• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    শেরিফ তিরাসপোল: দেশহীন এক ক্লাবের 'মিশন ইম্পসিবল'

    শেরিফ তিরাসপোল: দেশহীন এক ক্লাবের 'মিশন ইম্পসিবল'    

    ইউরোপের সবচেয়ে বড় মঞ্চ ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ,যার জন্য তৃষিত অপেক্ষা থাকে সব ক্লাবের।এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাস যে শুধুই ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয়, তার ইতিহাসে যে জড়িয়ে আছে রাজনীতিও। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে হওয়া দেশগুলোর রক্তাক্ত ইতিহাসই বলুন আর ফুটবলে ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো বা বেনিতো মুসোলিনিদের হস্তক্ষেপের কথাই বলুন, ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি ইউরোপে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আয়োজনেরও। সেই ইতিহাসের পাতায় যোগ হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়। প্লে-অফে ডাইনামো জাগ্রেবকে হারিয়ে ৪১তম দেশ হিসেবে যোগ দিয়েছে মলদোভার ক্লাব এফসি শেরিফ তিরাসপোল, প্রথম ম্যাচেই ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনের ক্লাব শাখতারকে। তবে ক্লাবটি কি আসলেই মলদোভার? ইতিহাস আবারও উঁকি দেয় সেখানেও।  


    ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার লাল জন্ম: স্বাধীন রাষ্ট্র নাকি অঙ্গরাজ্য

    ১৯৯০ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙতে চলেছে এটা নিশ্চিত। মানচিত্রের খোলনলচে পালটে যাবে, জন্ম নেবে নতুন সব রাষ্ট্র। আবার সেসব রাষ্ট্রের বুকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক সোভিয়েত সমর্থক। সেরকমই পরিস্থিতি মলদোভা নামের এক রাষ্ট্রের। তারা কি রোমানিয়ার সাথে জোট বেঁধে এক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে নাকি পৃথিবীর মানচিত্রে মলদোভা নামে আলাদা রাষ্ট্রের উদয় হবে তাই নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। তবে সেসবের বালাই নেই সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিশাল এক জনগোষ্ঠীর। সোভিয়েত সমর্থক সেই গোষ্ঠী তাই গঠন করে মলদোভিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক, পাছে মলদোভা ভিন্ন রাষ্ট্র হলেও তারা রাশিয়ার ভেতরেই থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নও ভাঙল, মলদোভাও স্বাধীন রাষ্ট্র হল। স্বাধীনতা পাওয়া মাত্র মলদোভায় শুরু হয়ে গেল গৃহযুদ্ধ। রাশিয়ার সাহায্যে মলদোভার বিপক্ষে পূর্ণোদ্দমে লড়াই চালিয়ে গেল মলদোভিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। মৃতের সংখ্যা হাজার পেরুনোর পর ১৯৯২ সালে তিন পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে থামল যুদ্ধ। মলদোভিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিল, নাম নিল ট্রান্সনিস্ত্রিয়া। তবে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে এখনো অস্তিত্ব নেই এই রাষ্ট্রের, সেখানে তারা এখনও মলদোভার অঙ্গরাজ্য।

    *****

    গৃহযুদ্ধ ও ফুটবলের ভয়াল উত্থান

    নিস্তার নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট এক শহর বেন্দেরি। তাদের শহরের ক্লাব এফসি তিঘিনা লিগের ম্যাচে মাঠে নামবে এফসি কন্সট্রাকটোরালের বিপক্ষে। ঘরের মাঠ ডাইনামো স্টেডিয়ামে নামার আগে আলেকজান্দ্রু গুজুনের হোটেলে যাওয়ার কথা। সেখান থেকেই সতীর্থদের সাথে মাঠে যাবেন তিনি। ১৯৯২ সালের ২ মার্চে এরপর যা ঘটেছিল সেটার কথা ভেবে এখনও মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নে চিৎকার করে ওঠেন তিনি।

