• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    লাইপজিগকে হারিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে পিএসজি

    লাইপজিগকে হারিয়ে স্বপ্নের ফাইনালে পিএসজি    

    ফুলটাইম
    লাইপজিগ ০-৩ পিএসজি


    চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা সাত মৌসুম নক আউট পর্ব থেকে বিদায়। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে প্রথম চারবার, পরের তিনবার দ্বিতীয় রাউন্ড। এই সময়ে ফ্রান্সের সিংহাসনে গেঁড়ে বসেছে প্যারিসিয়ানরা। তবে ইব্রাহিমোভিচ থেকে নেইমার- দলবদলের বিরাট অঙ্কের টাকা নিশ্চয়ই ঘরোয়া সাফল্যের জন্য ব্যয় করেনি পিএসজি! আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্ক সঙ্গী করে পিএসজি এতোদিন ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে। সেই খরা কাটলো এবার। ক্লাব প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশতম বর্ষে এসে।

    লাইপজিগ আরও নতুন ক্লাব। কোচ উলিয়ান নাগেলসমানের বয়স ৩৩। কাতারি মালিকানার পিএসজি আর রেডবুলের লাইপজিগ- চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল অন্যরকম এক পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। লাইপজিগের তারুণ্য তাতে হার মেনেছে অভিজ্ঞ আর বিশ্বমানের খেলোয়াড়ে ঠাসা পিএসজির কাছে। আনহেল ডি মারিয়া, নেইমার, কিলিয়ান এমবাপে- আক্রমণভাগের বাঘা বাঘা নামগুলো সব জ্বলে উঠলেন এক রাতে। তাতে পুড়ে ছাড়খাড় নাগেলসমানের লাইপজিগ। লাইপজিগের ডানা কেটে নিজের ডানা প্রশস্ত করে এক গোল আর দুই অ্যাসিস্টে ডি মারিয়াই আলো কাড়লেন বেশি।


    প্রথমার্ধে দুই, পরের অর্ধে আরও এক গোল- পিএসজি লাইপজিগকে সেমিফাইনালে দাঁড়াতেই দেয়নি। ঠিকমতো নড়েচড়ে বসার আগে আরও একবার দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন নেইমার। এবার একাদশে ফেরা এমবাপে দিয়েছিলেন তাকে থ্রু পাস। নেইমার আবার সুযোগ নষ্ট করেছেন তখন, তার শট লেগেছে বারপোস্টে।

    প্রথম সেমিফাইনাল, প্রতিপক্ষ তার কোচিংয়ের গুরু থমাস তুখল। লিসবনের গরম অবশ্য নাগেলসমানকে ফিটফাট হওয়া থেকে দূরে রাখতে পারল না। ফ্যান্সি স্যুট, মোজা ছাড়া জুতো- তাকে দেখে কোচের বদলে সিইও মনে হলো খানিকক্ষণ। তবে লাইপজিগের মাঠের খেলায় প্রথম দশ মিনিটে টের পাওয়া গেল এই দলের কোচ তিনিই। বল ছাড়া আর বল পায়ে অন্তত তিন থেকে চার রকমের ফরমেশনে শুরু করেছিল লাইপজিগ। এর কিছুই অবশ্য কাজে দেয়নি, তুখল ফ্ল্যাট ৪-৪-২ ফরমেশনে ভরসা রেখেছিলেন তার দলের খেলোয়াড়দের সামর্থ্যের ওপর। কেউ তাকে হতাশ করেননি।

    ১৩ মিনিটে লাইপজিগের বক্সের বাম কোণায় ফ্রি কিক পায় পিএসজি। নেইমার, ডি মারিয়া দুজনই দাঁড়িয়েছিলেন। পরেরজনই বক্সের ভেতর মারলেন বাঁকানো কিক। লাইপজিগ গোলরক্ষক পিটার গুলাশিও ধন্দে পড়ে এগিয়ে গেলেন, লাইপজিগের ডিফেন্স লাইন ততক্ষণে  মার্কিনিয়োসের নাগাল ছেড়ে দিয়েছে। লাফিয়ে উঠে হেডে আবার গোল করলেন মার্কিনিয়োস। আগের ম্যাচে তার গোলে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল প্যারিসিয়ানরা, এবার পেল স্বস্তি।

    নাগেলসমান এরপর তার ব্লেজার খুলতে বাধ্যই হয়েছেন। রক্ষণে উপামেকানোদের দুর্বলতা একটু একটু করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে তখন। এমবাপে আর নেইমাররা টার্গেট করেছেন তাদের। ৩৪ মিনিটে গোল থেকে ২৫ গজ দূরে সাইডলাইনের কাছ থেকে পিএসজি ফ্রি কিক পাওয়ার পর লাইপজিগের রক্ষণও তেমন কিছুই ভেবেছিল হয়ত। এবারও সেই দুজনই দাঁড়ালেন ফ্রি-কিক নিতে। কিন্তু এবার মারলেন নেইমার, ডিফেন্স লাইন ভেদ করার চেষ্টায় না গিয়ে সরাসরি মারলেন গোলেই। গুলাশি কাছের পোস্ট থেকে সরে এসেছিলেন, ভাগ্য তার আগেরবারের মতোই ভালো। নেইমারের এই শটও গিয়ে লাগলো বারপোস্টে।

