আলী খান। দ্বিতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ২৪৯ রানের জবাবে তাঁর ব্যাটে ভর দিয়ে বাংলাদেশ ভালভাবেই ম্যাচে ছিল। অন্যপ্রান্তে মিনহাজুল আবেদীন নান্নু চমৎকার চালিয়ে খেলছিলেন, পরে ব্যাট করার জন্যে ছিলেন আকরাম খান আর আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সবাই একসাথে সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটাতে পারলে ম্যাচটা জেতা অসম্ভবও ছিল না। সেটা অবশ্য আর হয়নি। অপরপাশে সঙ্গীর অভাবে আতহার আলী খানকে ৭৮ রানে অপরাজিত থেকে খেলা শেষ করতে হয়। ৯৫ বলে খেলা সেই ইনিংসের ব্যাপারে এখনো আতহার আলী খানকে জিজ্ঞাসা করলে কেবল আফসোস শুনবেন- ঐ ম্যাচ বাংলাদেশ জিতলে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট আরো ৫ বছর এগিয়ে থাকত! তবে একেবারে খালি হাতে ফেরেননি আতহার- প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে কোন টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে খেলে হন ম্যাচসেরা!

    অনুমেয় ফাইনাল লাইনআপ। কলকাতায় তাই দর্শকের ভিড় ছিল স্বাভাবিকভাবেই উপচে পড়া। ঘরের দর্শকদের সামনে ভারত হতাশও করেনি। শ্রীলঙ্কাকে মাত্র ২০৪ রানে অলআউট করে প্রথম ইনিংসেই খেলার ফলাফল অর্ধেক নিশ্চিত করে দেয় ভারত। কপিল দেব নেন ৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে এই রান তুলে ফেলে। সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার ৭৫ আর মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন মাত্র ৩৯ বলে ৫৪ রান করে অপরাজিত থাকেন। ভারত তৃতীয়বারের মত শিরোপা ঘরে তুলল, আজহারউদ্দিনের বিক্রমাদিত্যের সূচনাও হলো সেখান থেকেই। ঐ ফাইনালে মাত্র ১৭ বছরের এক বালকও ফিফটি পেয়েছিল। গোটা ইনিংসে মাত্র দুইটি চার, তবুও স্ট্রাইক রেট ৭০ এর উপরে। মহাকাল কি জানতো এই ছেলেটিই পরের দু' দশক বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করবে?
     

    শচীন রমেশ টেন্ডুলকার নিজেও কি তা জানতেন?

    (চলবে)

     


    পরবর্তী পর্বঃ

    এশিয়ার ক্রিকেট "বিদ্রোহ"- দ্বিতীয় পর্ব