• অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ সফর ২০২১
  • " />

     

    অস্ট্রেলিয়াকে টানা তিন ম্যাচে হারিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়

    অস্ট্রেলিয়াকে টানা তিন ম্যাচে হারিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়    

     

    বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া, মিরপুর (টস- বাংলাদেশ/ ব্যাটিং)

    বাংলাদেশ ১২৭/৯, ২০ ওভার (মাহমুদউল্লাহ ৫২, সাকিব ২৬, আফিফ ১৯, এলিস ৩/৩৪, হেজলউড ২/১৬, জাম্পা ২/২৪)

    অস্ট্রেলিয়া ১১৭/৪, ২০ ওভার ( মার্শ ৫১, ম্যাকডারমট ৩৫, ক্যারি ২০* , শরিফুল ২/২৯, নাসুম ১/১৯, মোস্তাফিজ ০/৯)

    বাংলাদেশ ১০ রানে জয়ী


    তিনে তিন হলো বাংলাদেশের। ইতিহাস গড়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারাল টানা তিন টি-টোয়েন্টিতে। প্রথমবারের মতো তাদের হারাল কোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজে। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর ৫২ রানের পরে শরিফুল ইসলাম আর নাসুম আহমেদের দারুণ বোলিংয়ের সাথে মোস্তাফিজুর রহমানের কিপটে স্পেলে পরাশক্তি অজিদেরকে ঘরের মাঠে ধরাশায়ী করে ১০ রানের জয়ে সিরিজ জয় নিশ্চিত করল বাংলাদেশ।

    ১২৭ রানের জবাবে প্রথম ওভারেই বেন ম্যাকডারমটের দারুণ ছয় দিয়ে শুরু হলেও পরের ওভারেই বিপদে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। নাসুম আহমেদের কিছুটা দ্রুতগতির বল তুলে মারতে গিয়ে ওয়েড শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন মাত্র ১ রানে। সাকিবের প্রথম ওভারেই এরপর মিচেল মার্শকে আউট দিয়ে বসেন আম্পায়ার। মার্শ সাথে সাথেই রিভিউ নিলে ব্যাট বলের মাঝে বিশাল ফাঁক দেখা যায়। তবে তাতে বিচলিত না হয়ে আরও চেপে বসে বাংলাদেশ। নাসুম আহমেদ ৫ম ওভারে করেন মেইডেন ওভার। পাওয়ারপ্লে শেষে এক উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া তোলে মাত্র ২০ রান। 

    তবে এরপর থেকেই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে আক্রমণে যায় অজিরা। নাসুমের ৭ম ওভারেই এক ছয় আর চারে আসে ১৩ রান। সেখান থেকেই নিয়মিত বাউন্ডারি তুলে নেওয়া শুরু করে এই দুজন। বাংলাদেশি বোলাররা ডট বল দিলেও তাই সেখান থেকে বাংলাদেশিদের চেপে বসার সুযোগ দেননি ম্যাকডারমট-মার্শ। 

    সুযোগ অবশ্য এসেছিল মোস্তাফিজের করা ১৩তম ওভারে, কাটারে বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে ফাইন লেগে থাকা শরিফুল ইসলামের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ম্যাকডারমট। মামুলি সেই ক্যাচ অবশ্য ফেলে দেন শরিফুল। ওভারে মাত্র ১ রান আসলেও এই সহজ ক্যাচ ফেলে দেওয়াটা কিছুটা হলেও বাংলাদেশিদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিতে পারত। সেটা হতে দেননি সাকিব, ম্যাকডারমটকে ৩৫ রানে বোল্ড করে বাংলাদেশ শিবিরে ফিরিয়েছিলেন বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই ঐ শরিফুলই আক্রমণে ফিরে দারুণ স্লোয়ারে মইসেস হেনরিকসকে বিভ্রান্ত করে মিড অনে শামীমের তালুবন্দি করে ফেরান তাকে। মাঝের ৩০ বলে মাত্র ২২ রান দিয়ে ২ উইকেট নেয় বাংলাদেশ। 

    বাংলাদেশ অজিদের ওপর চেপে বসলেও মিচেল মার্শ ভালভাবেই তাদের ম্যাচে রাখেন, ৪৫ বলে সিরিজে নিজের প্রথম ফিফটিও তুলে নেন। তবে ১৮তম ওভারে আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেই ঘটে বিপত্তি। আগে একবার শরিফুলের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন মার্শ। এবার আক্রমণে এসেই দারুণ স্লোয়ারে  লং অফে নাইম শেখের তালুবন্দি করে শেষ হাসিটা হাসেন শরিফুল, সেই মার্শকেই ফেরান ৫১ রান। ক্যাচ মিসের শাপমোচন কী দারুণভাবেই না করেছেন তিনি!    

