• " />

     

    যে দিনটা শুধুই ক্রিকেটের

    যে দিনটা শুধুই ক্রিকেটের    

    ৭ বলে ১ রান করে ক্রিজে আছেন বিরাট কোহলি। ৭ম ওভারে প্যাট কামিন্সের শর্ট লেংথে করা তৃতীয় বলটায় হুক করলেন কোহলি। অতিরিক্ত বাউন্সের কারণে টাইমিংটা ঠিকঠাক হলো না, বল গেলো ফাইন লেগে থাকা কোহলির আইপিএল সতীর্থ এডাম জাম্পার কাছে। বিরাট কোহলির ক্যাচ, কোনমতেই মিস দেয়া যাবে না, যতই তিনি আইপিএল সতীর্থ হোন না কেন। তার ওপর এ ম্যাচে কোহলির ক্যাচটাই সবচে গুরুত্বপুর্ণ। ৩৭৫ রানের বিশাল লক্ষ্যে পৌছুতে হলে যে কোহলিকেই করতে হবে বিশাল কিছু! জাম্পার হাত থেকে ফসকে গেল মহামুল্যবান সে ক্যাচটা। গুড লেংথে স্টাম্প বরাবর বল করার পরের বলেই কামিন্স আবার মারলেন বাউন্সার, কোহলি এবার ভুল করলেন না। ওভারের শেষ দুই বলে দুই চার মেরে কোহলির আক্রমণাত্বক মনোভাব অস্ট্রেলিয়ার হাত থেকে ম্যাচ ফসকানোরও শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছিল। অবশ্য খানিক বাদেই সে শঙ্কাকে বহুদূরে ঠেলে দিয়েছেন জশ হ্যাজলউড। 

    কামিন্সের আগের ওভারে দুটি বাউন্ডারি মেরে এবার কোহলি কব্জির মুচড়ে স্কোয়ার লেগ দিয়ে মারলেন দুর্দান্ত এক ছয়। কমেন্ট্রিতে চাহালকে ম্যাক্সওয়েলের মারা রিভার্স সুইপে ছয় এবং কোহলির এ ছয়ের মধ্যে কোনটি শট অব দ্য ম্যাচ তা নিয়ে চলছে আলোচনা। পাওয়ারপ্লের শেষ ওভার করতে, নিজের পঞ্চম ওভার করতে এলেন জস হ্যাজলউড। ঘটনাটা আবারো ওভারের তৃতীয় বলের। বিরাট কোহলি ডাউন দ্য ট্রাকে এলেন, হ্যাজলউড তা দেখলেন। বল ছোড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তাকে ফলো করে মারলেন বাউন্সার, কোহলি পুল করলেন। লম্বা গড়নের হ্যাজলউডের সে বাউন্সার কিছুটা বাড়তি লাফিয়ে উঠাতে কোহলির মিডলিং হলো না, ব্যাটের কিছুটা উপরের অংশে লেগে বল গেল শর্ট মিড উইকেটে থাকা অ্যারন ফিঞ্চের হাতে। 

    বল ছাড়ার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ব্যাটসম্যানকে অনুসরণ করো তারপর বল ছুড়ো- একই মন্ত্রে হ্যাজলউড ফিরিয়েছিলেন মায়াঙ্ক আগারওয়ালকেও। আগের ওভারেই আগারওয়াল স্টাম্প ছেড়ে জায়গা বের করে তাঁর করা ফুল লেংথের বল কভারের উপর দিয়ে ছয় মেরেছেন। এবারও আগারওয়াল তা করলেন, কিন্ত জায়গামতো বল পেলেন না, আসলে হ্যাজলউড দিলেন না। হ্যাজলউডের করা বাউন্সারে অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যাট চালাতে হলো ২২ রান করা আগারওয়ালকে। তাঁর ব্যাটের এজ থেকে উঠা সে ক্যাচ পয়েন্টে থাকা ম্যাক্সওয়েল মিস করলেন না। 

