• ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফর ২০২০
  • " />

     

    ১১৭ দিনের অপেক্ষা ৮২ মিনিটে মেটানোর চেষ্টা করলো ক্রিকেট

    ১১৭ দিনের অপেক্ষা ৮২ মিনিটে মেটানোর চেষ্টা করলো ক্রিকেট    

    সাউথাম্পটন টেস্ট
    ১ম দিন, স্টাম্পস
    ইংল্যান্ড ১ম ইনিংস ৩৫/১* (বার্নস ২০*, গ্যাব্রিয়েল ১/১৯) 


    আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরলো ১১৭ দিন পর। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন বেন স্টোকস, ডম সিবলির উইকেট হারিয়ে ৩৫ রান তুলেছে ইংল্যান্ড। বৃষ্টিবিঘ্নিত প্রথম দিনে খেলা হয়েছে মাত্র ১৭.৪ ওভার। তবে তাতে অবশ্য রোমাঞ্চ ঠিক কমলো না। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের ফেরার প্রথম দিনটাকে বলতে হবে স্মরণীয়ই। 


    ‘দ্য নিউ নরমাল’ 

    টসের পর জেসন হোল্ডার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেকের জন্য। বেন স্টোকস করতে চাইলেন ‘ফিস্ট-বাম্প’। এরপর দুজনেরই যেন মনে পড়ে গেল, এসব তো করা যাবে না! জিভে কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে সরে গেলেন দুজন। ম্যাচ রেফারি, দুই অধিনায়ক বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ছিলেন না টেলিভিশন হোস্ট। স্কাই স্পোর্টস ‘মোবাইল’ ক্যামেরা দিয়ে এরপর সাক্ষাতকার নিল দুই অধিনায়কের। ইয়ান ওয়ার্ড বলছিলেন স্টোকসকে, যাতে হাত স্যানিটাইজ করে নেন এরপরই। কমেন্টেররাও বসলেন দূরে দূরে, প্রেসবক্সেরও একই অবস্থা। ‘সামাজিক দূরত্ব’ সবখানেই। শুরুতে স্কাইয়ের ব্রডকাস্টিংয়েও টেকনিক্যাল ত্রুটি দেখা গেল, কেমার রোচের অন্তত একটি বলে শুধু মাইকেল হোল্ডিংয়ের কমেন্ট্রিই শোনা গেল। অনেকদিন পর হয়তো তাদেরও অভ্যস্ত হতে সময় লাগছিল। হোল্ডিং বলছিলেন, অনেকদিন অভ্যাস নেই বলে এমন সময় কী বলতে হবে, বুঝতে পারছেন না তিনিও! 

    ইনিংসের চতুর্থ বলে কেমার রোচের ভেতরের দিকে ঢোকা বলটা ছেড়ে দিলেন ররি বার্নস, যেটি আছাড় খেলো তার প্যাডে। তবে আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওর্থ আউট দিলেন না। জেসন হোল্ডার নিলেন রিভিউ। এ ম্যাচ দিয়ে রিভিউসংখ্যাও ইনিংসপ্রতি বেড়েছে একটি করে, হয়তো শুরুতেই রিভিউ খরচ করার সাহসটা করে ফেললেন হোল্ডার। তবে শেষ পর্যন্ত উইকেটে সেটি হলো আম্পায়ারস কল, রিভিউটা অক্ষত থাকলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের। 
     


    ব্রড (বাঁয়ে) আছেন/উইন্ডিজ ক্রিকেট



    ব্রড আছেন, ব্রড নেই 

    ২০০৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তানের হ্যামিল্টন টেস্ট দিয়ে ম্যাচ রেফারি হিসেবে অভিষেক হয়েছিল ব্রায়ান ক্রিস্টোফার ব্রড বা ক্রিস ব্রডের। এরপর থেকে ৭ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত ১০০ টেস্ট, ৩২৩টি ওয়ানডে ও ১০৬টি টি-টোয়েন্টিতে আইসিসির ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তবে এর একটিও ইংল্যান্ডের ম্যাচ ছিল না। অবশ্য ২০১০ সালে পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলেছিল ইংল্যান্ডে, সে দুটির ম্যাচ রেফারি ছিলেন ব্রড। 

    এমনিতে আন্তর্জাতিক ম্যাচে ফরম্যাট-ভেদে স্থানীয় আম্পায়ার দায়িত্ব পালন করলেও সাধারণত ম্যাচ রেফারি থাকেন নিরপেক্ষ দেশেরই। ব্রডের নিজ দেশের ম্যাচে দায়িত্ব পালনের সুযোগ এলো বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে, যখন কভিড-১৯ এর কারণে আইসিসি নিরপেক্ষ ম্যাচ অফিসিয়ালের নিয়ম থেকে সরে এসেছে। রিচার্ড কেটেলবোরো বা রিচার্ড ইলিংওর্থেরও ইংল্যান্ডের টেস্টে প্রথম দায়িত্ব পালন এটি। 
     


