• ইউরো ২০২০
  • " />

     

    'একগুঁয়ে', 'বাতিকগ্রস্ত', 'কুসংস্কারাচ্ছন্ন' মানচিনি যেভাবে বদলে দিলেন ইতালির ইতিহাস

    'একগুঁয়ে', 'বাতিকগ্রস্ত', 'কুসংস্কারাচ্ছন্ন' মানচিনি যেভাবে বদলে দিলেন ইতালির ইতিহাস    

    ইউরোর প্রথম ম্যাচ শুরু হবে ঘন্টা দেড়েক পর। রোমের হোটেল থেকে ছাড়বে টিম বাস। খেলোয়াড়দের আগে থেকেই সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রায় সবাই চলে এলো। তাড়াহুড়ো করে বাস ছেড়ে দিল সময়মতোই। কিন্তু মিনিটখানেকের মধ্যে রবার্তো মানচিনি খেয়াল করলেন তার পাশের সিট ফাঁকা। আরে, সহকারী কোচ জিয়ানলুকা ভিয়াল্লিকে ছাড়াই বাস রওনা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো, বেশিদূর যায়নি বাস। আবার তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসা হলো হোটেলে। ভিয়াল্লি তখন লবিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিমূঢ়ের মতো। আবার তাকে তোলা হলো, এবার আর কোনো হ্যাপা ছাড়াই বাস মাঠে পৌঁছাল। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ ইতালির জন্য খুব কমই পয়া গেছে। কিন্তু এবার তুরস্কের সাথে হলো ব্যতিক্রম। ইতালির শুরুটা হলো দুর্দান্ত, প্রথম দিনের পরেই তারা হয়ে উঠল টুর্নামেন্টের ফেবারিট। তবে রবার্তো মানচিনি একটা ব্যাপার ভোলেননি। এরপর প্রতিটা ম্যাচেই ভিয়াল্লি সবার শেষে বাসে উঠেছেন, শেষ পর্যন্ত সেটার আর নড়চড় হয়নি।

    রবার্তো মানচিনি লোকটা এরকমই। একটু বেশি খুঁতখুঁতে, একটু বাতিকগ্রস্ত, আরেকটু খারাপভাবে বললে কিছুটা কুসংস্কারছন্ন। খেলাধূলার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা অবশ্য এসব সংস্কার অনেকেই মানেন। অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়ের এরকম কিছু বাতিক থাকে, সেটা তারা পুরোপুরি মেনে চলেন। তবে মানচিনি একটু বাড়াবাড়িই করতেন। সেটার উদাহরণ একেবারে কম নয়। ম্যানচেস্টার সিটির যখন কোচ ছিলেন, ক্লাবে এসেই ঘোষণা করলেন কেউ পার্পল রঙের কিছু পরতে পারবেন না ক্লাবে। একবার নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন কক্ষ বন্ধ থাকায় সেটা করতে হয়েছিল পাশের ছোট একটা বিকল্প কামরায়। সেই ম্যাচটা জিতেছিল সিটি, এরপর থেকে মানচিনি ওই ছোট্ট ঘরেই করতেন সংবাদ সম্মেলন। এমনকি এফএ কাপের সেমির আগেও সেখানে করতে চেয়েছিলেন মানচিনি, অথচ ছোট্ট সেই রুমে ঠাঁই ছিল না মানুষের ভীড়ে।

    এরকম বাতিকের উদাহরণ আরও আছে। একবার চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ম্যাচের সময় মানচিনি ঠিক করলেন, মাদ্রিদ থেকে ম্যানচেস্টারে ফিরতি ফ্লাইটে সবাইকে মিটবল দিতে হবে। কেন? কারণ আগের অ্যাওয়ে ম্যাচের ফিরতি ফ্লাইটে এরকম মিটবল খেয়েছিলেন সবাই, সেই ম্যাচটা জিতেছিল সিটি। কিন্তু পুরো এক দিনেও মাদ্রিদে ঠিক ওরকম মিট বল পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত কাস্টমাইজড মিটবল দিয়েই কাজ চালাতে হলো মানচিনিকে। কিন্তু মিটবল তিনি শেষ পর্যন্ত খাইয়েছিলেনই।

