• ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফর ২০২১
  • " />

     

    চট্টগ্রামে বাংলাদেশের উইন্ডিজ-দুঃস্বপ্ন: অধিনায়কত্ব, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং নতুন করে পুরনো কিছু প্রশ্ন

    চট্টগ্রামে বাংলাদেশের উইন্ডিজ-দুঃস্বপ্ন: অধিনায়কত্ব, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং নতুন করে পুরনো কিছু প্রশ্ন    

    মুমিনুল হক এমনিতে স্বল্পবাক, অভিব্যক্তির প্রকাশেও সাধারণত সংযত। তবে আজ মাঠে তার বিহবল ভাবটাও টিভি পর্দায় আড়াল করতে পারলেন না প্রায়ই। একজন ব্যাটসম্যান একাই ম্যাচ বের করে নিচ্ছেন, স্বল্পদিনের অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারে এমন চ্যালেঞ্জের তার মুখোমুখি হতে হয়নি আর। মুমিনুলের বিহবল ভাবটা অবশ্য টেস্টে বাংলাদেশের অবস্থারই প্রতীকী ছবি। ২১ বছর কেটে গেলেও এই সংস্করণে যে বাংলাদেশের বিমূঢ় ভাবটা এখন কাটেনি, গলদ থেকে গেছে ‘বেসিকেই’। মেয়ার্সময় চট্টগ্রাম টেস্ট তাই নতুন করে পুরনো প্রশ্নগুলো তুলে দিয়েছে আজ।

    সর্বশেষ এই চট্টগ্রামেই আফগানিস্তানের কাছে হারের পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের এপিটাফ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে। খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের পর সেটা আর নতুন করে লেখার কিছু নেই। তবে আজকের পরাজয়টা বাংলাদেশের জন্য কিছু শিক্ষা নতুন করে নেওয়ার অবশ্যই। চার দিনের ম্যাচ হাতের মুঠোয় থেকে শেষ মুহূর্তে সেটা বেরিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তো খুব বেশি নেই বাংলাদেশের। কাইল মেয়ার্সকে অনেকটুকু কৃতিত্ব দিয়েও তাই আয়নার সামনে নিজেদের দেখা উচিত মুমিনুলদের।

    চট্টগ্রাম টেস্টের পঞ্চম দিনের সকাল থেকেই বাংলাদেশের সময়টা ছিল শুধুই ভুলে ভরা। চট্টগ্রামের উইকেট শেষ দিনও বোলারদের মৃগয়া হয়ে যায়নি, সেটা বেশ অবাক করেই থাকবে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টকে। কিন্তু দরকার ছিল নিজেদের পরিকল্পনায় ঠিক থেকে বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে কাজটা ঠিকমতো করে যাওয়া। কিন্তু সেটা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

    সকালের সেশনের কথাই ধরুন। তাইজুলের বলটা খেলতে গিয়ে মিস করলেন মেয়ার্স, আবেদন উঠল এলবিডব্লুর। তাইজুল খানিকটা আত্মবিশ্বাসী থাকলেও লিটনসহ বাকিদের দোনোমোনোয় সেটা আর নেওয়া হলো না। কিন্তু রিপ্লেতে দেখা গেল, নিলে আউট হতেন মেয়ার্স। সেটা হলে মেয়ার্সের ওই অতিমানবীয় ইনিংস হয় না, ম্যাচের ফলও হতে পারত অন্যরকম। একটা ভুল না হয় হলো, আবার পরে সেই একই ভুল। এবার নাঈম হাসানের নিচু হওয়া বলটা লাগল এনক্রুমাহ বনারের প্যাডে। এবারও রিভিউ নিল না বাংলাদেশ, কিন্তু এবারও রিলেতে দেখা গেল রিভিউ নিলে বনার আউট হতেন। ম্যাচের মোড়টা ঘুরে যেতে পারত তখনই। কাল সম্ভবত একটা রিভিউ হারানোর জন্য বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মুমিনুলদের খেয়াল ছিল না, ৯০ ওভারের মধ্যে এমনিই রিভিউ ফুরিয়ে যেত। পরে যখন সেই রিভিউ আবার নিয়েছে বাংলাদেশ, তখন তা আর কাজে আসেনি। উলটো আম্পায়ার সৈকতের আরেকটি ভুল সংশোধন করে বনাররা আউট থেকে বেঁচে গেছেন। শুধু রিভিউ কেন, ক্যাচেও সেই একই অবস্থা। শান্ত মেয়ার্সের ক্যাচ ধরতে পারলে ম্যাচের ফল অনায়াসেই হতে পারত অন্যরকম। রান আউটের হাফচান্সও ছিল, সেটাও নিতে পারেনি বাংলাদেশ।

