• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    বার্সেলোনার পতন : তলানির শেষ কোথায়?

    বার্সেলোনার পতন : তলানির শেষ কোথায়?    

    স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের কাছে আর নতুন শিরোনাম নেই। রোম, রোমের পর অ্যানফিল্ড, অ্যানফিল্ডের পর লিসবন- টানা তিন বছর সৃজনশীলতা দেখানো মুশকিলও বটে। খেলায় লজ্জার কিছু নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই শব্দটাই জুড়ে দিতে হয়েছে বার্সেলোনার অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে। জেরার্ড পিকে নিজেও সেটাই বলেছেন। নাটকীয় ব্যর্থতা, ঐতিহাসিক ব্যর্থতা- বার্সেলোনা তলানিতে গিয়ে ঠেকছে।

    এমন নয় অশনী সংকেত বার্সা আগে পায়নি। বায়ার্ন মিউনিখ দাপট দেখাবে সেটাও অনুমিত ছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বারবার বাদ পড়াও এমন বড় কিছু নয়। কিন্তু যেভাবে, যে ঢংয়ে বার্সা বাদ পড়েছে সেটাই আশঙ্কাজনক। লিওনেল মেসি এমন কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন। আঁচ করতে পারার কথা তার বাকি সতীর্থদেরও। লা লিগার শেষ ম্যাচে মেসি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, এই খেলায় কাজ হবে না।  

    বার্সেলোনা সমর্থকেরা দুঃস্বপ্নের রাত পার করেছেন। এই রেশ দ্রুত কাটার কথা নয়। গত এক যুগে বেশিরভাগ সময় ইউরোপ শাসন করেছে বার্সেলোনা। এরপর পতনটা এর চেয়ে নাটকীয় হতে পারত না। পতন বার্সা আগেও দেখেছে। সবশেষ ২০০৬-০৭ মৌসুমে শিরোপাহীন কাটিয়েছিল বার্সা। ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের সেই দলও ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরপর পেপ গার্দিওলা কোচ হয়ে এলেন, ইউরোপকে নতুন করে হাইপ্রেসিং আর পজেশনাল ফুটবল শেখাল বার্সা। ফুটবলের চেহারাই এরপর পালটে গেছে। এই ফ্লুইড পাসিং ফুটবলের আরও কতোগুলো ফলিত শাখা ইউরোপের নামী দামী দলগুলো রপ্ত করেছে। সাফল্যও পেয়েছে। বায়ার্ন মিউনিখও সেই দলগুলোর একটি। বার্সা আনুষ্ঠানিক আত্মসমপর্ণ করলো নিজেদের শেখানো কৌশলের কাছে। বায়ার্নের বুলডোজারে মিশে যাওয়ার পর।


    ২০১৮-এর রোমের রাতটা দুঃস্বপ্ন ছিল বার্সার। ঘরের মাঠে ৪-১ গোলে জয়ের পর পরের লেগে ৩-০ গোলের হার। ওই হারের কষ্ট বার্সাকে ভুগিয়েছে অনেকদিন। নতুন মৌসুমের শুরুতে মেসি ন্যু কাম্পে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবার তারা চ্যাম্পিয়নস লিগের জন্য লড়বেন সব কিছুর বিনিময়ে। ২০১৯-এ অ্যানফিল্ডে যা হল তা আরও বাজে। বার্সার ৩-০ গোলের প্রথম লেগের লিড নিমিষেই উড়িয়ে দিল লিভারপুল। বার্সেলোনার পতন তখন আরেকবার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বার্সা সেবারও বদলায়নি।

    এবার বায়ার্নের কাছে ‘লজ্জার’ হার। এই হার কোনো ব্যাখ্যা চায় না, কোনো যুক্তি তর্কও খাটে না। এটা তলানি। এরপর হাহাকার। এরপর আর কিছু নেই, মহাশুন্য। এটা এক ম্যাচের হার নয়, এক মৌসুমের ব্যর্থতাও নয়। লম্বা সময় ধরে বার্সেলোনার পতনের ফল। এই হার নৃশংস, এই হার মর্মান্তিক। ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনার আগাগোড়া ব্যর্থতার ফল। অজনপ্রিয় বোর্ড, দলবদলে একের পর এক ব্যর্থতা, কোচ বাছাইয়ে অদূরদর্শীতা- এসব গল্প সেই অ্যানফিল্ডের পর থেকেই জানা ছিল। বায়ার্ন মিউনিখ আরেকবার শুধু উস্কে দিয়েছে সবকিছু। এরপর জেরার্ড পিকেও বলতে বাধ্য হয়েছেন, দরকার হলে তিনিই সরে যাবেন সবার আগে, কিন্তু এই ক্লাব আবার ঢেলে সাজাতে হবে।

