• ইউরোপিয়ান সুপার লিগ
  • " />

     

    সুপার লিগের ব্যর্থ বিপ্লব: সবার ওপরে ফুটবল সত্য...

    সুপার লিগের ব্যর্থ বিপ্লব: সবার ওপরে ফুটবল সত্য...    

    ‘ফ্যান্স আর নট কাস্টমারস’।

    স্টামফোর্ড ব্রিজে যারা কাল যারা এই ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাদের নিশ্চিতভাবেই আপনি চেনেন না। কিন্তু একটু চেষ্টা করুন, তাদের সাথে আপনার অনেক মিল খুঁজে পাবেন। ওই যে ২০ বছর বয়সী ছেলেটাকে দেখুন, করোনা মহামারীতে যে চাকুরি হারিয়ে ফেলেছে। তার ভবিষ্যত কী, এখনো সে জানে না। কিন্তু নিজ দলের সুপার লিগে যোগ দেওয়ার খবর শুনে এই মহামারীর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চলে এসেছে প্রিয় ক্লাবের মাঠে, বুক পেতে দিয়েছে টিম বাসের সামনে। যেতে হলে গায়ের ওপর দিয়েই যেতে হবে বাসকে, তবু এই অন্যায়ের, এই অন্যায্যতার প্রতিবাদ করতে হবে। একটু ভাবুন, আপনার সঙ্গে তার একটা মিল রয়েছেই। জীবন আর জীবিকার এই ঘোরতর যুদ্ধে আপনারা সবাই ফুটবলেই খোঁজেন দুদন্ড শান্তি। সেই আবেগটাই যখন বিপন্ন, তখন ছেলেটা আর চুপ করে থাকতে পারেনি।

    একটু পাশে তাকান। ওই কাঁচাপাকা চুলের লোকটার কথাই ধরুন। বাবার হাত ধরে চেলসির খেলা দেখতে আসেন আজ প্রায় ৫০ বছর ধরে। নীল জার্সিদের অনেক গল্পের সাক্ষী সে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দিনের কাজের শেষে তিনিও চলে এসেছেন, বলছেন এই প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ালে সেটা হবে চ্যাম্পিয়নস লিগের চেয়েও বেশি গৌরবের। কিন্তু খেলা দেখতেও নয়, কীসের জন্য এই সমর্থকেরা জড়ো হয়েছে একসঙ্গে? তারা জানে, কিছু একটা অন্যায় হচ্ছে, তাদের ক্লাব কিছুটা একটা ভুল করছে। তারা সজ্ঞানে সেটা মেনে নিতে পারে না। জীবনের অন্য সব জায়গায় তারা হেরে গেলেও ফুটবলে তারা হেরে যেতে চায় না। সারাদিন মাথা নিচু করে থাকতে হলেও আপনার মতো তারাও দিন শেষে ফুটবলে মাথা উঁচু করতে চায়। স্থানটা বদলে স্টামফোর্ড ব্রিজ থেকে অ্যানফিল্ড, ওল্ড ট্রাফোর্ড, এমিরেটস, ইতিহাদ বা ওয়েম্বলি করে নিন, গল্পটা একই থাকবে। তাদের সবার সঙ্গে আপনার একটাই মিল, আপনারা ফুটবল ভালোবাসেন। সেজন্যই এই সুপার লিগ নামের ‘বিপ্লবটা’ ব্যর্থ হয়েছে এত আয়োজনের পরও।


    ইউরোপিয়ান সুপার লিগ কী, কেন ও কীভাবে কাজ করে: এই লিগ সম্পর্কে যা যা জানা প্রয়োজন


    ইউরোপিয়ান ফুটবলে গত ৭২ ঘন্টায় যে নাটক হলো, ফুটবল ইতিহাসেই সেরকম তুলনা বিরল। ইউরোপিয়ান ১২টি কুলীন ক্লাব ঠিক করল, তারা নিজেদের মতো একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করবে। সেটা তারা করতেই পারে, সে অধিকার তাদের আছে। তারা ঠিক করল, ইউয়েফার কাছে নিজেদের হিস্যাটা তারা বিকিয়ে দেবে না। দিতেই পারে, এটা তাদের ন্যায্য অধিকার। ইউয়েফা যে ধোয়া তুলসী পাতা, ব্যাপারটা অমনও নয়। ১২টি ক্লাব বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেল, টুর্নামেন্টের খসড়াও হয়ে গেল। সবই ঠিক আছে। কিন্তু পুরো আয়োজনটা শুধু তাদের জন্যই। এই লিগে তারাই রাজা, তারাই উজির। এখানে হেরে গেলেও তারাই থাকবে, আবার বাইরে থেকে অতিথিদের নিমন্ত্রণও করবে তাদের মর্জিমতো। বাইরে থেকে কেউ জিতে গেলেও সেখানে তাদের থাকার অধিকার থাকবে না, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এই কুলীনকুলই সর্বেসর্বা। এই শেষ ব্যাপারটাতেই বাঁধল যত গোল। এই সুপার লিগটা কি আসলে ফুটবলের জন্য ভালো?

    ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ যতই বড় গলায় বলতে থাকুন, তারা ফুটবলের ভালোর জন্যই এটা চান- এই প্রতিযোগিতার কাঠামো দেখে আপনার ভুরু কূঁচকে যেতে বাধ্য। ঠিক আছে, ক্লাবগুলোকে ঠকিয়ে ইউয়েফা নিজেদের গাঁটের পয়সা ভারি করছে- সেটা না হয় বোঝা গেল- কিন্তু এই জমিদারি ব্যবস্থা কেন? যে ক্লাবটার বার্ষিক বাজেট ওই রাস্তার ওপারের ধনী ক্লাবের এক জনের বেতনের সমান, তাদের দরজাটা কি বন্ধ করে দেওয়া হলো না? রাশফোর্ডের মতো যে ছেলেটার স্কুলের টিফিন যোগাড় হয় না ঠিকমতো, কিন্তু দুচোখে একদিন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন- সে এখান থেকে কী বার্তা পাবে? তার এলাকার ছোট ক্লাবটা কি কখনো সেই কুলীন লিগে যেতে পারবে?

    এসব প্রশ্ন আসতে শুরু করার পরেই উত্তপ্ত হতে থাকে পরিস্থিতি। শুরুতে আগুনে ঘি ঢালে বায়ার্ন, পিএসজি- সাফ জানিয়ে দেয় তারা এই লিগে ঢুকছে না। কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যায় ১২ মোড়ল। পেরেজ বার্তা দেন, তারা ভাঙা তো দূরে থাক, মচকাবেনও না। বলেন, ফুটবলে যারা ‘লিগ্যাসী ফ্যান’, তাদের জন্য এই ১২ দলের টুর্নামেন্ট না। জোর দিয়ে দাবি তোলেন, ফুটবলে একটা পরিবর্তন দরকার। এই প্রজন্ম নাকি ফুটবলে অনাগ্রহী, তাদের আগ্রহ ধরে রাখতে দরকার হলে ফুটবল ৯০ মিনিট থেকে ছেঁটেও ফেলতে হবে। বার্তা দেন, যে কোনো মূল্যে এই সুপার লিগ হবেই। একে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই।


     

     কিন্তু ভাঙনটা যে ভেতরে ভেতরে শুরু হয়ে গেছে, সেটা টের পাওয়া যায়। পালটা বিপ্লবের প্রথম ধাক্কা লাগে ইংল্যান্ডে। ক্লাবগুলো টের পায়, সমর্থকদের ক্ষোভের সলতেতে আগুন ধরে গেছে। সে আগুন এরপর ছড়িয়ে পড়ল টুইটার-ফেসবুক থেকে স্টামফোর্ড ব্রিজে। ধনী আমেরিকানরা বুঝতে পারল, ইউরোপে এসে ফুটবলকে শুধু পণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপন করাটা বোকামি। ইউরোপিয়ানদের কাছে এটা জীবন মরণের ব্যাপার, হয়তো তার চেয়েও বেশি।

    তবে জোর ধাক্কাটা এলো মূল কুশীলব খেলোয়াড়দের কাছ থেকে। এই ফুটবলাররা না থাকলে ফুটবল থাকে না, এই খেলাটা রক্ষার দায়ও তাদের। তাই রাশফোর্ড, ফার্নান্দেজ থেকে শুরু করে হেন্ডারসন, সালাহরা বা ওদিকে অবামেয়াং, স্টার্লিংরা নিজেদের হোয়াটস গ্রুপে বার্তা দেন, আমাদের কিছু একটা করা উচিত। ফুটবলটা তাদের পেশা, তবে একই সঙ্গে এটা তাদের সবকিছুও। তারা জানেন, এই নেশাটা কেড়ে নিলে এই পেশায় আর কিছু থাকে না। এই চলতে থাকে মালিকপক্ষকে বার্তা দেওয়া- এই কাজটা আমরা মেনে নেব না। প্রকাশ্যে শুরুতে মুখ খোলে না কেউ, তবে প্রস্তুতি চলতে থাকে অলক্ষ্যে। একটা সময় অনেকেই প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন, আমরা চাই না এমন কিছু হোক। তারা সমস্বরে বার্তা দেন, সমর্থকদের জন্যই তারা এখানে। তাদের ছাড়া তারা কোথাও যেতে চান না। ক্লাবের ম্যানেজারদের কথায়ও সেই অসন্তোষের আভাস। ক্লপ, গার্দিওলারা জানিয়ে দেন, এরকম কিছুতে তাদের সায় নেই। গ্যারি নেভিল, জেমি কারাঘাররা টিভিতে এসে বইয়ে দেন ক্ষোভের বিস্ফোরণ। পায়ের নিচে মাটি সরে যেতে থাকে মালিকপক্ষের। তারা বুঝতে পারেই, এই লড়াইয়ে হঠাৎ করেই তারা কোণঠাসা। শুরুতে যে প্রস্তাবে সবাই এককাট্টা ছিল, একটা সময় সেই বোঝাপড়াটা আলগা হয়ে আসতে থাকে। ম্যান সিটি প্রথম তাই সরে দাঁড়ায়, এরপর রাতভর নাটকের পর একসঙ্গে হিড়িক পড়ে বাকি পাঁচ ক্লাবের সেই তালিকায় নাম লেখানোর। শেষ পর্যন্ত তাদের তাই ক্ষমাই চাইতে হয় ভক্তদের কাছে। পরের দিন সেই তালিকায় যোগ দেয় ইতালির তিন ক্লাব আর স্পেনের একটি। বোঝা যায়, সুপার লিগের দালানটা ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ভেঙে পড়ছে ঝুরঝুর করে। সবার ওপরে ফুটবল সত্য, সেটাই পরিষ্কার হয়ে আসে সবার সামনে।