    ২১ রানে হ্যাজলউডের সে ওভারে কোহলি আউট হওয়ার এক বল পরেই আবার বাউন্সারেই কুপোকাত হয়েছিলেন শ্রেয়াস আয়ার। বল ছুড়তে গিয়ে তিনি মাথা নিচু করেছিলেন, তবে তাঁর ব্যাটটা ছিল উপরের দিকে তাক করা। যেন পেরিস্কোপ খেলছেন, অজান্তেই, না দেখে। বল ব্যাটে লেগে গিয়ে চলে যায় উইকেটকিপার অ্যালেক্স ক্যারির হাতে। ৫ ওভারে ৫৩/০ থেকে ১০ ওভার শেষে ভারতের স্কোর ৮০/৩ হওয়া অপর প্রান্ত থেকেই দেখছিলেন শিখর ধাওয়ান, সে পাঁচ ওভারে মাত্র চারটি বলই খেলতে পেরেছিলেন তিনি। এরপর জাম্পার লো ফুলটসে কভারের হাতে ক্যাচ দিয়ে দলীয় ১০১ রানে লোকেশ রাহুল ফিরলে ভারতের জন্য লড়াইটা ছিল শুধু মান বাচানোরই। কিন্ত হার্দিক পান্ডিয়া দুর্দান্ত ব্যাটিং করে জয়ের আশা বাচিয়ে রেখেছিলেন।

    বাউন্সারে যে টপ অর্ডার পরাস্ত হয়েছিলো, সেসব বাউন্সারে দারুণ সব পুল-হুক শট খেলেছেন হার্দিক পান্ডিয়া, অপর পাশে শিখর ধাওয়ান খেলছিলেন কিছুটা ধীরভাবে। শেষ পর্যন্ত ২২৯ রানে এডাম জাম্পার বলে মিড অফের উপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে মিড অফেই ধরা খেয়ে ৮৬ বলে ৭৪ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় শিখর ধাওয়ানকে। এদিকে রিকুয়ার্ড রান রেট ১০ এর উপরে চলে যায়, হার্দিক পান্ডিয়া তা কমাতে গিয়ে এডাম জাম্পার টসড আপ ডেলিভারিতে মারেন লং অন দিয়ে। তবে ম্যাচে এর আগে চারবার পারলেও হার্দিকের সে শটে বল পার করতে পারেনি সিডনির লম্বা বাউন্ডারি, লং অনে মিচেল স্টার্কের হাতে ক্যাচ দিয়ে হার্দিক ফিরেন ৭৬ বলে ৯০ রান করে। শেষে জাদেজার ২৫, সাইনির ২৯ এ তিনশ পার করে ভারত।  

    অস্ট্রেলিয়ার ৬৬ রানের বিশাল সে জয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন স্টিভেন স্মিথ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তৃতীয় দ্রুততম করা তাঁর সেঞ্চুরিতেই তো এত রানের লক্ষ্য দিতে সক্ষম হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অবশ্য এতে অবদান ফিঞ্চ, ওয়ার্নার, ম্যাক্সওয়েলেরও। শুরুতে কিছুটা ধীরগতিতে খেলে ফিঞ্চ পরে সামলে সেঞ্চুরি হাকিয়ে ১১৪ রান করে ফিরেছেন। তাঁর ওপেনিং পার্টনার এর আগেই মোহাম্মদ শামির বলে কিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ৬৯ রান করে। এরপর ফিঞ্চ চলে যাওয়ার পরে স্টইনিসও ০ রানে ফিরলে স্মিথের ৬৬ বলে ১০৫ রানের সে ইনিংস এবং ম্যাক্সওয়েলের ঝোড়ো ১৯ বলে ৪৫ রানের ইনিংসেই ৩৭৪ রান করতে পারে অস্ট্রেলিয়া। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার করা সর্বোচ্চ সে রানের উপর ভর করে এরপর ১৭,৮২১ জন দর্শকের সামনে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ে এনে দেয় হ্যাজলউড-জাম্পাদের করা দুর্দান্ত বোলিং।

    ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সে ম্যাচ চলাকালীনই অকল্যান্ডে লড়ছিল নিউজিল্যান্ড ও ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম তিন ওভারেই ৫৫ রান তুলে পরের তিন ওভারে ৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ পাওয়ারপ্লে শেষ করেছে ৬০/৫ স্কোরে। হ্যামিশ বেনেটের এক ওভার থেকেই এসেছে ২৯ রান। এরপর ৪র্থ ওভারে দুজনকে ফিরিয়ে ৬ষ্ট ওভারে লকি ফার্গুসন ফিরিয়েছেন আরেকজনকে, মাঝখানে টিম সাউথিও সাজঘরে ফিরিয়েছেন আরও দুজনকে। ১৪ বলে ৩৪ করে ফার্গুসনের বলে বোল্ড হওয়ার পরে দ্রুতই ফিরেছেন শিমরন হেটমায়ার (০) ও নিকোলাস পুরানও (১)। সাউথি ১৩ রান করা ব্রান্ডন কিং ও ০ রানে রভমান পাওয়েলকে ড্রেসিং রুমে পাঠিয়েছেন এক ওভারেই। পোলার্ড এরপর ছয় মেরেছেন ৮টি, চার মেরেছেন ৪টি। তাঁর ৩৭ বলে ৭৫ রানের অপরাজিত ইনিংসের সাথে ফ্যাবিয়ান অ্যালেনের ৩০ রানে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ১৬ ওভারে করেছে ১৮০ রান। উইন্ডিজদের ইনিংসে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল ৩ বার, ১৬ ওভারে নেমে আসা সে খেলায় নিউজিল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৭৬ রান। 

    কিউইরাও রান তুলছিল দ্রুতগতিতে, সাথে উইকেটও হারাচ্ছিলো। ৫.৩ ওভারে ৬২ রান তুলতে ৩ উইকেট হারায় নিউজিল্যান্ড। আরও ৫ বল পরে রস টেলরও ফিরে যান দলীয় ৬৩ রানে। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলেছেন অভিষিক্ত ডেভন কনওয়ে ও জিমি নিশাম। ২৯ বলে ৪১ রান করে যখন কনওয়ে ফিরছেন, তখন নিউজিল্যান্ডের দরকার ২২ বলে ৩৬ রান। সে দরকারটুকু ৪ বল বাকি থাকতেই পুরণ করেছেন জিমি নিশাম ও মিচেল সান্তনার। সান্তনার ১৮ বলের তিনটিতে ছয় মেরে ৩১ রান করে ছিলেন অপরাজিত। জিমি নিশাম ২৪ বলে অপরাজিত ৪৮ রানের ইনিংস খেললেও ২১ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেয়া লকি ফার্গুসনের হাতেই উঠেছে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার। 

    সিডনি ও অকল্যান্ডে হওয়া এ দুই ম্যাচের দুই দল করোনাকালের দীর্ঘদিনের বিরতি শেষে ফিরেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সাউথ আফ্রিকা এদিন ফিরেছে, করোনাকালে সবার আগে ক্রিকেটে ফেরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। তবে এ সময়ে সবচে বেশি ম্যাচ খেলা ইংলিশরা ভীষণ চাপে পড়ার পরেও জিতেছে ৫ উইকেটে। ফর্ম এবং পিচে স্পিনাররা তেমন টার্ন পাবে না ভেবে ইংল্যান্ড খেলায়নি নতুন বলে বল করতে দক্ষ মঈন আলীকে। সে ইংল্যান্ডকে নতুন বলে দারুণ টার্ন পেয়ে শুরুতেই চাপে ফেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অভিষিক্ত জর্জ লিন্ডে।

    প্রথম ওভারে ১ রান দিয়ে জেসন রয়কে কিপারের ক্যাচ বানিয়ে ফিরিয়ে পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে আবার ১ রান দিয়ে ডেভিড মালানকে ফেরান বাহাতি এ অফ স্পিনার। শর্ট ফাইন লেগে মালানের ক্যাচে ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া ইংল্যান্ডকে এরপর উদ্ধার করেন জনি ব্যায়ারস্টো ও বেন স্টোকস। ২৭ বলে ৩৭ রান করে স্টোকস আউট হলে ভাঙ্গে তাদের ৮৫ রানের জুটি। দলের ১৫৯ রানে ১০ বলে ১২ রান করে অধিনায়ক মরগান ফিরলেও বাকি কাজটুকু সম্পন্ন করেছেন ব্যায়ারস্টো ও স্যাম কারান। শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৭ রান, প্রথম দুই বলে লুঙ্গি এনগিডিকে চার ও ছয় মেরে যা সহজেই করেছেন জনি ব্যায়ারস্টো। 