    তবে ব্রড যেদিন ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ড-ম্যাচে অভিষেক করলেন, সেদিনই বাদ পড়লেন আরেক ব্রড- স্টুয়ার্ট, ক্রিসের ছেলে। দেশের মাটিতে টানা ৫১টি টেস্ট খেলার পর ইংল্যান্ড থেকে বাদ পড়লেন স্টুয়ার্ট ব্রড, ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো। শেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে তিনিই ছিলেন ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, তবে মার্ক উডের ফর্ম, জেমস অ্যান্ডারসনের ফেরা আর জফরা আর্চার ‘ফ্যাক্টর’ মিলিয়ে বাইরেই থাকতে হয়েছে তাকে। অবশ্য এ গ্রীষ্মে ৭ সপ্তাহের মাঝে ৬টি টেস্ট খেলবে ইংল্যান্ড, ব্রড এ টেস্টে না খেললেও আশা করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে বাবা ম্যাচ রেফারি, আর ছেলে খেলছেন- ‘দ্য ব্রড রিইউনিয়ন’। 


    শ্রদ্ধা, একাত্মতা

    ম্যাচের আগে গোল হয়ে দাঁড়ালেন সবাই। এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলো ৯৫ বছর বয়সে চলে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তী স্যার এভারটন উইকসের জন্য। এরপর প্রথম বলের আগে যে যেখানে ছিলেন, হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন। ম্যাচ অফিসিয়াল থেকে শুরু করে ক্রিকেটার, সাপোর্ট স্টাফ-- সবাই। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের হাতে দেখা গেল কালো গ্লাভসও। ক্রিকেট অফিসিয়ালি যেন একাত্ম হলো ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে। 

    এর আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ি পড়েছে দুটি ভিডিও-- সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেসার ও কমেন্টেটর মাইকেল হোল্ডিং ও ইংল্যান্ড উইমেনস দলের হয়ে খেলা প্রথম কালোবর্ণের ক্রিকেটার এবোনি রেইনফোর্ড-ব্রেন্টের দুটি সাক্ষাতকার। যেখানে তারা বর্ণবাদ ও এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান নিয়ে বেশ শক্ত মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, যা নাড়িয়ে গেছে অনেককেই। 

    ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। উইকসকে শ্রদ্ধা জানানোর দিনে ক্রিকেট মিশে গেল আরেকবার জীবনের সঙ্গে। 
     



    গ্যাব্রিয়েল হিটস দ্য টিম্বার 

    আগের বলটা লাইন ধরে রেখেছিল, ডম সিবলি খেলতে গিয়ে মিস করেছিলেন। পরের বলটা ছেড়ে দিলেন, কিন্তু কাল হলো সেটাই। শেষ মুহুর্তে চোট কাটিয়ে ফেরা শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের বলটা বাঁক খেলো, এরপর গিয়ে আঘাত করলো ‘টিম্বার’-এ। হয়তো অনেকের কাছেই ক্রিকেটের সবচেয়ে মিষ্টি শব্দগুলির এটি একটি (অবশ্যই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান আউট হলে)। যে শব্দ এতোদিন মিস করেছেন, সে শব্দ যেন একটু স্বাভাবিকত্বের ঝঙ্কার তুললো। 

    অবশ্য সে শব্দের আরেকটা দিকও আছে, যিনি আউট হন বা যার দলের কেউ আউট হন, তাদের কাছে সেটি বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে ঠেকে। এ শব্দ হয়তো মনে করিয়ে দেবে ইংল্যান্ডকে আরেকটা পরিসংখ্যান। এ টেস্টে ইংল্যান্ডের শীর্ষ ৬ ব্যাটসম্যানের মিলিত অভিজ্ঞতা ১০৯ টেস্টের। এরকম কম অভিজ্ঞ ব্যাটিং লাইন-আপ নিয়ে ইংল্যান্ড এর আগে শেষ খেলেছে ২০০৬ সালে, যেবার শীর্ষ ছয় ব্যাটসম্যানের মিলিত অভিজ্ঞতা ছিল ১০৭ টেস্টের। 


    এবং বৃষ্টি বলে, “ওরে ক্রিকেট”!

    হয়তো আপনি এটাও মিস করেছেন। বৃষ্টির সঙ্গে ক্রিকেটের এই ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কটা। পূর্বাভাস ছিল, সেটি বেশ অবাধেই নামলো সাউথাম্পটনে। টস বিলম্বিত হলো, আগেভাগে লাঞ্চের পর নেওয়া হলো চা-বিরতিও। মাঝে খেলা হতে পারলো মাত্র ১৭.৪ ওভার। বলের হিসেবে ১০৬ বল। খেলা শুরু হয়, বৃষ্টি নামে, খেলা বন্ধ হয়। এই মাঠের কাভার সরে যায়, এই কাভার নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি থামলেও আলো ছিল না পর্যাপ্ত, ফলে প্রথম দিনের স্টাম্পসও হয়ে গেছে। ১১৭ দিন পর টেস্ট ক্রিকেট ফিরলো, অনেক রোমাঞ্চ নিয়ে। ৮২ মিনিটের জন্য।