• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    আটালান্টার হৃদয় ভেঙে সেমিফাইনালে পিএসজি

    আটালান্টার হৃদয় ভেঙে সেমিফাইনালে পিএসজি    

    ফুলটাইম
    আটালান্টা ১-২ পিএসজি


    শেষটা প্রায় দেখে ফেলেছিল পিএসজি। ঘড়ির কাঁটা ৯০ ছুঁই ছুঁই, তখনও আটালান্টার বিপক্ষে পিছিয়ে পিএসজি। মার্কিনিয়োস এক গোল দিয়ে সমতায় ফেরালেন দলকে। তখন অতিরিক্ত সময়ে গড়াচ্ছে ম্যাচ। কিন্তু নাটক সব জমা ছিল শেষ সময়ের জন্যই। এরিক চুপো মটিং মিনিটখানেক পরই আরেকবার গোল করে বসলেন। তাতে হৃদয় ভাঙল আটালান্টার। আর নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে উঠে গেল পিএসজি।

     


    শেষ মুহুর্তে ম্যাচ হাত থেকে ফস্কে গেলে কেমন লাগে সেটা পিএসজি ভালোই জানে। বার্সেলোনা থেকে প্যারিস- পিএসজি ভরাডুবি দেখেছে বহুবার। হাতের মুঠোয় চলে আসা ম্যাচ চোখের পলকে নাগালের বাইরে চলে গেছে। আরেকবার সেই পান্ডুলিপিটারই মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছিল লিসবনে। আটালান্টার স্বপ্নযাত্রা ঘড়ির কাঁটায় ৯০ মিনিট ছুঁতেও দেখেছে। এরপর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। মার্কিনিয়োস যখন গোল করেছেন তখন ম্যাচে কেবল সমতা ফিরেছে। ডাগ আউটে থমাস তুখলের উল্লাস বলে দিয়েছে মুক্তি মিলেছে পিএসজির। তুখল নিজেও হয়ত আশা করেননি নির্ধারিত সময়েই আরেকবার মচকানো গোড়ালির যন্ত্রণা ভুলে উদযাপন করার সুযোগ পাবেন। চোখের পলকে সব পালটে গেল। এরিক চুপো মটিং আরেক ট্যাপ ইনে গোল করে ম্যাচ আর অতিরিক্ত সময়েও নিতে দিলেন না।  ফাঁকা গ্যালারিতে বসে থাকা আনহেল ডি মারিয়া মার্কো ভেরাত্তিরাও নেমে এলেন তখন। এই মুক্তির আনন্দ পিএসজি জানত না, এবার ট্র্যাজেডিতে আর নায়ক হতে হলো না পিএসজিকে। আটালান্টার কাছে কোনো জবাব নেই, শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে তারা। কেন হলো না, তার জবাব কারও কাছে নেই বলেই না ফুটবলের এই রোমাঞ্চ!

    শেষ মুহুর্তের দুর্দান্ত ফেরায় চ্যাম্পিয়নস লিগ ভাগ্যটাই বোধ হয় বদলে ফেলল পিএসজি। ঘরোয়া লিগ পিএসজির সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে প্রায়। চ্যাম্পিয়নস লিগই ছিল পিএসজির মান যাচাইয়ের টুর্নামেন্ট। কাতারি মালিকানার অধীনে এই প্রথম শেষ চারের দেখা পেয়ে গেরোও খুলেছে প্যারিসিয়ানদের।

    দলের বিচারে আটালান্টা আর পিএসজির তুলনা আকাশ-পাতাল। তবে আটালান্টা অন্য ধাতুতে গড়া। কাউকে পরোয়া করে না তারা। পিএসজির জন্য ম্যাচটা কঠিন হবে সেটা জানাই ছিল। দুইদল আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলবে তাও জানা ছিল। জানা ছিল না নেইমার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবেন ম্যাচের একেবারে তৃতীয় মিনিটেই। গোলরক্ষক স্পোর্তিয়েল্লোর সঙ্গে ওয়ান অন ওয়ানে বক্সের ভেতর ছিলেন নেইমার। সেখান থেকে যখন বাইরে দিয়ে বল মারলেন, সাইডবেঞ্চে থাকা কিলিয়ান এমবাপের তখন মাথায় হাত। এমন সুযোগ আর আসেনি পিএসজির।    

