• লা লিগা
  • " />

     

    এল ক্লাসিকোর আগে : ফাঁকা মাঠে 'বিবর্ণ' দুইদলের নতুন দিনের রেষারেষি

    এল ক্লাসিকোর আগে : ফাঁকা মাঠে 'বিবর্ণ' দুইদলের নতুন দিনের রেষারেষি    

    কবে, কখন
    এল ক্লাসিকো
    বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ
    ন্যু ক্যাম্প
    ২৪ অক্টোবর, রাত ৮.০০


    বার্সেলোনায় এই মুহুর্তে বহু মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের একটা ধারা ভাঙতে যাচ্ছে। কেউ পাঁচ বছর, কেউ দশ বছর, কেউ এক যুগ ধরে নিয়মিত এল ক্লাসিকো দেখছিলেন ন্যু ক্যাম্পে বসে। সমর্থকদের এই রেকর্ড গড়ার নেশা খেলোয়াড়দের চেয়ে কম কিছু নয়। রিয়াল মাদ্রিদ যেদিন বার্সেলোনায় আসে সেদিন গোটা শহরের চেহারাই বদলে যায়। ন্যু ক্যাম্পের গ্যালারি ছেয়ে যায় কাতালান পতাকায়, কান্ত দেল বার্সা গানটা এদিন যেন আরেকটু জোরেই কাঁপিয়ে যায় গ্যালারিকে। একদল জয়ের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে, কারও কারও ক্ষোভ ঝরে কন্ঠে, কারও জন্য শিরোপাও অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচের জয়- দুই পক্ষের লড়াইটা ঝাঁঝালো বলেই এই ম্যাচের নাম এল ক্লাসিকো। বাংলায় যার অর্থ, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। করোনার যুগে এবার সেই ম্যাচ হবে ফাঁকা গ্যালারিতে। অনেকের কাছে ফাঁকা মাঠের ক্লাসিকো, ক্লাসিকোই নয়। সে দাবির পক্ষে যুক্তিও আছে, এই দুইটি ক্লাব তো শুধুই ফুটবল ক্লাব নয়। একেকটা শহরের প্রতিচ্ছবি এই দুই ক্লাব, এর সঙ্গে শহরের মানুষের আবেগ-অনুভূতি মিলেমিশে একাকার। ফুটবল তাই আর মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ক্লাসিকোও হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষনীয় বার্ষিক ইভেন্ট।

    এবারের ক্লাসিকোর ফাঁকা মাঠের মর্মার্থ অবশ্য আরও গভীর। ১৭ বছর পর দুই ক্লাব ক্লাসিকোতে মুখোমুখি হচ্ছে লিগে নিজেদের আগের ম্যাচে হেরে। রিয়াল ঘরের মাঠে হেরেছিল কাদিজের কাছে, বার্সেলোনার গেটাফের বিপক্ষে। ২০০০ সালের পর প্রথমবার দুই ক্লাব একই দিনে হেরেছে তাও আবার প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কোনো গোল না করেই। রিয়াল মাদ্রিদ লা লিগা চ্যাম্পিয়ন বটে, তবে সেই স্মৃতিও ম্লান হয়ে গেছে কাদিজের পর চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে ঘরের মাঠে শাখতারের কাছে হারে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে এই প্রথম হার দিয়ে ইউরোপে মৌসুম শুরু করেছে রিয়াল। গেল সপ্তাহের এই ফলগুলো বলছে ন্যু ক্যাম্পের ফাঁকা মাঠ আসলে রূপক অর্থে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রিয়াল-বার্সার অবস্থাই নির্দেশ করছে।


    টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর টানা দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্ব থেকে বাদ পড়েছে রিয়াল। বার্সেলোনার অবস্থা আরও করুণ। ইউরোপে ধারাবাহিক ব্যর্থতা চলছে তাদের গত ৫ মৌসুম ধরে। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল বা বার্সা দুইদলই ফেভারেটদের ভেতরই থাকবে, তবুও এই আমলে লিভারপুল, বায়ার্ন মিউনিখদের নামের স্পেনের ক্লাব দুইটির নাম অনেকখানি ফিঁকে হয়ে গেছে গেল কয়েক বছরে। পেপ গার্দিওলা-হোসে মরিনহো অথবা লিওনেল মেসে-ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো লড়াইগুলোও বিদায় নিয়েছে ক্লাসিকো থেকে। তাতে ক্লাসিকোও আগের মতো উত্তাপ ছড়ায় না সে কথাও বলেন আজকাল অনেকেই।

