• লা লিগা
  • " />

     

    ন্যু ক্যাম্পকে যে শূন্যতা 'উপহার' দিয়ে গেল বার্সেলোনার 'দ্বিতীয় ক্লাব'

    ন্যু ক্যাম্পকে যে শূন্যতা 'উপহার' দিয়ে গেল বার্সেলোনার 'দ্বিতীয় ক্লাব'    

    বার্সেলোনার দ্বিতীয় দল তারা।  ঐতিহ্য, জৌলুস কোনোদিক দিয়ে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না। বার্সেলোনায় যারা বার্সা সমর্থন করেন না, তাদের ক্লাব এস্পানিওল। বার্সা প্রতিষ্ঠার এক বছর পর গোড়াপত্তন ক্লাবের। ইউনিভার্সিটি অফ বার্সেলোনার এক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র গড়ে তুলেছিলেন ক্লাবটি। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র সমর্থকদের প্রচেষ্টায় গড়া স্পেনের প্রথম ফুটবল ক্লাবও এস্পানিওল।

    বার্সেলোনার মতো তাদের অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও কাতালুনিয়া পতাকার রঙে রাঙা। বার্সেলোনার মতো স্বাধীতার পক্ষে অতোটা সরব হয়না এস্পানিওল। বরং কাতালানিজিম টেক্কা দিতেই জন্ম তাদের। দুই মেরুর দুই দল হলেও কাতালান ডার্বি তাই এতোদিন উত্তাপ ছড়াত লা লিগায়। গত ২৭ বছর বার্সাকে শীর্ষ পর্যায়ে তাল দিয়ে গেছে এস্পানিওল। সেই এস্পানিওলের যাত্রা থামল অবশেষে। থামল তাদের ‘চোখের বিষ’ ন্যু ক্যাম্পে বার্সেলোনার কাছে হেরে। দুঃস্বপ্নও এতো নিষ্ঠুর হয় না। স্পেনে তাদের চেয়ে বেশি একটানা লা লিগায় খেলেছে কেবল তিন ক্লাব। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা আর অ্যাথলেটিক বিলবাও। সেই ধারায় ছেদ পড়েছে। বাস্তবতার নিষ্ঠুরতম হওয়ার ক্ষমতা আছে। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমের পর আবার সেগুন্দা ডিভিশনে নেমে যেতে হচ্ছে এস্পানিওলকে।


    এস্পানিওলের ঘোরতর বিপদ ঘনিয়ে আসছিল মৌসুমের একেবারে প্রথম দিন থেকে।  গতবার কোচ ছিলেন রুবি, তার অধীনে সপ্তম হয়ে গতবার লিগ শেষ করেছিল এস্পানিওল। রুবি এরপর যোগ দিলেন কিকে সেতিয়েনের ফেলে আসা রিয়াল সোসিয়েদাদে। আর এস্পানিওল দলবদলের মৌসুমে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ইউরো ঢেলে নতুন কোচ হিসেবে ডাগ আউটে বসালো ডেভিড গায়েহোকে। ইউরোপা লিগের বাছাইপর্বেও খেলল এস্পানিওল তার অধীনেই।

    ৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করার মুরোদ এস্পানিওলের কখনই ছিল না। ২০১৬ সালে চায়নিজ গাড়ি প্রস্তুতকারী এক প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫৪ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিল ক্লাবটির। সময়ের পরিক্রমায় সেই মালিকানা প্রায় শতভাগই এখন চায়নিজদের হাতে। এতো টাকা ঢেলেও ব্যর্থ এস্পানিওল। রেলিগেশন মানে তো ক্লাবের অস্তিত্বে টান পড়া।

    রেলিগেশন বাঁচাতে বার্সেলোনার বিপক্ষে জিততে হত এস্পানিওলকে। অবশ্য এরপর বহু কাজ বাকি থাকত। তবে অন্তত ন্যু ক্যাম্পে রেলিগেশন নিশ্চিত করে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হত না তাদের। সব বিপরীতে যাওয়া মৌসুমে ওইটুক স্বস্তিও জোটেনি ক্লাবের। এক মৌসুমে তিনবার কোচ বরখাস্ত করে, চারজন কোচ ব্যবহার করেও ভাগ্য ফেরেনি তাদের। কখনও কখনও বোধ হয় কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয় না।