    এরকম গোয়ার্তুমি তার আরও আছে। আরেকবার জুভেন্টাসের বিপক্ষে ম্যাচ খেলে ম্যানচেস্টারে ফিরবে সিটি। সেবার তুরিনে শীত পড়েছিল প্রচন্ড। মানচিনির মনে হলো, মাইনাস তাপমাত্রায় বরফের মধ্যে তিনি যাবেন না। গোঁ যে ধরলেন, শেষ পর্যন্ত আর রওনাই দেওয়া হলো না সেই রাতে সিটির। এয়ারপোর্ট গিয়েও ফিরে এলো দল, পরদিন সকাল ১১টায় তাপমাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হলে এরপর রওনা দিল সিটি।

    তবে ২০১১ সালে যেটা করেছিলেন, সেটা বোধ হয় সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। সেবার ওয়েম্বলিতে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইউনাইটেডের মুখোমুখি হবে সিটি। ম্যাচের আগে টিম বাস সাধারণত নির্দিষ্ট রুট দিয়ে যায়, সেবার পুলিশের আদেশ ভুল বুঝে অন্য রুটে গিয়েছিল। এফএ কাপের সেমিফাইনালের ম্যাচটা জিতেছিল সিটি। কিন্তু ফাইনালের আগে মানচিনি ঠিক করলেন, আগের সেই ভুল রুটেই যাবেন মাঠে। এবার পুলিশ থেকে তাকে সতর্ক করে দেওয়া হলো, কোনো এসকর্ট পাবে না টিম বাস। মানচিনি তো তার সিদ্ধান্তে অটল, টিম বাস তাই গেল আগের রুটেই। কিন্তু পড়ল ট্রাফিক জ্যামে, সেখানে সময় নষ্ট হলো অনেক। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ শুরুর মাত্র এক ঘন্টা আগে গিয়ে পৌঁছাল বাস। স্টোকের বিপক্ষে সেই ফাইনালে সেবার মাঠে গা গরম করারও সুযোগ পাননি কোম্পানিরা। কিন্তু ফাইনালটা ঠিকই জিতেছিল সিটি।

    রবার্তো মানচিনির এই বাতিকের গল্প বললেই আসলে শেষ হবে না। চট করে হয়তো তার সংস্কার আর গোয়ার্তুমিটাই এখানে আগে চোখে পড়বে। কিন্তু মানচিনির জেদ আর নিজের ওপর বিশ্বাসটা এর মধ্যে থেকেই উঁকি দেবে ছাইচাপা আগুনের মতো। অবশ্য মানচিনির নিজের বিশ্বাস থাকলেও চার বছর আগে সেই বিশ্বাসটা ছিল না অনেকেরই, এমনকি অনেক সাবেকদেরও। ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ সালের সেই দিনটা এখনো ইতালির জন্য ‘মারাকানাজো’ হয়ে আছে। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার পর সেদিন কেঁদেছিলেন জিয়ানলুইজি বুফন। সেই কান্নার ছবি দিয়ে পরদিন ইতালির লা গাজেত্তো দেল্লোতে শিরোনাম হয়েছিল, ‘দ্য এন্ড’। আসলেই তো, চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের এপিটাফটা সেদিন লেখা হয়ে গেছে ধরে নিয়েছিলেন অনেকেই। ইতালির মতো দল বিশ্বকাপের বাইরে থাকবে, নিরপেক্ষ কারো জন্যও তা মানা কঠিন। কিন্তু হয়েছিল সেটাই। জিয়ামপাওলো ভেঞ্চুরাকে দিয়ে হবে না, বোঝা হয়ে গিয়েছিল আগেই। কিন্তু কে নেবেন এই ভাঙাচোরা ইতালির দায়িত্ব? জনমত কার্লো আনচেলত্তির পক্ষে। কিন্তু ইতালি ফেডারেশন বেছে নিল রবার্তো মানচিনিকে। সেই মানচিনি, যিনি সিটি-ইন্টারের মতো ক্লাবের হয়ে জিতে ফেলেছেন অনেক কিছু। কিন্তু ইতালিয়ানরা সন্দিহান। মানচিনি কোথাও বেশিদিন টিকতে পারেন না, শেষ পর্যন্ত ম্যানেজমেন্ট বা খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটা না একটা ঝামেলা তার হয়ই। সিটিতে হয়েছে সেটা, সেজন্য চাকুরি হারাতে হয়েছে তাকে। এই মানচিনির ঘাড়ে ইতালির দায়িত্ব? না ভোটের পাল্লাই ছিল বেশি ভারি। অনেকেই বললে, তার অধীনে ইউরোও খেলা হবে না ইতালির।