    খানিক বাদে মাথায় হাত পড়ল গোটা পিএসজির। আটালান্টার প্রেসিংয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হলো পিএসজিকে। কেইলর নাভাসকে ১০ মিনিটের মধ্যেই দারুণ দুইটি সেভ করতে হলো। পিএসজিকে চাপে ফেলার সুফল পেতে আটালান্টার অপেক্ষা করতে হলো ২৭ মিনিট পর্যন্ত। দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা জোসিপ ইলিচিচের জায়গায় খেলতে নামা মারিও পাসালিচ করলেন কাজের কাজটা। আক্রমণটা এলোমেলোই ছিল। এর আগে অবশ্য বক্সের বাইরে দ্রুত কয়েকটি পাস খেলল আটালান্টা। দুভান জাপাতার কাছ থেকে বক্সের ভেতর বাম পাশে বল পেয়ে গেলেন পাসালিচ। বাম পায়ের বাঁকানো শটে গোল করেই পিএসজির ভয় বাস্তবে পরিণত করলেন ক্রোয়াট ফরোয়ার্ড।

     


    ডি মারিয়া, এমবাপের অনুপস্থিতিতে নেইমারকে বড় দায়িত্ব নিতে হত। গোল খাওয়ার পর সেই নেইমারই আবার স্বপ্ন দেখালেন। বক্সের বাইরে থেকে তার শট বারপোস্টের ঠিক বাইরে দিয়ে গেল তখন। আটালান্টাও রক্ষণে ভুল করল, হার্তেবোর বল তুলে দিলেন নেইমারকে। এবারও ব্যর্থ নেইমার। সব কাজ ঠিক করেও বক্সের ভেতর কোণাকুণি বাম পায়ের শট মারলেন উড়িয়ে। পিএসজিও বিরতিতে গেল পিছিয়ে থেকে।

    দ্বিতীয়ার্ধে আটালান্টা থিতিয়ে পড়ল কিছুটা। সেই সুযোগে অল আউট অ্যাটাকে আটালান্টার অর্ধেই সময় পার করছিল পিএসজি। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধেও বলার মতো প্রথম সুযোগ পেল সেই আটালান্টাই। বেরাত দিমিতসি দূরের পোস্ট থেকে আড়াআড়ি ভলিটা জায়গামতো মারতে পারলে ৫৮ মিনিটে দুই গোলে এগিয়ে যায় আটালান্টা। পিএসজি তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তুখল এমবাপেকে ডেকে নামিয়ে দিলেন তখন।

    আটালান্টা হাঁপিয়ে উঠেছে আরও আগেই। এমবাপে নামার পর ডিফেন্ডারদের কাজ তাই বাড়ল আরও। আলেহান্দ্রো গোমেজ আটালান্টার আক্রমণের প্রাণ। জিয়ান পিয়েরো গ্যাস্পারিনি তাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্যই হলেন। ৫ মাসে তৃতীয়বারের মতো ম্যাচ খেলতে নামা পিএসজি আর গত দেড় মাসে ১৩ ম্যাচ খেলা আটালান্টার লড়াই ট্যাকটিকস বোর্ড ছাপিয়ে মানসিক লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে সেসময়।

    ৭৯ মিনিটে কেইলর নাভাসকে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো। গোলরক্ষক বদলির পরিকল্পনার তুখলের ছিল না। এক চুপো মটিংকেই নামাতে চেয়েছিলেন তিনি। অগত্যা একসঙ্গে দুই বদলি করাতে হলো তুখলকে। সেই চুপো মটিং ম্যাচ শেষে হয়ে গেলেন নায়ক।