    অথচ এস্পানিওলের মাঠে শেষ কাতালান ডার্বিতে আবার আলোর রেখা দেখতে পেয়েছিল এস্পানিওল। পুরো মৌসুমে মাত্র একবার রেলিগেশন জোনের বাইরে ছিল তারা। সেটাও পঞ্চম সপ্তাহে। এরপর তারা আসন গেড়ে বসেছে রেড জোনে। ডিসেম্বর নাগাদ তৃতীয়বার কোচ পরিবর্তন, আবেলরাদো নতুন কোচ হয়ে এলেন ডাগ আউটে। জানুয়ারিতে প্রথম ম্যাচই বার্সেলোনার বিপক্ষে। আবেলরাদোর প্রথম ম্যাচে মহামতি বার্সাকেই আটকে দিল দিল এস্পানিওল, ম্যাচ ড্র  হয়েছিল ২-২ গোলে।


    এস্পানিওল সমর্থকেরা প্রেরণা খুঁজতে ফিরে গেলেন ঠিক ১১ বছর আগের জানুয়ারিতে। সেবারও রেলিগেশন জোনে ঘুর ঘুর করছিল এস্পানিওল। অথচ তার দুই বছর আগেও এর্নেস্তো ভালভার্দের অধীনে ইউয়েফা কাপের (বর্তমান ইউরোপা লিগ) ফাইনাল খেলেছিল তারা। ২০০৭ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আরও দুইবার কোচ বদল হয়ে গেছে এস্পানিওলের। দুর্যোগ এড়াতে ২০০৯ জানুয়ারিতে কোচ বরখাস্ত। কোচ মানেকে ফিরে নতুন মানে খোঁজায় মন দিল এস্পানিওল।

    নতুন কোচ হয়ে এলেন মাউরিসিও পচেত্তিনো। মোটে এক মাস আগে যিনি ইউয়েফার প্রো লাইসেন্স পরীক্ষায় উতরেছেন। তার নেই কোনো কোচিং অভিজ্ঞতা। তবে তিনি সাবেক এস্পানিওল খেলোয়াড়। এই পাড়ার ভাও বোঝেন তিনি। এটুকুই তার পুঁজি। পচেত্তিনো ডাগআউটে বসার পর তারও প্রথম ম্যাচ ওই বার্সেলোনার বিপক্ষে, কোপা ডেল রেতে।  কাতালান ডার্বিতে ড্র দিয়ে শুরু করেছিলেন পচেত্তিনোও। পরে পেপ গার্দিওলার বার্সাকে লা লিগায় হারিয়েও দিয়েছিল সেই এস্পানিওল। এস্পানিওলের তরুণ অধিনায়ক ড্যানি জর্কে মারা গেলেন। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার বন্ধু ছিলেন যিনি। এতোকিছুর ভেতরও রাতারাতি বদলে যাওয়া এস্পানিওল সেবার মৌসুম শেষ করেছিল পয়েন্ট টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে।

    পচেত্তিনোর মতো আবেলরাদোর প্রথম ম্যাচে ড্রয়ের পর সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার একটা উপলক্ষ্য পেয়েছিল তাই এস্পানিওল। কিন্তু শুরুটা ভালো হলেও, তিনিও খেই হারালেন। করোনাভাইরাসের স্থগিত হওয়ার পর লিগ ফিরতে না ফিরতেই বরখাস্ত। সাবেক এস্পানিওল কোচ সেই রুবির বেটিসের কাছে হেরে চাকরি হারালেন আবেলরাদো। এস্পানিওল তখন টালমাটাল।

