• টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল ২০২১
  • " />

     

    ভারতকে স্তব্ধ করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম হাসি নিউজিল্যান্ডের

    ভারতকে স্তব্ধ করে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম হাসি নিউজিল্যান্ডের    

    ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল, সাউদাম্পটন 
    ভারত ১ম ইনিংস ২১৭ অল-আউট, ৯২.১ ওভার (রাহানে ৪৯, কোহলি ৪৪, রোহিত ৩৪, গিল ২৮, আশ্বিন ২২, জেমিসন ৫/৩১, ওয়াগন্যার ২/৪৭, বোল্ট ১/৪৬, সাউদি ১/৬৪) ও ২য় ইনিংস ১৭০ অল-আউট, ৭৩  ওভার (পান্ট ৪১, রোহিত ৩০, সাউদি ৪/৪৮, বোল্ট ৩/৩৯, জেমিসন ২/২১, জেমিসন ২/৩০, ওয়াগন্যার ১/৪৪) 
    নিউজিল্যান্ড ১ম ইনিংস ২৪৯ অল-আউট, ৯৯.২ ওভার (কনওয়ে ৫৪, উইলিয়ামসন ৪৯, ল্যাথাম ৩০, সাউদি ৩০, শামি ৪/৭৬, ইশান্ত ৩/৪৮, আশ্বিন ২/২৮, জাদেজা ১/২০) ও ২য় ইনিংস ১৪০/২ (উইলিয়ামসন ৫২*, টেইলর ৪৭*, আশ্বিন ২/১৭)
    নিউজিল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী ও প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী 


    দুই দেশের পার্থক্যের শেষ নেই। দুই দলের পার্থক্যের শেষ নেই। এক দেশ আরেকটির চেয়ে জনসংখ্যায় প্রায় ২৭৭ গুণ বড়। একটিতে ক্রিকেট শুধু উন্মাদনা নয়, ধর্মের মতো ঐশ্বরিক পর্যায়ের। আরেকটিতে রাগবির আড়াল থেকে মাঝে মাঝে মুচকি হাসে ক্রিকেট। এক দলের অধিনায়ক অগ্নিশর্মা, আরেকজন বরফ-শীতল, ঋষি পর্যায়ের। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে যে সংখ্যক দর্শকের প্রবেশাধিকার ছিল হ্যাম্পশায়ার বোউলে, তাতেও আকাশী-নীলের সঙ্গে আরেক গ্রুপের পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। তবে ব্যাপারটা যখন টেস্টের নতুন ব্র্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের, তখন দুই দলই শীর্ষস্থানীয়, দুই দলের পারফরম্যান্সই শীর্ষ পর্যায়ের। সেখানে পার্থক্যের ব্যবধান সূক্ষ্ণ, ব্যবধান সূক্ষ্ণ সাফল্য-ব্যর্থতার, আনন্দ-বেদনার, চ্যাম্পিয়নশিপ-শূন্য হাতের। একটা স্পেল, একটা সেশন শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় ফল-নির্ধারক। সাউদাম্পটনে প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ছিল বৃষ্টি-বাধা, তবে সেটি ছাপিয়ে ভারত-নিউজিল্যান্ডের লড়াই ছিল রোমাঞ্চকর, যেটি গেল রিজার্ভ ডে-র শেষ সেশনে, শেষ ঘন্টায়। 

    দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণের সামনে ব্যাটসম্যানদের ‘টেস্ট’ ছিল নজরকাড়া। ৬ষ্ঠ দিনে সম্ভব ছিল সবরকম ফল, সেখানে কাইল জেমিসনের এক স্পেল এরপর গড়ে দিল প্রথম পার্থক্য। ব্যাটিং-সহায়ক কন্ডিশন পেয়েও ভারতকে উড়তে দিল না নিউজিল্যান্ড, অল-পেস আক্রমণ নিয়ে তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে আটকে দিল ১৭০ রানে। ফলে প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ছিল ১৩৯ রান।  যেখানে আদতে স্পিনারদের জন্য কিছু নেই বলে মনে হয়, সেখানে রবিচন্দ্রন আশ্বিন দেখালেন তার ‘মাস্টারি’। মোহাম্মদ শামি ঢেলে দিলেন সব। তবে তারা আটকাতে পারলেন না নিউজিল্যান্ডকে। কেন উইলিয়ামসন আর রস টেইলর- দীর্ঘদিনের দুই সারথির ৯৬ রানের জুটিতে ভর করে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট হাসলো চ্যাম্পিয়নশিপের হাসি। বছর দুয়েক আগে এই ইংল্যান্ডেই ক্রিকেটের অন্যতম ট্র্যাজেডির শিকার তারা অবশেষে হলেন চ্যাম্পিয়ন! ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের পর উইলিয়ামসনের স্তম্ভিত সে ছবির পাশে এখন বসবে এদিনের হাসিমুখের ছবি, সেদিন জিতলে অবসরের চিন্তা করা টেইলর এখন করবেন উদযাপন। আর চ্যাম্পিয়ন হয়ে অবসরে যাবেন বিজে ওয়াটলিং। রস টেইলরের ম্যাচজয়ী বাউন্ডারির পর সাইমন ডুলের কথাটাই তাই বাজবে অনেকদিন, “সামটাইমস, সামটাইমস দ্য নাইস গাইস ডু ফিনিশ ফার্স্ট”। আর তাদের ওপর ভর করে, কোহলি-শামি-আশ্বিন, জেমিসন-সাউদি-বোল্ট-কনওয়েতে ভর করে আপনি-আমি আরেকবার বুঝলাম, টেস্ট ক্রিকেট কেন সবকিছুর উর্ধ্বে! 