    লাইপজিগ এর ভেতর একটা সুযোগ পেয়েছিল। মার্সেল সাবিদজার বক্সের ভেতরে বল পেয়ে গিয়েছিলেন ভালো জায়গায়। কিন্তু তার ভলি গেছে বাইরে দিয়ে। এরপর লাইপজিগ আরও খোলসে ঢুকেছে। পিএসজিও প্রেস করে বিপদে ফেলতে শুরু করে দিয়েছে তাদের। ততোক্ষণে ফুটবলটাও উপভোগ করা শুরু করে দিয়েছে প্যারিসিয়ানরা।



    বিরতির আগে সেই গুলাশি পিএসজির উপভোগকে পরিণত করলেন উদযাপনে। নিচ থেকে খেলা বিল্ড আপ করতে যে ধার থাকা দরকার, সেটা লাইপজিগের মধ্যে দেখা গেল না। গুলাশি বল দিয়ে দিলেন বক্সের ঠিক সামনে, পিএসজির পায়ে। নেইমার, ডি মারিয়া দুইজনই ঢুকে পড়লেন বক্সে, ডান পাশ থেকে বল এলো নেইমারের কাছে। দারুণ এক ফ্লিকে পেছনে থাকা ডি মারিয়াকে বল দিলেন তিনি। ডি মারিয়া এক টাচে বল থামিয়ে, দ্বিতীয় টাচে গোলের সামনে থেকে বল জড়ালেন জালে। আরও একবার লাতিন আমেরিকানরাই এগিয়ে নিয়ে গেলেন পিএসজিকে।

    পাহাড় অতিক্রম করতে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই এমিল ফর্সবার্গ আর প্যাট্রিক শিককে নামালেন নাগেলসমান। ফর্সবার্গ সেটপিসে লাইপজিগকে কিছুটা ভরসা যুগিয়েছিলেন, তবে আশাজাগানিয়া তেমন কিছু করা হয়নি তার। বরং ৫৬ মিনিটে আরেক গোল দিয়ে পিএসজি লাইপজিগের সম্ভাবনা শেষ করে দিল চিরতরে।

    এবারও অ্যাসিস্ট ডি মারিয়ার। আগের ম্যাচে নিষেধাজ্ঞার কারণে ছিলেন না তিনি। পিএসজি তার অভাব বোধ করেছে। লাইপজিগে ফিরে আর্জেন্টাইন খেলেছেন মনে রাখার মতো এক ম্যাচ। পিএসজির জয়েও সবচেয়ে বড় অবদান তারই। বাম প্রান্ত থেকে ডি মারিয়ার ক্রসে গোলের সামনে থেকে হেড করেছেন ফুলব্যাক হুয়ান বের্নাট।

    ম্যাচের আগে পিএসজি কোচ তুখল দলের শক্তির ওপর ভরসা রেখেছিলেন। বাকি সময় লাইপজিগ দেখেছে পিএসজির দলগত শক্তি। পিএসজি ব্যবধান বাড়াতে পারত, এমবাপে গোলের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। তবে গুলাশি তাকে গোল পেতে দেননি।

    পিএসজির এই একাদশে সবচেয়ে নড়বড়ে ছিলেন বোধ হয় সার্জিও রিকো। কেইলর নাভাস ইনজুরিতে না পড়লে তার খেলার সুযোগই হয় না। এমবাপের ওই শটের পর লাইপজিগ কিছু সময়ের জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল আক্রমণে। ম্যাচের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সেভটি তখন করেছেন রিকো।    

    নেইমার বা এমবাপের কপালে গোল জোটেনি। তা নিয়ে কোনো আফসোস থাকার কথা না দুজনের। নেইমার চ্যাম্পিয়নস লিগের ২৪ তম অ্যাসিস্ট পেয়েছেন। ২০১৩ তে তার চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিষেকের পর থেকে ইউরোপের আর কোনো খেলোয়াড়ের গোলে এতোগুলো অবদান নেই। দুই নম্বরে থাকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও এই ৭ বছরে করেছেন ২০ অ্যাসিস্ট। পিএসজির ফাইনালের প্রতিপক্ষ নির্ধারণ হবে দ্বিতীয় সেমিফাইনালের পর। তার আগে বাকি সময়ে মার্কো ভেরাত্তিও কিছুক্ষণ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। ফাইনালের আগে সেটা বড় অনুপ্রেরণাই যোগানোর কথা পিএসজিকে।

    ২০১৭ তে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পর প্রথমবার দ্বিতীয় রাউন্ডে নেইমাররা বাদ পড়লেন রিয়ালের কাছে হেরে। সেবার দ্বিতীয় লেগে খেলেননি নেইমার। পরেরবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে এক লেগও খেলতে পারলেন না। এবার তিনি ফিট, বাকিরাও চনমনে। পিএসজির যে স্বপ্নের পেছনে ছুটছিল তার জবাব বোধ হয় এই দলটাই!
     


    লাইপজিগ
    গুলাকসি, ক্লস্টারমান, উপামেকানো, মুকিয়েলে, অ্যাঞ্জেলিনো, লাইমের, কাম্পেল, সাবিতজার, অলমো, এনকনকু, পলসেন

    পিএসজি
    রিকো, কেহরের, সিলভা, কিমপেম্বে, বের্নাট, ডি মারিয়া, পারেদেস, মার্কিনিয়োস, হেরেরা, নেইমার, এমবাপে