• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    দীর্ঘমেয়াদি নয়, সমাধানটা স্বল্পমেয়াদেই?

    দীর্ঘমেয়াদি নয়, সমাধানটা স্বল্পমেয়াদেই?    

    ২০১৩ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২৭ বছরের দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারে যতি টেনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর উত্তরসূরির জন্য। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি। ফার্গুসন নিজেই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে ডেভিড ময়েসকে দায়িত্ব দিয়ে যান।

    কিন্তু বিধি বাম। দায়িত্ব নেয়ার ১০ মাসের মাথায় নিজের পুরনো দল এভারটনের কাছে হেরেই বরখাস্ত হন ময়েস। পরের মৌসুমেই দায়িত্ব দেয়া হয় ফন গালকে। সেই ফন গালও এই মৌসুম শেষে বিদায় নেওয়াটা সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। একসময় যে ক্লাবে ২৭ বছর কোচ বদল হয়নি, সেই ক্লাবই পরের তিন বছরে চারজন কোচ দেখতে যাচ্ছে! শোনা যাচ্ছে, হোসে মরিনহোই হচ্ছেন নতুন কোচ। তার মানে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের রেসিপি ছেড়ে এখন স্বল্পমেয়াদে সাফল্যের পথটাই কি খুঁজছে ইউনাইটেড?

     

    ২.

    ইউনাইটেডের মতো ক্লাবের যখন এই দশা, তখন প্রিমিয়ার লিগের বাকি ক্লাবগুলো কি করছে? ফার্গুসনের অবসরের পর প্রিমিয়ার লীগের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী কোচ এখন আর্সেন ওয়েঙ্গার। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে আর্সেনালের দায়িত্ব নেয়ার পর এখনো কোচ হিসেবে বহাল তবিয়তেই আছেন এই ফরাসি ভদ্রলোক। আর্সেনালকে ৩ বার প্রিমিয়ার লিগ, ৬ বার এফএ কাপ, ৬ বার কমিউনিটি শিল্ড জিতিয়েছেন “লা প্রফেসর”। ওয়েঙ্গারের অবসরের পর আর্সেনালও কি ইউনাইটেডের মতো সংকটে পড়বে ?  

    ইউনাইটেড,আর্সেনালের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ম্যানেজারের রীতিটা সাফল্য এনে দিলেও অন্য বড় ক্লাবগুলো কিন্তু উলটো 'ফর্মূলা'-ই বেছে নিয়েছে।

     

    ৩.

    চেলসিকে দিয়েই শুরু করা যাক। রোমান আব্রামোভিচের আমলেই চেলসি মোট ১০ বার কোচ পরিবর্তন করেছে। মরিনহো, আনচেলেত্তি, স্কলারি, গাস হিডিঙ্ক,আন্দ্রে ভিলাস বোয়াস, ডি ম্যাতিও, রাফা বেনিতেজ - এঁরা সবাই স্থায়ী অথবা অস্থায়ী ভিত্তিতে চেলসির কোচ ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে। কন্তে কিংবা গার্দিওলাকেও ডাগ আউটে আনতে চেয়েছেন এই রুশ ধনকুবের। 

    কিন্তু এই অতিরিক্ত কোচবদল অবশ্য চেলসির জন্য শাপেবরই হয়েছে বলা যায়। ২০০৩ সালের জুন থেকে এই পর্যন্ত লন্ডনের ক্লাবটি মোট ১৫ টি শিরোপা জিতেছে। এরমধ্যে ৪ বার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ৪ বার এফএ কাপ, ১ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ১ বার ইউরোপা লীগ জয় তো আছেই।

    ২০০৮ সালে আরব ধনকুবের শেখ মনসুর ম্যানসিটির মালিকানা কেনার পর মোট দু'বার কোচ পরিবর্তন করেন। সামনের মৌসুম থেকে গার্দিওলাকে ধরলে সংখ্যাটা হবে তিন। মানচিনি ও পেলেগ্রিনির অধীনে ম্যানসিটি মোট দু'বার প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে। আর ব্যর্থতা বলতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভালো ফলাফল করতে না পারা।

    চেলসি, ম্যানসিটির ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার কিন্তু বেশ লক্ষণীয়। খেলোয়াড় কেনায় প্রচুর বিনিয়োগ করলেও তাৎক্ষণিক সাফল্য এনে দিতে না পারলে কোচকে অল্প সময়ের মধ্যেই এখানে বিদায় নিতে হয়। এক্ষেত্রে আব্রামোভিচই সবচেয়ে বেশি খড়গহস্ত হয়েছেন কোচদের ওপর। ম্যানসিটিতে কোচ বদলের ধারাটা চেলসির তুলনায় কম হলেও কোচ খুব কম সময়ই পান দল গোছানোর।

     

    ৪.

    লিভারপুলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম পূর্ণ মৌসুমেই দলকে প্রিমিয়ার লিগ রানার্সআপ করেন ব্রেন্ডন রজার্স। পরের মৌসুমে অবশ্য সে সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি। নতুন খেলোয়াড়দের পেছনে প্রচুর বিনিয়োগের পরেও কাংখিত সাফল্য না পাওয়ায় এই  মৌসুমেই বিদায় নিতে হয় তাকে।

    রজার্সের বদলে দায়িত্ব দেয়া হয় ইয়ুর্গেন ক্লপকে। দায়িত্ব নেয়ার পর লিভারপুলকে এখনো নিজের পছন্দের স্টাইলে অর্থাৎ গেগেনপ্রেসিংয়ে অভ্যস্ত করতে পারেননি ক্লপ। মূলত পরের মৌসুমে তার দলের পারফরমেন্সের উপরই নির্ভর করছে ক্লপের ভাগ্য।

    তবে প্রিমিয়ার লিগ শুরুর পর ক্লপদের সবচেয়ে সফল কোচ রাফা বেনিতেজ কোচের দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ ছয় মৌসুম। তাঁর অধীনে এসি মিলানকে নাটকীয়ভাবে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতে লিভারপুল। এছাড়া একবার করে এফএ কাপ আর উয়েফা সুপার কাপ জেতে তাঁর দল। ক্লপ তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে। নিজের সামর্থ্য প্রমাণের জন্য ক্লপকে কতটুকু সময় দেয়া হয় তাই-ই হবে মূলত দেখার বিষয়।

     

    ৫.

    টটেনহামের ক্ষেত্রে  ম্যানেজার বদলের রীতিটাও খুব বেশি সুখকর হয়নি বলা যায়। হ্যারি রেডন্যাপকে যখন চার মৌসুম শেষে বিদায় করে দেয়া হয়, তখন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আন্দ্রে ভিলাস বোয়াস। মৌসুমের অধিকাংশ সময় চারে থাকলেও স্পার্সরা পাঁচে থেকে সেবার লিগ শেষ করে। এরপরের মৌসুমে ১০০ মিলিয়নের বেশি খরচ করেও বাজেভাবে লিগ শুরু করার খেসারত হিসেবে ভিলাস বোয়াসকে চাকরি খোয়াতে হয়। এরপর টিম শেরউডকে দায়িত্ব দেয়া হলেও মৌসুম শেষে তাঁকেও বরখাস্ত করা হয়।

    তখনকার সাউদাম্পটনের কোচ মরিসিও পচেত্তিনোকে নতুন কোচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এরপর। প্রথম মৌসুমে পাঁচে শেষ করা পচেত্তিনোর দল এই মৌসুমে শিরোপা লড়াইয়ে আছে ভালোমতোই। খোদ আলেক্স ফার্গুসন পর্যন্ত বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে ভালো কোচ হিসেবে পচেত্তিনোর নাম বলেছেন। সময়ই বলে দেবে তিনি নামের প্রতি কতটুকু সুবিচার করতে পারেন।

    আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ব্রেন্ডন রজার্স আর ভিলাস বোয়াস দুই জনই চাকরি হারানোর পর নতুন খেলোয়াড় কেনায় তাদের ভূমিকাহীনতাকে দায়ী করেছিলেন। যে কারণে দায়িত্ব নেয়ার আগে ইয়ুর্গেন ক্লপ নিশ্চিত করে নেন খেলোয়াড় কেনার ক্ষেত্রে তার কথাই শেষ কথা হবে।

    প্রিমিয়ার লীগের ছোট ও মাঝারি সারির দলগুলোর মধ্যেও কোচ বদলের ধারাটা এখন অনেক বেশি। কেবল স্টোক সিটির কোচ মার্ক হিউজই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে (২০১৩ সাল থেকে) দায়িত্বে আছেন। অন্য দলগুলোর মধ্যে ১৯৯৬ সালের পর থেকে নিউক্যাসেল ইউনাইটেড মোট ১১ বার কোচ বদল করেছে! যদিও তাতে চেলসির মত সাফল্য তারা পায়নি।

     

    ৬.

    একটি পরিসংখ্যান না দিলেই নয়। ১৯৯২-৯৩ সালে যখন প্রিমিয়ার লীগের গোড়াপত্তন হয়, তখন একজন কোচ বরখাস্ত হওয়ার আগে গড়ে ২.৬০ বছর দায়িত্বে থাকতেন। আর এখন সময়টা এসে দাঁড়িয়েছে ১.৯৫ বছরে। যদি আর্সেন ওয়েঙ্গারকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তা নেমে আসে ১.৩৩ বছরে!

    এই মৌসুমে এ পর্যন্ত মোট ৩ জন কোচ বরখাস্ত হয়েছেন,আর একজন (সান্ডারল্যান্ডের ডিক এডভোকাট) দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র গত মৌসুমেই চেলসিকে লিগ শিরোপা জেতানো মরিনহোও আছেন। সবচেয়ে বেশি (১২ জন) কোচ তাঁদের চাকরি হারান ২০১৩-১৪ মৌসুমে।

    ভবিষ্যতে আরেকজন ফার্গুসন বা ওয়েঙ্গারের মতো লম্বা দৌড়ের ঘোড়াকে পেতে সমর্থকদের অপেক্ষা সম্ভবত বাড়তেই থাকবে। পচেত্তিনো, ক্লপ, গার্দিওলারা সেই পথে হাঁটতে পারবেন কি না, সে উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা থাক।