    করোনাভাইরাস নতুন রূপ দিচ্ছে ক্লাসিকোকে। বৈশ্বিক মহামারি বৈশ্বিক দুই ক্লাবের ওপরও বড়সড় প্রভাব ফেলে গেছে। রিয়াল মাদ্রিদ ২০ বছর পর একটা দলবদলের মৌসুম পার করে দিয়েছে নতুন কাউকে না ভিড়িয়েই। বার্সেলোনা অবশ্য নতুন খেলোয়াড় দলে এনেছে। তবে মাঠে আর মাঠের বাইরে খেলোয়াড় আর বোর্ডের ভেতর সংঘাত এই সময়ে স্পষ্ট হয়েছে আরও বেশি। রিয়াল সঙ্কট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক, বার্সারটার সঙ্গে জড়িত অর্থনীতি, ক্লাবনীতি সবকিছুই। লিগের পঞ্চম ম্যাচে শিরোপা নির্ধারণ হবে না, শিরোপা হাতছাড়াও হবে না। এরপরও ম্যাচটা মর্যাদার। আধুনিক যুগে ক্লাসিকো যত রূপ দেখিয়েছে, সেগুলোর রেশ এখনও রয়ে গেছে। এতোকিছুর পরও তাই  এই ম্যাচের আবেদন কমে না সহসায়।

    রোনাল্ড কোমান কোচ হিসেবে প্রথমবার পাচ্ছেন ক্লাসিকোর স্বাদ। খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্য তার বিস্তর অভিজ্ঞতা। ১১ বার ক্লাসিকোতে রিয়ালের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। রিয়ালের বিপক্ষে তিনি গোলও করেছেন অনেকবার। কোমান ছিলেন সেই আমলের 'সার্জিও রামোস'। জিনেদিন জিদানেরও একই অভিজ্ঞতা আছে, কোচ হিসেবেও ক্লাসিকো এখন ডালভাত হয়ে গেছে জিদানের কাছে। সেদিক দিয়ে কোমানের চেয়ে এগিয়ে তিনি।

    কোচ জিদানের ক্লাসিকো রেকর্ডও ঈর্ষা করার মতো। ন্যু ক্যাম্পে ৫ বার বার্সার বিপক্ষে খেলে কখনই হারেননি জিদান। আর সবমিলিয়ে ৯ ক্লাসিকোতে জিদান জিতেছেন ২টিতে, হেরেছেন দুইটিতে। ন্যু ক্যাম্পের ওই ৫ ক্লাসিকোতে অবশ্য কখনও জয় পাননি। বার্সাকে হারানোর স্বাদ জিদান পেয়েছেন দুইবার। প্রথমবার রিয়ালের কোচ হয়ে এসে প্রথম ক্লাসিকোই জিতেছিলেন জিদান, এরপর সবশেষ মার্চের ক্লাসিকোতেও জয়টা পেয়েছিল তিনিই। ২০১৬ এর এপ্রিল থেকে ২০২০ এর ওই ম্যাচ পর্যন্ত এ ক্লাসিকোতে রিয়াল ছিল জয়শুন্যই। এরপর ক্লাসিকোর জয় পুঁজি করে লিগের শেষভাগে দুর্দান্ত ফেরায় লা লিগাও জিতেছে রিয়াল।  বছর ঘুরে আরেক ক্লাসিকো আসতেই আরও একবার চাপে পড়ে গেছেন জিদান টানা দুই ম্যাচ হেরে। ওই দুই ম্যাচে জিদানের দলের নখদন্তহীন আক্রমণভাগ আর নিষ্ক্রিয় রক্ষণ ভালো  কিছুরও ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

    "কিছু কি বদলেছে? গত বছরও তো এমন চাপে ছিলাম, প্রথম যেবার কোচ হয়ে এসেছিল সেবারও তাই। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিজের কাজ করে যাওয়া।" - ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে জিদান বলেছেন চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার গুঞ্জন আগেও ছিল এখনও আছে, কিন্তু তিনি তার কাজটাই করে যাবেন।


    "ওই দুই ম্যাচে আমরা শুরুটাই করেছি বাজে। একবার গোল খাওয়ার পর যেভাবে খেলা দরকার ছিল সেভাবেও খেলতে পারিনি। ওই দলগুলো গোলের পর রক্ষণে মনোযোগী হয়েছে। সে রক্ষণ ভাঙার সূত্র আমরা বের করতে পারিনি। এখন আমাদের সামনে সুযোগ নতুন ম্যাচ নিয়ে ভাবার। এমন বিশেষ ম্যাচ সবসময়ই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য মোক্ষম সুযোগ।" - জিদান জানেন ক্লাসিকো জিততে পারলে নিমিষেই সব চাপ সামাল দিতে পারবেন তিনি। 

    মার্চের সবশেষ ক্লাসিকোতেও একই অবস্থা ছিল রিয়ালের। লিগের শেষ ম্যাচে হেরে বার্সার বিপক্ষে খেলতে নেমেছিল তারা। এর আগে ম্যান সিটির কাছে ঘরের মাঠে হেরে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্ব থেকেও প্রায় বিদায় নিশ্চিত করে ফেলেছিল রিয়াল। এরপরই বার্সাকে পেয়ে জ্বলে উঠেছিল রিয়াল, সেই ম্যাচ তারা জিতে নিয়েছিল ২-০ তে। আরও একবার সেই কাজটাই করতে চাইবেন জিদান।

    তবে এবার কাজটা আরও কঠিন। সার্জিও রামোসের খেলা নিয়েও আছে সংশয়। কাদিজের বিপক্ষে চোট নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি, পরে শাখতারের বিপক্ষে খেলাই হয়নি তার। জিদান জানিয়েছেন, রামোসকে নিয়ে ঝুঁকি নেবেন না তিনি। রামোস খেলা, না খেলার ওপর তো রিয়ালের অনেক কিছুই নির্ভর করে। জিদান আশ্বস্ত করবেন কি দিয়ে? 