    তার দুইদিন আগে স্যুট প্যান্ট পরা টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলেন ফ্রাঞ্চিস্কো রুফেতো। একদিনের নোটিশে তার কাঁধে এসে পড়ল এস্পানিওলের কোচের দায়িত্ব। লিগে তখন বাকি মোটে ৫ ম্যাচ। এস্পানিওল তখনও তলানিতেই। রুফেতেও এস্পানিওলের সাবেক খেলোয়াড়। পচেত্তিনোর সঙ্গে খেলেছেন, পচেত্তিনোর কোচিংয়ে ২০০৯ এ রেলিগেশন এড়ানো দলেরও অংশ ছিলেন তিনি। তার প্রথম ম্যাচ রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। রিয়ালের সঙ্গে ভালোই টেক্কা দিচ্ছিল তার দল, কিন্তু করিম বেনজেমার এক ব্যাকহিল আর কাসেমিরোর গোলে ভাগ্য আর  ধরাই দিল না।

    যেমনটা ধরা দিল না ন্যু ক্যাম্পেও। বারপোস্টে বল লাগে তবু জালে জড়ায় না। প্রতিবার এস্পানিওল গোলের সামনে গিয়ে হতাশ হয়, ক্যামেরা খুঁজে নেয় গ্যালারিতে মাস্ক পরে বসা রাউল টামুডোর দিকে। এস্পানিওল কিংবদন্তী এখন ক্লাবের সহকারি কোচ। ২০০৬-০৭ মৌসুমে টামুডোর গোলে কাতালান ডার্বিতে পয়েন্ট হারিয়েছিল বার্সা। পরে রিয়াল মাদ্রিদের সমান পয়েন্ট নিয়েও হেড টু হেডে পিছিয়ে থেকে লা লিগা শিরোপা হাত ফস্কে গিয়েছিল রোনালদিনহোদের। কিন্তু রাউল টামুডোর বীরত্বের পুনরাবৃত্তি হয় না ন্যু ক্যাম্পে। লুইস সুয়ারেজের কাছে পোচার মার্কা গোল খেতে হয়। অথচ ন্যু ক্যাম্পে মেসি-সুয়ারেজ-গ্রিযমানদের মতো হীরার চেয়ে ম্যাচের বেশিরভাগ সময় জ্বলজ্বল করেছে ছিল এস্পানিওলই। ভাগ্য সেই রিয়াল মাদ্রিদের মতোই প্রতারণা করলো ন্যু ক্যাম্পেও। যা হওয়ার না, যা হয় না, তা বারবার বদলাতে গেলে বোধ হয় আফসোসই জোটে এভাবে।

    ২০০৯ সালে সেই পচেত্তিনোর এস্পানিওলের পর আর কাতালান ডার্বিতে তাই কেউ হারাতে পারলেন না বার্সেলোনাকে। এই ম্যাচ জিতলেও যে এস্পানিওলের খুব একটা লাভ হত তাও না। দুঃস্বপ্নটা সত্যিই হত। অধবারিত ভাগ্যটা কয়েকদিনের জন্য স্রেফ পিছিয়ে যেত এই যা। বার্সার সঙ্গে এস্পানিওলের মতাদর্শের পার্থক্য সাদা-কালোর মতো পরিস্কার। সারা বার্সেলোনা ঘুরলে শয়ে এক, দুইজনের সঙ্গে হয়ত আপনার পরিচয় হবে, যারা এস্পানিওল করেন। এস্পানিওলের রেলিগেশন নিশ্চিত হওয়ার পর ন্যু ক্যাম্পের আকাশে আতশবাজিও ফুটেছে। ক্লাবের মানে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে বলে কেউ কাউকে দয়া দেখায় না এখানে। সেই দয়া এস্পানিওল চায়ও না।

    কিন্তু  এস্পানিওলের বিদায় কোথাও একটা শূন্যতাও উপহার দিয়ে গেল না বার্সেলোনায়? কাতালুনিয়ার নতুন আরেক ক্লাব জিরোনা আবার লা লিগায় ফেরার জন্য লড়ছে। উতরে যেতে পারলে পরের মৌসুমে কাতালান ডার্বির শূন্যতা হয়ত পূরণ করে দিতে পারবে জিরোনা। কিন্তু জিরোনা ক্লাব হিসেবে একেবারেই নবীন। কাতালুনিয়ার ভেতর বার্সেলোনাকে রক্তচুক্ষু দেখানোর অধিকার তাদের জন্মায়নি, এস্পানিওল যে অধিকার আদায় করে নিয়েছিল বহু আগেই।