    তবে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠবে দলের শরীরী ভাষা নিয়ে। মেয়ার্স-বনার যখন জেঁকে বসেছেন, দলের সবার মধ্যে ছিল হাল ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব। অধিনায়ক মুমিনুলের অ্যাপ্রোচ এমনিই প্রশ্নবিদ্ধ, দলকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করছেন কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে আরও একবার।  তাইজুল-নাঈমরা যখন কিছু করতে পারছেন না, মুমিনুলকে তখন মনে হয়েছে দিশেহারা, সতীর্থদের সাথে যোগাযোগেও মনে হয়েছে খানিকটা ব্যবধান আছে। একটা সময় তো সাকিব মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েও কথা বলার চেষ্টা করছিলেন তার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তাতে লাভ হয়নি।

    শুধু শরীরী ভাষা নয়, প্রশ্ন উঠবে মুমিনুলের অধিনায়কত্ব জ্ঞান নিয়েও। বারবার এক জায়গা দিয়ে এজ হওয়ার পরও সেখানে ফিল্ডার রাখা হয়নি, ক্লোজ ইন ফিল্ডার রাখায়ও অধিনায়ক ছিলেন বেশি রক্ষণাত্মক। অথচ এজ হয়েই মেয়ার্স পেয়েছেন সেঞ্চুরি, পরে আর কোনো সুযোগই দেননি। পার্টটাইম বোলার ব্যবহারেও আরেকটু কুশলী হতে পারতেন অধিনায়ক, হয়তো বোলার চেঞ্জেও। কাকতাকীয়ই বটে, একটা সময় চোট পেয়ে মাঠের বাইরে মুমিনুল চলে যাওয়ার পরেই ব্রেক থ্রু পেয়েছে। সেসময় অধিনায়কত্ব করছিলেন তামিম। তবে শুধু মুমিনুলের ওপর দোষ চাপালেও অন্যায় হবে। মাঠে তামিম-মুশফিকদের মতো সিনিয়রেরা থাকার পরও কেন ফিল্ড প্লেস বা বোলার ব্যবহার অন্যরকম হলো না, সেই প্রশ্ন আসলে পুরো ম্যানেজমেন্টের দিকেই উঠবে। আর মুমিনুলের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, সাকিবকেও পেলেন না আজ। সেটা নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন ম্যাচ শেষে, ‘সাকিব ভাই থাকলে বোলিং অনেক গোছানো হত। যেহেতু সিনিয়র বোলার, সিনিয়র ব্যাটসম্যান, সবাইকে আগলে রাখতে পারত। উনি না থাকায় মিস করেছি, বিশেষ করে বোলিংয়ে।’

    তবে পরাজয়ের কারণ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে মুমিনুল নিজেও যেন ম্যাচের মতো বিমূঢ়, ‘যখন দল হারবে তখন নির্দিষ্ট করে দোষ দিতে পারবেন না। দল হারা মানে সবাই হারা, দল জেতা মানে সবাই জেতা। আমার কাছে মনে হয় না নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে।’

    তবে আসল কারণটা কারোরই সম্ভবত অজানা নয়। টেস্টে বারবার এই ব্যর্থতাও কাকতাল নয় মোটেই। সাদা পোশাকের ক্রিকেটের প্রতি অনীহা, কাঠামোগত সমস্যা এসব আসলে পুরনো গল্পই। এজন্য করোনা-সংকটের পর টি-টোয়েন্টি শুরু হলেও এখনও আলোর মুখদ এখনো আলোর মুখ দেখেনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। টেস্টের আগে লম্বা দৈর্ঘ্যের ম্যাচে সেভাবে নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগও আসেনি। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে ব্যর্থতা নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, টেস্টে ঘরের মাঠে এমন বিপর্যয়ের পরও তাই খুব একটা টনক নড়ে না থিংক ট্যাংকের। সেজন্য বছর ঘুরে আবার সেই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি।

    দিন শেষে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট মানে তাই যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যাওয়ার।