    কিকে সেতিয়েনকে সরিয়ে দেওয়া হবে সেটা নিশ্চিত। এখনও যে তাকে সরানো হয়নি সেটাই বরং চমক জাগানিয়া। সেতিয়েনের ফুটবল প্রজ্ঞা প্রশংসার দাবিদার, বার্সার কোচ হওয়ার আগে স্পেনে সুনাম কুড়িয়েছিলেন নিজের দর্শন পুঁজি করে। তাকে বরখাস্ত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না।  কিছুই বদলাবে না। তাকে আনাও ছিল ভুল, আবার বরখাস্ত করলেও নেই সমাধান। ধন্ধে পড়ে গেলেন? বার্সার অবস্থা ঠিক এতোটাই জটিল।

    এর্নেস্তো ভালভার্দেকে বরখাস্ত করে যেমন কোনো লাভ হয়নি। ‘বেচারা’ দুই মৌসুমে বার্সেলোনাকে লিগ শিরোপা জিতিয়ে পরের মৌসুমে মাঝামাঝি সময়ে বলি হয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ব্যর্থতার জন্য।  

    ভালভার্দেকে বরখাস্ত করার পর সেতিয়েন ছিলেন বার্সার সম্ভাব্য কোচের তালিকায় চতুর্থ। আগের তিনজনের ভেতর জাভি ছিলেন, রোনাল্ড কোমেনও ছিলেন। জাভি এই বোর্ডের অধীনে ফিরতে চান না। কার্লোস পুয়োলও এই বোর্ডে ভরসা পাননা। কোমেন নেদারল্যান্ডসে কাজ করছেন। সাবেক খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোর্ডের দূরত্ব স্পষ্ট। ২০২১ সালের আগে বার্সেলোনার নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাও কম। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হোসে মারিয়া বার্তোমেউয়ের ওপর ভরসা নেই কারও।

    বার্তোমেউ চাইলেও রাতারাতি ক্লাবের চেহারা ফেরাতে পারবেন না। দলবদলে তিনি দেদারসে টাকা ঢেলেছেন। টাকার সঙ্গে বুদ্ধিটা ঢালতে পারেননি শুধু। যেমন ফিলিপ কৌতিনহো, বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়। বার্সেলোনার বিপক্ষে ৮ গোলের শেষ দুইটি করেছেন তিনি। উদযাপন করেননি, করতেও চাননি। ওই দুই গোল বার্সেলোনার দুই গালে দিয়েছে দুই চড়। ২০১৭ সালে নেইমারকে পিএসজির কাছে দিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া ২২২ মিলিয়ন ইউরোর পুরোটাই সফলভাবে পানিতে ঢালতে সমর্থ হয়েছেন বার্তোমেউ। উসমান ডেম্বেলে, কৌতিনহোর পর অ্যান্টোয়ান গ্রিযমানকে কিনতে বরং ২২২ মিলিয়নের সঙ্গে আরও অর্থ যোগ করতে হয়েছে বার্সাকে।

    বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা বাকি যেকোনো দলের চেয়ে গড়ে বেশি বেতন পান। তাদের বেতন সচল রাখতে হবে। গত কয়েক দলবদলে টাকার বস্তা ঢালার পর, এখন চাইলেও সব নতুন করে শুরু করতে পারবে না বার্সেলোনা। সেই টাকা কই? নতুন কোচ এসে এই খেলোয়াড়দের আর কী বদলাবেন?


    লিওনেল মেসি, সার্জিও বুসকেটস, জেরার্ড পিকে, লুইস সুয়ারেজ, জর্দি আলবা- সবাই তিরিশ পেরিয়ে গেছেন। তিরিশ পেরুলেই যে খেলা শেষ, তা নয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার সঙ্গে দলে তারুণ্য থাকতে হয়। বায়ার্নের মারদাঙ্গা প্রেসিংয়ে এই দল উদ্ভ্রান্তের মতো খেই হারাবে সেটা অজানা থাকলে আপনি নিয়মিত ফুটবল দেখেন না। বার্তোমেউরা নিয়মিত খেলা দেখেন, তাদের খোঁজ খবর রাখতে হয়। পরীক্ষায় জানা প্রশ্নের ভুল জবাব দিয়ে আসলে আপনি কেবল নিজেকেই দুষতে পারেন। এরিক আবিদাল টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হয়েছেন বার্তোমেউয়ের আমলেই। আবিদাল থাকায় সুফল পাওয়ার কথা ছিল বার্সার, তাও হয়নি। উলটো এখন বোঝাই হয়ে গেছেন আবিদাল। তিনিও চাকরি হারাতে যাচ্ছেন।      