    শেষদিনের প্রথম সেশনটা ছিল রোমাঞ্চকর। নিশ্চিতভাবেই এ সময়টা ছিল এ টেস্টের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যাটিং-সহায়ক, তবে জেমিসনের আঘাতে শুরুতেই চাপে পড়েছিল ভারত। ম্যাচে দ্বিতীয়বার এই পেসারের শিকার হয়েছেন বিরাট কোহলি। আউটসুইংয়ের পর লাইন ধরে রাখা বাড়তি বাউন্সের বলটিতে শরীর থেকে দূরে খোঁচা মেরেছেন কোহলি, যেটি গেছে স্লিপে। পরের ওভারে চেতেশ্বর পুজারাও তার শিকার- অফস্টাম্পের বাইরে লেংথ বলে বেশ দেরি করে খেলতে গিয়ে স্লিপে ধরা পড়েছেন তিনিও। 

    পরের ওভারে পান্টকেও এজের ফাঁদে ফেলেছিলেন জেমিসন, তবে এবার দ্বিতীয় স্লিপে মোটামুটি সহজ ক্যাচটা ফেলেছেন সাউদি। পান্টের রান তখন ছিল ৫, শেষ পর্যন্ত যিনি করেছেন ৪৪। জেমিসন প্রথম স্পেল শেষ করেছেন ৭ ওভারে ৪ মেইডেনসহ ৬ রানে ২ উইকেটে। দিনের প্রথম ঘন্টায় ১৩ ওভারে ২৫ রান তুলতে পেরেছিল ভারত, ২ উইকেট হারিয়ে। 

    পান্ট এরপর শুরু করেছিলেন সেটিই, যা তিনি করেন- আক্রমণের চেষ্টা। বারকয়েক ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়েছেন, এজও হয়েছে, তবে সেসব যায়নি ফিল্ডারের কাছে। বিট হয়েছেন, তবে দমেননি। তার সঙ্গে রাহানের জুটি যখন আরও হতাশ করবে নিউজিল্যান্ডকে মনে হচ্ছিল, তখনই ম্যাচে দ্বিতীয়বার আলগা শটে ফিরেছেন রাহানে। বোল্টকে দারুণ এক কাটে চার মেরেছিলেন, তবে ঠিক পরের বলেই ডাউন দ্য লেগে গ্লাভড হয়েছেন তিনি। 

    পান্ট ঠিক নিজের রূপটা দেখাতে পারেননি, তবে চেষ্টা করেছেন, ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বিরতির পর স্কুপ, রিভার্স স্ল্যাপ- চেষ্টা করেছেন সবই। ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরটাই করতে পেরেছেন শুধু। অবশ্য এর আগেই নিউজিল্যান্ডকে ব্রেকথ্রু দিয়েছিলেন ওয়াগন্যার। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে শর্ট বল থিওরিতে গিয়েছিলেন তিনি, লাঞ্চের আগে-পরে টানা ১৪টি শর্ট বলের পর অবশেষে একটি করেছেন লেংথে, অফস্টাম্প দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বলটা নিরীহ ভেবে ব্যাট চালানো জাদেজা ভুলটা করেছেন তাতেই। আঙুল ডিসলোকেট হয়ে যাওয়ার পরও নামা ওয়াটলিং সেরেছেন বাকি কাজটা। 

    ইনিংসের অন্যতম মুহুর্তটা এসেছে এরপর। বোলিং পরিবর্তন করে বোল্টকে এনেছিলেন উইলিয়ামসন, তাকে আরেকবার ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে লং-অন দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে পান্ট বল তুলেছেন আকাশে, গালি থেকে পেছনে ছুটে গিয়ে দারুণ ক্যাচ নিয়েছেন হেনরি নিকোলস। এক বল পর বেশ বাইরের বলে ব্যাট ছুঁড়ে এজড হয়েছেন আশ্বিন। 
     