    জিদানের চেয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন অবশ্য বেশি কোমানকে ঘিরে। নতুন কোচের অধীনে বার্সা খেলছে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। নতুন কোচের ছোঁয়া ফুটেও উঠেছে বার্সার খেলায়। ফিলিপ কৌতিনহো ফর্মে ফিরেছেন, বার্সার নতুন নাম্বার টেন এখন তিনি, আনসু ফাতি তরুণ বয়সেই ভরসার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন, নতুন আসা পেদ্রি, ত্রিনকাও, সার্জিনিয়ো ডেস্টর' নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন। লিওনেল মেসি এখনও সেরাটা দিতে পারেননি, ওইটুকু পেয়ে গেলেই কোমানের ফ্লুইড পাসিং আর জোরদার প্রেসিং আরও কার্যকরি করে তুলতে পারে বার্সাকে। কোমান বার্সাকে দিয়েছেন নতুন রূপ। এখন তার জন্য অপেক্ষা করছে আসল পরীক্ষা। কোমান হয়ত চাকরি হারানোর শঙ্কায় নেই, কিন্তু কোচ হিসেবে তার মানদন্ডের বিচার তো হবে এই ম্যাচ দিয়েই।


    দলের খবর


    জর্দি আলবা ফিরেছেন বার্সা স্কোয়াডে। যদিও তার ফিটনেস নিয়ে সংশয় আছে। মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান অবশ্য এখনও সেরে ওঠার প্রক্রিয়াতেই আছেন। গোলবারের নিচে তাই প্রথমবারের মতো ক্লাসিকোর স্বাদ পাবেন নেতো।

    রিয়াল মাদ্রিদে সার্জিও রামোস একাদশে থাকবেন কি না সে নিশ্চ্যতা জিদান দেননি। তবে শেষ পর্যন্ত রামোসকে পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবেন তিনি।

    কোমানের ৪-২-৩-১ এর বিপরীতে ৪-৪-২ ফরমেশন কার্যকরী হতে পারেন জিদানের দলের জন্য। সেক্ষেত্রে শেষ ক্লাসিকোর ফর্মুলাটাই আরও একবার ব্যবহার করতে পারেন জিদান। সামনে ভিনিসিয়াস আর করিম বেনজেমাকে খেলিয়ে তার ঠিক পেছনে থাকতে পারেন লুকা মদ্রিচ। প্লে-মেকারের ভূমিকায় মদ্রিচ আর ভিনিসিয়াসের গতি কাজে লাগিয়ে বার্সার হাইলাইন ডিফেন্স ভেদ করার চেষ্টা করার কথা রিয়ালের। আর মিডফিল্ডে টনি ক্রুস, কাসেমিরোর সঙ্গে পরিশ্রমী ফেদে ভালভার্দে। দানি কারভাহাল নেই চোটের কারণে তার জায়গায় আগের ম্যাচগুলোর মতৈ খেলবেন নাচো ফার্নান্দেজ। আর শাখতারের বিপক্ষে মোটে সুবিধা করতে না পারা মার্সেলোয়ার জায়গায় লেফটব্যাক পজিশনেই ফেরত আসার কথা ফার্লন্ড মেন্ডির।

    বার্সার ছকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় কৌতিনহো। ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডারকে মাঝমাঠে পরীক্ষা দিতে হবে স্বদেশী কাসেমিরোর বিপক্ষে। অ্যান্টোয়ান গ্রিযমান জায়গা হারাতে পারেন একাদশে, তার জায়গায় শুরু থেকেই উসমান ডেম্বেলের দেখা মিলতে পারে। 
     


    সম্ভাব্য একাদশ


    বার্সেলোনা
    নেতো, রবার্তো, পিকে, ল্যাংলেট, আলবা, বুসকেটস, ডি ইয়ং, কৌতিনহো, ফাতি, ডেম্বলে, মেসি
    রিয়াল মাদ্রিদ
    কোর্তোয়া, নাচো, ভারান, রামোস, মেন্ডি, কাসেমিরো, ক্রুস, ভালভার্দে, মদ্রিচ, বেনজেমা, ভিনিসিয়াস

     


    হেড টু হেড


    প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে দুইদলই সমান ৯৬টি ম্যাচ জিতেছে। এই ম্যাচের মাহাত্ম্য তাই আরেকটু বেড়ে যাচ্ছে। যে জিতবে সে এগিয়ে যাবে এই লড়াইয়েও।
     

    প্রেডিকশন
    বার্সেলোনা ২-২ রিয়াল মাদ্রিদ