    ২০১৩-১৪ মৌসুমের পর দল দলবদলের বার্সার খরচ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। দলবদলে এই সময়ে ৩০ জনের বেশি খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়েছে বার্সা। নেইমার, লুইস সুয়ারেজ, ইভান রাকিটিচ ছাড়া এদের ভেতর সফলদের তালিকায় আর কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। স্টেডিয়াম সংস্কারের কাজ আগামী বছর শেষ হওয়ার কথা ছিল, সেটি এখনও শুরুই করতে পারেনি বার্সা। এর সঙ্গে করোনাভাইরাসের জন্য আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই। দলবদলে বার্সার অদক্ষতার শেষ প্রমাণ আর্থার মেলো। ২০১৮ সালে তিনি বার্সায় যোগ দেওয়ার পর মেসি বেশ উচ্ছ্বসিতই ছিলেন। আর্থারে জাভির ছায়া দেখেছিলেন মেসি। সেই আর্থারকে এবার জুভেন্টাসে দিয়ে মিরালেম পিয়ানিচকে দলে ভিড়িয়েছে বার্সা। কারণটা মোটেও ফুটবলীয় নয়। অর্থ বছর শেষে আয়-ব্যয়ের হিসেব ঠিক দেখাতে আর্থারকে বিক্রি করেছে বার্সা বোর্ড। 

    বার্সেলোনার আইডেন্টিটি যুব প্রকল্প। অজানা কারণেই সেই লা মাসিয়ার পাইপলাইনও বন্ধ। ২০১২ সালে পেপ গার্দিওলা ক্লাব ছাড়ার পর তিতো ভিলানোভা দায়িত্ব নিলেন। তিনি এক ম্যাচে এমন এক একাদশ নামালেন যার আগাগোড়া পুরোটাই সেই লা মাসিয়ার। মেসি, পিকে, আলবা, বুসকেটসরা এখনও আছেন, কিন্তু এই ৮ বছরে এক সার্জি রবার্তো ছাড়া এখনও একাদশে নিয়মিত হতে পারেননি আর একজন খেলোয়াড়ও। গেল কয়েক বছরেও সম্ভাবনাময় একগাদা তরুণদের ক্লাব ছাড়া করে, কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে বিশ্বমানের খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়েছে বার্সা। তাতে সাফল্য মিললে হয়ত পার পেয়ে যেতেন বার্তোমেউ। উলটো আম আর ছালা দুটোই হারানোর দশা হয়েছে। সেই আইডেন্টিটি এখন ধ্বংসাবস্থায় পরিণত হয়েছে বার্সায়।

    ফুটবলের সবচেয়ে রোমান্টিক ক্লাব ধরা হয় বার্সাকে। এখানে শিরোপা শেষ কথা নয়। আপনাকে একটা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলতে হবে। বার্সার ডিএনএ সেটা। ভালভার্দেও ঠিক সে কারণেই বরখাস্ত হয়েছিলেন, সমর্থকদের মন ভরাতে পারেননি তিনি। কিন্তু ভুল সময়ে। রোমের পর বরখাস্ত হতে পারতেন ভালভার্দে, প্রথম মৌসুমে লা লিগা জয়ের পরও তেমন কিছু হলে সেটা অন্যায্য হত। অ্যানফিল্ডে টানা দ্বিতীয়বার একই ঘটনার পর ভালভার্দের বার্সার ডাগআউটে থাকা ছিল বড় চমক। আগস্টে যার ওপর ভরসা রাখা গেল, সেই ভালভার্দে পয়েন্ট টেবিলের এক নম্বরে দলকে রেখেও জানুয়ারিতে গিয়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সারির টুর্নামেন্ট স্প্যানিশ সুপার কাপে হারের পর! আপনি ভাবতে পারেন, এটাই বোধ হয় সায়েন্স!