    মানচিনির অবশ্য অসমাপ্ত একটা মিশন ছিল। দেশের হয়ে একটা কিছু তাকে জিততে হতো নিজের জন্যও। একটা গোপন দুঃখ বয়ে নিয়ে চলেছিলেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। ৯০ বিশ্বকাপে ইতালি খেলছিল নিজ দেশে। মানচিনি তখন সাম্পদোরিয়ার হয়ে কাটাচ্ছেন স্বপ্নের মতো সময়, বিশ্বকাপের জন্য দলেও সুযোগ হয়েছিল। সেবার ইতালির কোচ ছিলেন আজেগলিও ভিসিনি, যিনি এক সময় ছিলেন ইতালির অনূর্ধ্ব ২১ দলের কোচ। বয়সভিত্তিক এই দলেই ভিসিনির অধীনে অভিষেক হয় মানচিনির। এরপর ভিসিনি দায়িত্ব নেন জাতীয় দলের, ১৯৮৮ ইউরোর দলে নেন মানচিনিকে। সেই ইউরোতে প্রথম ম্যাচেই জার্মানির সঙ্গে দারুণ এক গোল করলেন মানচিনি। কিন্তু পরের ম্যাচগুলোতে তার জায়গা হলো না একাদশে। ইতালি বিদায় নিলো সেমি থেকে, মানচিনিও।

    দুই বছর পর বিশ্বকাপ নিজেদের মাটিতে। কিন্তু এবার মানচিনির জায়গা হলো না প্রথম একাদশে। গ্রুপ পর্ব গেল, নকআউট গেল, এমনকি তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচও, কিন্তু মানচিনি বসে রইলেন বেঞ্চে। কোচ ছিলেন এই ভিসিনিই, যিনি টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বলেছিলেন মানচিনি হবে এবারের চমক। কিন্তু কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই ভিসিনির। মানচিনির আর সুযোগ হয় না শিলাচি, বাজ্জিও, কারনেভালদের জন্য। পুরো বিশ্বকাপে একটা মিনিটের জন্যও নামতে পারেননি মাঠে। দেশের মাটিতে সেই বিশ্বকাপে সেমিতেই বিদায় নিয়েছিল ইতালি। কিন্তু সেই দুঃখ ভোলেননি মানচিনি। বিশ্বকাপ শেষে পরে অভিযোগ করেছিলেন, সাম্পদোরিয়ার মতো ক্লাবে খেলেন বলে ইচ্ছা করে তাকে নেননি ভিসিনি। যদিও ভিসিনি সেটা কখনোই স্বীকার করেননি। অথচ এই ভিসিনির সঙ্গে গুরু-শিষ্যের মতো সম্পর্ক ছিল মানচিনির।

    এরপর বহু বছর পর ২০১৮ সালে ভিসিনি চলে যান চিরতরে। রাগটা ততদিনে আর পুষে রাখেননি মানচিনির, বিদায়ী শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন ভিসিনির সমাধিতে। কিন্তু সেই দুঃখ ভোলেননি। নিজে যখন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নিলেন ২০২১ ইউরোতে, চেয়েছিলেন অন্তত সবাই যাতে একটা মিনিটের জন্যও সুযোগ পায়। সেজন্য ওয়েলসের সঙ্গে ম্যাচে সুযোগ পান ইতালির নিয়মিতদের বাইরে থাকা সবাই। এমনকি শেষ মুহূর্তে নামেন বদলি গোলরক্ষক সিরিগুও। মানচিনি চেয়েছিলেন, বঞ্চনার হতাশায় যেন কেউ না পোড়েন। হয়তো ওয়েলসের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাই সবাইকে আরও তাঁতিয়ে দিয়েছিল। এই কোচের জন্য আমাদের জিততেই হবে, দিতে হবে নিজেদের সেরাটা।