    আলো তিনি কাড়লেও, পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন নেইমার আর এমবাপেই। ম্যাচের প্রথম অংশের স্মৃতি আর তাড়া করবে না নেইমারকে। পুরো ম্যাচে ১৬টি ড্রিবল করে লিওনেল মেসির রেকর্ড ছুঁয়েছেন তিনি। মেসি যেভাবে বার্সাকে টেনে তোলেন, নেইমারও পিএসজিকে টেনে তুললেন।

    চ্যাম্পিয়নস লিগে আগের ৩২ ম্যাচের সবগুলোতে গোল করেছে পিএসজি। তাদের আটকে রাখা সহজ নয়। মার্কিনিয়োসের গোলটা যদিও চোখের জন্য তৃপ্তিদায়ক কিছু নয়। ডায়াগোনাল বল বক্সের ভেতর বাম পাশে পেয়েছিলেন নেইমার। এরপর নিচু ক্রস করেছেন তিনি গোলের সামনে। সেই পাস আটালান্টার খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে গেল আরেক ব্রাজিলিয়ানের কাছে। মার্কিনিয়োস তখন এক টোকায় ম্যাচে ফেরালেন দলকে।

    ১৪৯ সেকেন্ড পর নেইমার বক্সের ঠিক বাইরে থেকে সেই একই জায়গায় বল বাড়ালেন এমবাপের উদ্দেশ্যে। আরেকবার কাটব্যাক, মার্কিনিয়োস ফাঁকায় ছিলেন। চুপো মটিংকে দৌড়ে কিছুটা জায়গা করে নিয়ে বলের শেষ মাথায় পৌঁছে স্লাইড মেরে বল ঢুকিয়ে দিলেন জালে। পিএসজির দুর্দান্ত ফেরার গল্প লেখা হয়ে গেল তাতে।

    শেষ মুহুর্তে ম্যাচ জিততে কেমন লাগে তা এতোদিন জানা ছিল না পিএসজির। এবার তারা সেমিফাইনালে খেলার স্বাদটাও পাবে। এক লেগের টুর্নামেন্টে এরপরের পথটাও তো দেখতে পাওয়ার কথা তুখলের। গ্যাস্পারিনির বিপক্ষে তার ট্যাকটিকস ভালোই কাজে দিচ্ছিল। আটালান্টার প্রেসিং অমান্য করে লং বলে একের পর এক আক্রমণ সাজাচ্ছিল পিএসজি। কিন্তু ব্যক্তিগত ভুল আর সিদ্ধান্তহীনতায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না। শেষে এসে দুইটি অপ্রত্যাশিত গোলেই কপাল খুলল তাদের।

    গ্যাস্পারিনি ম্যাচের আগে বলেছিলেন দুই লেগের টাই হলে তার দলের সম্ভাবনা বেড়ে যেত। এই ম্যাচের পর তার সেই কথা বোধ হয় আরেকবার মনে পড়বে বের্গামোর লোকদের। আটালান্টার অবশ্য হারানোর কিছু ছিল না। ইতালিতে করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শহরে আজ রাস্তাঘাটে টিভি বসিয়ে খেলা দেখেছেন সেখানকার লোকেরা। এমন সাহসী লড়াইয়ের পর গর্ব করার মতো পুঁজি জুটেছে তাদেরও। 


    পিএসজি একাদশ
    নাভাস, কেহরের, সিলভা, কিমপেম্বে, বের্নাট, মার্কিনিয়োস, হেরেরা, গায়া, সারাবিয়া, নেইমার, ইকার্দি

    আটালান্টা একাদশ
    স্পোর্তিয়েলো, তোলোই, ক্লাদারা, দিমিৎসি, হাতেবোর, ডে রন, ফ্রিউলার, গোসেন্স, পাসালিচ, গোমেজ, জাপাতা