    ভালভার্দের বড় ক্লাবের অভিজ্ঞতা ছিল না। ইউরোপের নাটকীয় রাতে আপনাকে তীক্ষ্ণ হতে হবে, সাহসী হতে হবে। ভালভার্দে সাহসিকতা দেখাতে পারেননি। তার বদলে যিনি এলেন, সেই সেতিয়েন আরও অনভিজ্ঞ। ভালভার্দে তাও বার্সার হয়ে কিছুদিন খেলেছেন, সেতিয়েন ২০১৯ এর গ্রীষ্ম থেকে কোচিং পেশা থেকে সরে গিয়ে অবসর কাটাচ্ছিলেন!  সেতিয়েন চ্যাম্পিয়নস লিগে তো বার্সার ভাগ্য ফেরাতে পারলেনই না, লা লিগাটাও হারালেন। রুপকথার গল্প লিখতে চেয়েছিল বার্সা, সেটা হয়ে গেছে ট্র্যাজেডি।

    সমর্থকেরা যেমন ফুটবল চান, তা সবশেষ দেখা গেছে লুইস এনরিকের আমলে। এমন নয় শিরোপাবিহীন মৌসুম এই প্রথম কাটাচ্ছে বার্সা। তবে ২০০৭ এর সঙ্কট এবারের মতো ভয়ঙ্কর নয়। এক গার্দিওলা এসে বার্সার ইতিহাসটাই নতুন করে লিখেছিলেন, বদলে দিয়েছিলেন সবকিছু। এবারের বার্সার চারিদিকে ঘোর অমানিশা।

    ১৩ বছর আগে মেসির বয়স ছিল ২০। মেসি আর বার্সেলোনার গল্প ভালোবাসার। ফুটবলের সুন্দরতম গল্পগুলোর একটি। এই ১৩ বছরে বার্সার সব সাফল্য মেসির নেতৃত্বে। সম্ভবত ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়ও মেসি। কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ ভাবার সময় তো তারও এসে গেছে। বয়স এখন ৩৩। সবশেষ যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিলেন তখন তার বয়স ৩০-ও হয়নি। মাঝের এতোগুলো বছরে যোগ্য সঙ্গীর অভাব বারবার মেসিকে অপদস্ত করেছে।

    এই ক্লাবে ডিয়েগো ম্যারাডোনা খেলেছেন. ইয়োহান ক্রুইফ তো নিজ হাতেই গড়ে দিয়েছেন ক্লাবের কাঠামো- তাদের কেউ এমন সময় দেখেননি। মেসি দেখেছেন। মেসি ক্ষয়ে যেতে দেখেছেন। একটা সময় নিজের চরিত্র বদলে ‘ভাষণ’ দিয়ে দলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টাও করেছেন। মেসি ঠিক নেতা গোছের কেউ নন, সময় আর পরিস্থিতি তাকেও বাধ্য করেছে খোলস ছেড়ে বেরুতে। বলাই বাহুল্য, তাতে বার্সার উপকার হয়নি।
     


    বরং বোর্ডের সঙ্গে মেসির দূরত্ব বেড়েছে। গত জানুয়ারিতেও এক সময়ের সতীর্থ আবিদালের প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন মেসি।  পরে বার্তোমেউ দুইজনকে ডেকে মিটমাট করেছেন ঝগড়ার। মার্চের শেষে করোনাভাইরাসের কারণে দিকে বেতন কাটা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছিল জটিলতা। রীতিমত ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়ে তখন নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন মেসি। এর কিছুদিন পর বার্সার বোর্ডের ৬ জন কর্মকর্তা একই দিনে পদত্যাগ করেছেন। সে আরেক ইতিহাসের জের ধরে। স্প্যানিশ রেডিওর কাদেনা সারের এক রিপোর্টে দাবি করেছিল, বার্সার বোর্ডই নিজেদের খেলোয়াড়দের দুর্নাম ছড়াতে আলাদা সোশ্যাল মিডিয়া দল ভাড়া করেছিল। পরে অবশ্য বার্সা সেই অভিযোগ উড়িয়েই দিয়েছে। 

    ক্লাব ফুটবল মেসির মতো প্রভাবশালী ফুটবল আগে দেখেনি কখনও। কোচ বদল থেকে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সবকিছুতেই মেসির প্রভাবের গন্ধ খুঁজে পান অনেকেই। যদিও এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। তবে মেসি যদি বার্সায় বিপ্লবের ডাক দেন, চে গুয়েভারার মতো না হলেও তাতে ছোটখাটো একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য তিনি রাখেন। বার্সার ইতিহাসে মেসির যা অবদান, এসব তার ফল।