    কিন্তু আসলেই কি সুপার লিগের ভূতটা ঘাড় থেকে নেমেছে? অস্বীকার করার উপায় নেই, পেশাদার ফুটবল কাঠামো এখন বেশ ভঙ্গুর। একদিকে করোনার মহামারী, খেলোয়াড়দের আকাশচুম্বী বেতন, এজেন্টদের মোটা অংকের কমিশন- ওদিকে সেই অনুপাতে আয় না বাড়া- এই দুইয়ের মাঝে পড়ে ক্লাব মালিকরা অনেক দিন থেকেই ভাবছেন বড় একটা সংস্কারের। এর মধ্যে ইউয়েফার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা তাদের আরও এককাট্টা হতে সাহায্য করেছে। দিন শেষে ক্লাব মালিকদের কাছে এটা ব্যবসা, সেটা টিকিয়ে রাখার জন্য যা দরকার সেটাই তারা করবে। কিন্তু ভুলটা করে ফেলেছে তারা এক জায়গায়। সব সমীকরণ মেলাতে গিয়ে তারা সমর্থকদেরই বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওই যে, ফুটবল ইউরোপে নিছক কোনো খেলা নয়। এটা এমন কিছু নয়, যেটার কাঠামোতে টান পড়লে সরকার থেকেও সরাসরি হস্তক্ষেপের চিন্তা চলে আসে। মালিকপক্ষেরা বেশি লোভের আশায়, ইউয়েফার সাথে কথা চালানোর ফাঁকেই নিজেদের আখের গুছানোর মতলব করে। কিন্তু একটা সময় যখন দেখে, পাশে কেউ নেই, তখন সরে যেতে হয়। এত কিছুর পর তাই চলে যেতে হয় ম্যান ইউনাইটেডের প্রধান নির্বাহীকে, প্রশ্ন ওঠে ইংল্যান্ডের অন্য মালিকদের নিয়ে।

    কিন্তু সামনে এখন কী হবে? দিন শেষে এই সত্যিটা স্পষ্ট, ফুটবলে সংস্কার আসবেই। সুপার লিগ হয়তো থাকবে না, কিন্তু তার ছায়াটা থেকে যাবেই। ইউয়েফাই তো যে নতুন চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রস্তাব করেছে, সেটা বড় ক্লাবগুলোর কথা মাথায় রেখেই। সেখানে ছোট লিগের দলগুলোর ঢোকার সুযোগ আরও সীমিত, বড়দের ম্যাচ খেলার সুযোগ আরও বাড়বে। আর এটাই এখন আধুনিক ফুটবলের চাহিদা। বেশি বড় ম্যাচ মানে বেশি দর্শক, বেশি টাকা। এখানে সাম্যের, সমতার জায়গা নেই, এসব নিয়ে ভাবাবেগের সুযোগ নেই।

    এত কিছুর পরও এই উত্তাল ৪৮ ঘন্টা থেকে জানা যায়, ফুটবলে ব্যবসা অনেক বড় হলেও এখনও সবকিছু নয়। সমর্থকেরা এখনও ভোক্তা নয়, এখনো তাদের কিছুটা অধিকার কাছে। এখনও তারা অতটা স্বার্থপর হতে পারেনি, যতটা হতে পেরেছেন তাদের মালিকেরা। একদিন সব হয়তো নষ্টদের দখলেই চলে যাবে, কিন্তু এখনও যে যায়নি, এটাই বা কম কীসে!

    দিন শেষে যে ফুটবলই তো আমার, আপনার মতো অনেকের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।