    এর আগে টসে জিতে ফিল্ডিংয়েও দারুণ শুরু করেছিলো ইংল্যান্ড। প্রথম ওভারে স্যাম কারানকে টেন্ডা বাভুমা স্কোপ করতে গিয়ে ফেরার পরে দক্ষিণ আফ্রিকা শুরুর ৩ ওভারে করে মাত্র ১২ রান। চতুর্থ ওভারে জফরা আর্চারের ওভার থেকে কুইন্টিন ডি কক ১৩ রান এনে খোলস ছেড়ে বেরোনোর পর ফাফ ডু প্লেসিস টম কারানের পরের ওভারে একাই এনেছেন ২৪ রান। পাওয়ারপ্লেতে জফরা আর্চার ও কারান ভাইদের ব্যবহারের পর আদিল রশিদ ও ক্রিস জর্দানকে এরপর বোলিংয়ে নিয়ে আসেন এইয়ন মরগান। পাওয়ারপ্লে শেষে করা তাদের সে চার ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা নিতে পারে মাত্র ২৯ রান, হারায় একটি উইকেটও।

    ইংলিশ পেসার ক্রিস জর্দানের বল ধরা দেখে ডি কক মনে করলেন স্লোয়ার আসবে। ডি কক প্রস্তুত, মিড উইকেট দিয়ে তিনি তুলে মারবেন। জর্দান শেষ মুহুর্তে গ্রিপ বদলে স্বাভাবিক গ্রিপে গুড লেংথে জোরে করলেন বল। ডি ককের টাইমিংটা ঠিকঠাক হলো না, শর্ট মিডউইকেটে ক্যাচ দিয়ে ২২ বলে ৩০ রান করে ফিরলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক। 

    আদিল রশিদ এক প্রান্ত থেকে চাপে ফেলতে থাকলেন সাউথ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানদের, অপর প্রান্তে মরগান আনলেন আর্চারকে। ফাফ ডু প্লেসিস ৩৪ বলে পুর্ণ করলেন ফিফটি। এরপরে আর্চারের বদলে স্যাম কারান এসে দারুণ বাউন্সারে ডিপ স্কোয়ার লেগে জর্দানের ক্যাচ বানিয়ে ফেরালেন ৫৮ রান করা ডু প্লেসিসকে। ভ্যান দার দুসেন (৩৭), হেনরি ক্লাসেনের (২০) ছোট কিন্ত গুরুত্বপুর্ণ ইনিংসে ১৭৯ করতে পারলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ইংল্যান্ডকে আটকানোর জন্য যা যথেষ্ট হলো না। 

    দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটে ফিরেছে মার্চের পর। নিউজিল্যান্ডও ফিরেছে দীর্ঘদিন পর, ভারতও। অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এর আগে ফিরলেও অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে এদিনই। সাদা বলের ক্রিকেটে ফিরেছে ওয়েষ্ট ইন্ডিজও। তবে এতদিন যা হয়েছে, তা সবই হয়েছে মাঠে দর্শক ছাড়া। এখনও হচ্ছে দর্শক ছাড়া। তবে অস্ট্রেলিয়া-ভারতের এদিনের ম্যাচে মাঠে ফিরেছে দর্শকও। কিছুটা হলেও ক্রিকেট ফিরেছে আগের রুপে। 

    ২৭ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার। এদিন বহুদেশ ফিরেছে ক্রিকেটে, বহুদেশে ক্রিকেট ফিরেছে। এদিন রান বন্যার পাশাপাশি বোলিংয়েও দেখা মিলেছে বুদ্ধিমত্তার, সাথে দারুণ পরিকল্পনারও। দেখা মিলেছে দৃষ্টিনন্দন শটে গড়া দারুণ সব ইনিংসের পাশাপাশি দারুণ সব বোলিং। দারুণে ভরপুর দিনটা তাই শুধুই ক্রিকেটের!