    শেষ দুই ওভারে অজিদের প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। আর ১৯তম ওভারেই মোস্তাফিজ দিলেন মাত্র ১ রান! ফিজ জুজুতে আরও একবার বাধা পড়ল অজিরা। নিজের কোটা পূর্ণ করার পরে কাটার মাস্টারের বোলিং ফিগার ছিল ৪-০-৯-০!  এরপর ২০তম ওভার করতে আসেন মাহাদি হাসান। ক্যারি প্রথম বলেই ছয় মেরে স্বাগত জানান তাকে। তবে নাটক আরও ছিল বাকি। কোমরের ওপর বল করায় নো বল ডাকা হয়। ফ্রি হিটে গুনেছেন মোটে ১ রান, মাথা ঠাণ্ডা রেখে ব্যাটসম্যানদের এরপর হাত খোলার আর কোনও সুযোগই দেননি তিনি। সেখান থেকেই ১০ রানের জয়ে মাঠে টাইগাররা ফেটে পড়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে।

    এর আগে বৃষ্টির কারণে খেলা শুরু হয়েছিল এক ঘণ্টা পরে। বিভীষিকাময় এক সিরিজ কাটানো অস্ট্রেলিয়া টসে হেরে ফিল্ডিংয়ে নেমে এদিন শুরুটা করেছিল ভালই, প্রথম ওভারেই তৈরি করেছিল সুযোগ। অল্পের জন্য স্টাম্পড হননি সৌম্য সরকার। পরের বলেই ব্যাটে বলে করতে পারেননি, তবে লাফ দিয়েও অ্যালেক্স ক্যারি সেবার ক্যাচ লুফে নিতে না পারলে সেই যাত্রায় বেঁচে যান সৌম্য। উইকেটের জন্য অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি অজিদের। পরের ওভারেই জশ হেজলউডের দারুণ সিমিং ডেলিভারি গুড লেংথে পড়ে মোহাম্মদ নাইম শেখের ব্যাটে চুমু খেয়ে চলে যায় ম্যাথিউ ওয়েডের হাতে, নাইম ফিরে যান মাত্র ১ রান করেই। ক্রিজে ধুঁকতে থাকা সৌম্যকে পরের ওভারেই যেন মুক্তি দেন অ্যাডাম জাম্পা। মিডল-লেগ স্টাম্পের দিকে যাওয়া লেগ স্পিনিং ডেলিভারিতে সপাটে সুইপ করতে গিয়ে পুরোপুরি মিস করে এলবিডব্লিউ হয়ে সৌম্য ফেরেন ১১ বলে মাত্র ২ রান করে। গত সিরিজের সেরা খেলোয়াড় সৌম্যের এই সিরিজের দৈন্যদশার তাই অবসান ঘটেনি। 

    পরের ওভারেই হেজলউডের বল আলতো টোকায় বাউন্ডারিতে পাঠাতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, ক্রিশ্চিয়ান ঝাঁপিয়ে পড়ে বলের নাগালও পেয়েছিলেন তবে তালুবন্দি করতে না পারায় বেঁচে যান বাংলাদেশ অধিনায়ক। মাহমুদুল্লাহ নেমেছিলেন প্রতিআক্রমণের মানসিকতা নিয়েই, তবে অজিদের চাপে বেশিক্ষণ আর তা ধরে রাখতে পারেননি। দারুণ লাইন লেংথ ধরে রেখে পিচের মন্থরতাকে কাজে লাগিয়ে অজিরা তাই বাংলাদেশকে পাওয়ারপ্লেতে  থামিয়েছে ২৮ রানে। 

    ৮ম ওভারে মিচেল মার্শ আক্রমণে এলে তাকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান, ফলস্বরূপ ওভারে আসে ১৫ রান। তবে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সাকিব আল হাসানকে ফিরতে হয় জাম্পার পরের ওভারেই। জাম্পার ভাসানো বলে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে উড়িয়ে মারতে গেলে লং অফে সামনে দৌড়িয়ে এসে দক্ষতার সাথে বল তালুবন্দি করেন অ্যাশটন অ্যাগার, সাকিব ফেরেন ১৭ বলে ২৬ রান করে। 

    আগের দিন যেখানে শেষ করেছিলেন সাকিবের বিদায়ের পর মাঠে নেমে সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। জাম্পার বলে বের হয়ে এসে মেরেছিলেন দারুণ এক ছয়। বেশ কিছু মনোমুগ্ধকর শট খেলার পরে দ্রুত সিঙ্গেল নিতে গেলে ক্যারির সরাসরি থ্রোতে রান আউট হয়ে ফিরতে হয় ১৩ বলে ১৯ করেই। আরেক তরুণ শামীম হোসেন পাটওয়ারি নেমে ধুঁকতে থাকার পরে হেজলউডের বলে দিকভ্রান্তের মত ব্যাট চালিয়ে ম্যাকডারমটের পিছনে দৌড়ে নেওয়া ক্যাচের শিকার হয়ে ফিরে যান মাত্র ৩ রানেই। 

    অধিনায়ক রিয়াদ এক প্রান্ত আগলে রাখলেও হাত খুলে খেলতে পারছিলেন না। রানের চাকা সচল করতে দ্রুত সিঙ্গেল বের করতে গিয়েই ৫ বলে ১১ রান করে রান আউট হয়ে বিদায় নেন ওপর প্রান্তে থাকা নুরুল হাসান। অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিং আর প্রচণ্ড আর্দ্রতায় ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশিদের তাই রানের জন্য যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া অধিনায়ক ৫২ বলে নিজের ফিফটি পূর্ণ করেছিলেন। ৫২ রান করে পরের বলেই অভিষিক্ত নাথান এলিসের দারুণ ইয়র্কারে পরাস্ত হয়ে ফিরে যান মাহমুদউল্লাহ। পরের দুই বলে মোস্তাফিজুর রহমান আর মাহাদি হাসানকে ফিরিয়ে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করেছেন এলিস, যা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে প্রথম। সেই সুবাদে বাংলাদেশ থেমেছিলো ১২৭ রানে। দিনশেষে অবশ্য সেই সম্বলটুকুই যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায় টাইগারদের অসাধারণ বোলিং পারফর্ম্যান্সে।