    বায়ার্নের বিপক্ষে ওই ‘লজ্জার’ স্কোরলাইন তাই বার্সার সমস্যা না। ৮ গোল এখন সংখ্যামাত্র। বার্সাকে এই দুঃস্বপ্ন আরও কিছুদিন তাড়া করে ফিরবে। কিন্তু এসব আদতে সমাধানযোগ্য। কিন্তু বার্সার সঙ্কট, বার্সার সমস্যা আরও গভীর। কাঠামোগত ক্ষয়ের ফল যেমন একদিনে বার্সা পায়নি, সুফলও হুট করে আসার সম্ভাবনা নেই।

    মেসি একা কী করবেন? এই কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে কয়েকদিন ধরে। তাতে কারও কারও মোটাদাগে মনে হতে পারে সমস্যাটা মেসি নিজেই। এই ক্লাবে মেসি সমস্যা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও নাশ করে দিয়েছেন বহু আগে। ক্লাবের মেসাইয়া তিনি। যে টুর্নামেন্ট নিয়ে এতো কথা, সেই চ্যাম্পিয়নস লিগে ২০১৭ সালের পর থেকে মেসির পর বার্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা আত্মঘাতী গোল। চ্যাম্পিয়নস লিগের অ্যাওয়ে ম্যাচে গত দুই বছর মেসি বাদে বার্সার কেউ গোল করেছেন একবার। তাও এই গেল ফেব্রুয়ারিতে নাপোলির বিপক্ষে গ্রিযমান গোল করে খরা কাটিয়েছেন।

    বার্সার মেসি নির্ভরতা শেষ পর্যন্ত বার্সার বিপদ ডেকে এনেছে। ২০০৯, ২০১১ তে বার্সার সোনালী প্রজন্ম, ২০১৫ তে নেইমার-সুয়ারেজদের অবদান- মেসি নিজের কাজটা তখন ঠিকঠাক করে যেতে পেরেছেন নিয়মিত। মেসি, রোনালদোর মতো খেলোয়াড়রা বারবার আসেন না। তারা প্রতি মৌসুমে সমর্থকদের মতোই শিরোপা জিততে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। ফুটবল দলের খেলা, ব্যক্তি এখানে মুখ্য নন। দিনশেষে লোকে নায়ক খোঁজে, মেসি-রোনালদোরা তাই নায়কের আসনে বসেন ঠিকই। কিন্তু যারা ফুটবল বোঝেন দলের অর্জন খাটো করে দেখেন না তারা। ২০১৫ এর আগে থেকেই জাভির উত্তরসুরি খুঁজছিল বার্সা। তা এখনও পায়নি তারা, এর ভেতর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা চলে গেছেন, বুসকেটস সেরা সময় ফেলে এসেছেন, সুয়ারেজও বুড়িয়ে গেছেন- অথচ এসব ইঙ্গিত আগে থেকেই পাওয়ার কথা ছিল বার্সার।

    এরপরও গত তিন বছরে দুইবার লা লিগা জিতেছে বার্সা। এই শিরোপাগুলো এখন সর্বনাশাই মনে হওয়ার কথা সমর্থকদের কাছে। তাতে আরও আগে হয়ত ঝড় সামাল দেওয়ার সুযোগ মিলত। ওই শিরোপাগুলো বরং শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে সাহায্য করেছে বার্সাকে। এরপর দিনশেষে পরিণতি হয়েছে করুণ।

    একটা ব্যাপার নিশ্চিত, বার্সায় বড় পরিবর্তন আসছে। এই দলের পক্ষে আর লড়াই করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তন হবে ধীরগতির, সাফল্যও অনিশ্চিত। পরিবর্তন মুখে বলা সহজ, বাস্তবতা বার্সার জন্য কঠিন।  মেসি তার শেষ বয়সে আরেক বিপ্লবের আশায় থাকবেন না  হয়ত। বার্সার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন সেই শঙ্কাও এখন তৈরি হয়েছে। মেসি হয়ত শেষ পর্যন্ত থাকবেনই, তবে সম্ভাব্য ‘নতুন বার্সায়’ও হুট করে ৩৩ বছর বয়সে তিনি একা কী করবেন, সেই অনিশ্চয়তাও থাকছে।

    বায়ার্নের কাছে হারের পর মার্কা লিখেছিল, মেসির সিংহাসন বাতাসে দুলছে। বার্সা সিংহাসন হারিয়েছে বহু আগে। বার্সার প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্কট এবার ঈশ্বরের আসনে আরোহন করা মেসিকেও ঝুলিয়ে দিয়েছে। বার্সা সমর্থকদের জন্য সময়টা অন্ধকারই।