    ভারতের দূর্বল টেইল-এন্ড এরপর তেমন ভোগাতে পারেনি নিউজিল্যান্ডকে। শামি সাউদির ওভারে দুই চারের পর পরের ওভারে মেরেছিলেন আরেকটি, তবে তৃতীয় চারের ঠিক পরের বলেই ফ্লাই স্লিপে ধরা পড়েছেন আবার মারতে গিয়ে। এই বলের আগেই সেখানে ফিল্ডার এনেছিলেন উইলিয়ামসন। সে ওভারের শেষ বলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন জাসপ্রিত বুমরাহ। ৪৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে দারুণ বোলিং ফিগার সম্পন্ন করেছেন সাউদি। 

    নতুন বলে মোহাম্মদ শামিকে এনেছিলেন কোহলি, জাসপ্রিত বুমরাহর আগে। বিরতির আগে অবশ্য অবিচ্ছিন্নই ছিলেন টম ল্যাথাম ও ডেভন কনওয়ে। এরপর ভারতকে আবারও প্রথম ব্রেকথ্রুটা দিয়েছেন আশ্বিন, পেস কমিয়ে আনা দারুণ এক টসড আপ ডেলিভারিতে প্রথমে পরাস্ত করেছেন ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে আসা ল্যাথামকে, বাকি কাজটা সেরেছেন পান্ট। এ নিয়ে দুই ইনিংসেই আশ্বিনের শিকার হলেন ল্যাথাম, দুই ইনিংসেই পরাস্ত হয়েছেন পেসের তারতম্যে। আশ্বিন ভারতকে উজ্জীবিত করেছিলেন আরও, তাকে সুইপ করতে মিস করা উইলিয়ামসনকে যখন এলবিডব্লিউ দিয়েছিলেন মাইকেল গফ। রিভিউ নিয়ে সেটি থেকে বেঁচেছেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক। 

    উইলিয়ামসনকে না পারলেও ডেভন কনওয়েকে ঠিকই ফিরিয়েছেন আশ্বিন, এবার সিম পজিশনের পরিবর্তনে ভেতরের দিকে ঢোকা বল বিট করেছিল তার ইনসাইড-এজ। গফের সিদ্ধান্ত এবার অবশ্য রিভিউ করার প্রয়োজন বোধ করেননি কনওয়ে। ৪৪ রানে ২য় উইকেট হারিয়েছে নিউজিল্যান্ড। 

    তবে এরপরের গল্পের পুরোটাই উইলিয়ামসন-টেইলরের। বেশ কিছুক্ষণ ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে থাকা টেইলর থিতু হয়েছেন যেন রান না করেই, এরপর শুরু করেছেন শট খেলা। টানা ডট দেওয়ার পরও দমেননি। শামিকে প্রথম চার মেরেছিলেন, এরপর আশ্বিনকে স্লগ করে আরেকটি। কাভার ড্রাইভ করেছেন, চাপটা আর জেঁকে বসতে দেননি। ২৬ রানে বুমরাহর বলে স্লিপে একটা জীবন পেয়েছিলেন শামির বলে, সে-ই শেষ। 

    অন্যদিকে উইলিয়ামসন খেলেছেন আরেকটি উইলিয়ামসন-সুলভ ইনিংস। প্রথম ইনিংসের মতো কন্ডিশনের সঙ্গে অতোটা লড়াই হয়তো এবার করতে হয়নি, তবে এবার ছিল রানতাড়ার চাপ। তাতে সফল তিনি, জোনে যাওয়ার পর তিনিও খেলেছেন শট। প্রথম ইনিংসের নকটা যদি হয় টিকে থাকার, উইলিয়ামসনের এ ইনিংসটা উদযাপনের। তাতে একটু জল ধরতে ধরেছিল, ৪৫ রানে শামির বলেই টপ-এজড হয়েছিলেন। তবে বুমরাহ সেটি নিতে পারেননি। এরপরই ফিফটি পেয়ে গেছেন তিনি। 

    আর শামির বলে, নিজের প্যাডের ওপর থেকে ঘুরিয়ে বাউন্ডারিতে ম্যাচ শেষ করেছেন টেইলর। তার আড়াআড়ি খেলার অভ্যাসের কথা ভেবে প্রথম ইনিংসে তার প্যাড তাক করে বোলিং করেছিলেন ভারতীয়রা, টেইলরের শট তাই পুরো ম্যাচের, পুরো ইনিংসের ‘মধুরেন সমাপয়েৎ’। 

    এ দিনটা, এ ফাইনালটা নিউজিল্যান্ডের জন্যও তো তাই।