    এই ইতালিতে তাই মানচিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন, পুরো দলটা একটা পরিবারের মতো। কোচিং স্টাফে পেয়েছেন নিজের বন্ধু-সতীর্থ ভিয়াল্লিকে। এই ভিয়াল্লির সঙ্গে ওয়েম্বলিতে একটুর জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হয়নি মানচিনির। শিরোপা জেতার পর তাই ভিয়াল্লিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন অঝোরে। পেয়েছেন রোমের নয়নের মণি ড্যানিয়েলে ডি রসিকে। কোচিং স্টাফের আরেকজন এই রসি তাই শিরোপার পর ড্রেসিংরুমে ডাইভ দিয়েছেন শিশুর মতো।

    এই ইতালির দল কতটা এককাট্টা, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সম্ভবত লিওনার্দো স্পিনাজ্জোলা। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়দের একজন, এরপর বেলজিয়ামের বিপক্ষে লিগামেন্ট ছিঁড়ে মাঠ ছাড়লেন কাঁদতে কাঁদতে। দলের সবাই ঠিক করে রেখেছিল, তাকে একটা উপহার দিতে হবে। পরের দিন টিম ব্রেকফাস্টে স্পিনার জন্য উঠে দাঁড়াল সবাই। সেমিতে জেতার পর ইনসিনিয়ে উঁচিয়ে ধরলেন সতীর্থের জার্সি। মানচিনি নিশ্চিত করলেন, দলের সঙ্গে ওয়েম্বলিতে যাবেন স্পিনাজ্জোলা। ক্র্যাচ হাতে বিমানে উঠলেন স্পিনাজ্জোলা, ম্যাচ শেষে আর সবার সঙ্গে ভেসে গেলেন উৎসবে। পুরস্কার বিতরণীতে সবার আগে পদক নিলেন তিনি।

    মানচিনির এই ইতালি আসলে এমনই। এমন কোনো বড় তারকা নেই এই দলে, গ্ল্যামারের দিক দিয়ে পিছিয়ে অন্য অনেকের তুলনায়। কিন্তু মানচিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, এই দলের সবাই যেন নিজেদের উজাড় করে দেয় মাঠে, দেয় শতভাগেরও বেশি। এই দলের ভেরাত্তি, ইম্মোবিলে আর ইনসিনিয়েরারা তাই সেই পেসকারার বন্ধুত্বকে এবার ফিরিয়ে আনলেন নীল জার্সি গায়ে। সতীর্থ থেকে সবাই হয়ে উঠলেন বন্ধু, ভাই।

    ইতালিয়ানদের কাছে তিনটা ব্যাপার সবকিছু ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর, পরিবার ও ফুটবল। শেষের ভালোবাসাটা ফিকে হয়নি, কিন্তু বিশ্বাসটা হারাতে বসেছিল ইতালি। মানচিনি সেটা ফিরিয়ে এনেছেন। এক বছর আগেও যে ইতালি ছিল মৃত্যু উপত্যকা, সেই ইতালিকে এনে দিয়েছেন আনন্দে ভাসার উপলক্ষ। করোনা মহামারীতে যে ইতালির রাস্তায় ছিল কফিনের মিছিল, সেই ইতালির রাজপথে এবার হয়েছে ট্রফি নিয়ে প্যারেড, শোনা গেছে ‘ফোর্সা ইতালিয়া’ স্লোগান।

    আর কিছু না হোক, এই বিভীষিকা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য এই গোঁয়ার, বাতিকগ্রস্ত লোকটা একটা ধন্যবাদ তো পেতেই পারেন।