    হোটেলে সতীর্থদের সাথে খোশগল্প করছেন এমন সময়ে শুরু হল ভারী গুলিবর্ষণ। মলদোভার গৃহযুদ্ধের বেড়াজালে আটকে পড়ে গেছেন তারা। তিরাসপোল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে নিস্তার নদীর পাশেরই তাদের এই হোটেল পড়ে গেছে একেবারে ক্রসফায়ারে। এতদিন যুদ্ধের মর্মান্তিক সব কাহিনী শুনে এসেছেন, বেঁচে ফেরার আশা তাই সময় গড়ানোর সাথে সাথে ক্ষীণ হয়ে আসছিল। যা কিছু নিয়ে হোটেলে এসেছিলেন সব নিয়ে বেজমেন্টে আশ্রয় নিলেন তারা। সময় গড়ায় কিন্তু বোমা বিস্ফোরণ আর গোলাগুলি থামবার কোনও চিহ্ন নেই। বেজমেন্টের ম্রিয়মাণ মুখগুলোর দিকে তাকিয়েই গুজুন সিদ্ধান্ত নেন পালাবদল করে একজন একজন করে ওপরে গিয়ে খাবারদাবার আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন। জানের ভয় আছে তবে এভাবে কতদিন থাকতে হতে পারে তার তো কোনও ঠিকঠিকানা নেই। ভয়ে কাঁপতে থাকা খেলোয়াড়দের ঘুম এমনিই হারাম হয়ে গিয়েছিলো। খাবার-পানি যেন গলা দিয়ে নামছিল না, পানি খাওয়ার পরও মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত কতোগুলো প্রাণের সমারোহ সেই অন্ধকার পাতাল ঘরে।    

    দুই দিন পেরিয়ে গিয়েছে, যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দুই পক্ষের রক্তের নেশা স্তিমিত হয়নি বিন্দুমাত্র। তারই মধ্যে হোটেলে এসে হাজির কিছু স্থানীয়। গুজুনরা ভয়ই পেয়েছিলেন প্রথমে কিন্তু পরে আশ্বস্ত হলেন তাদের কথা শুনে। খেলোয়াড়দের হোটেলে আটকে পড়ার খবর জানতে পেরেই সেখানে হাজির হয়েছেন তারা। তৃতীয় দিনের মাথায় গুলিবর্ষণ হালকা হয়ে এলে সেই লোকগুলো ছাদে গিয়ে সাদা পতাকা ওড়ান। পতাকা দেখেই দুই পক্ষের রুদ্রমূর্তিতে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে, আলোচনায়ও রাজি হয় তারা। সেদিন ঐ অচেনা কিছু শুভাকাঙ্খীর মধ্যস্ততায় বেঁচে ফিরেছিলেন গুজুন ও তার সতীর্থরা। মলদোভার ইতিহাসের মতই সেদেশের ফুটবলের উত্থানের ইতিহাসও যুদ্ধবিগ্রহকে সঙ্গী করেই। সেই অঞ্চলই পরে হয়েছে ট্রান্সনিস্ত্রিয়া। ঐ শহরের প্রবেশপথে এখনও টহল দেয় সশস্ত্র সেনারা, ঘাটিতে তারা সগৌরবে রাশিয়ান অক্ষরে ব্যানার টাঙিয়ে রেখেছে যাতে লেখা-”জন্মভুমির জন্য”। যুদ্ধ ও স্বাধীনতার সেই চেতনা আজও তারা বুকে ধারণ করলেও চাপা পড়ে গেছে ঐ উৎকণ্ঠার দিনগুলোর ইতিহাস।

    গুজানরা সেদিনের পরই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন দেশ ছাড়ার। পরে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইউক্রেনে। কয়েক বছর পরে মলদোভান লিগে যেই বিপ্লব ঘটেছিল তা চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি তাদের। একটি ক্লাবের একাধিপত্যের কেচ্ছা-কাহিনি সীমানার ওপারে বসেই শুনে গিয়েছেন তারা।

    ****
    তিরাসপোলে শেরিফের আবির্ভাব ও ফুটবল বিপ্লব

    শেরিফ তিরাসপোল নামটা শুনেই কোনও বালুকাময় অঞ্চলে চামড়ার খোপে পিস্তল নিয়ে ঘোরা জাঁদরেল মোচওয়ালা আইন নিয়ন্ত্রণকারী অফিসারের কথাই চোখে ভাসে। পারতপক্ষে তা একটা ফুটবল ক্লাব, সেই তিরাসপোল শহরের। সেই তিরাসপোল শহর যাদের ইতিহাস রক্তাক্ত, সেই তিরাসপোল যাদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি কোনও রাষ্ট্রই। এটা সেই ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার রাজধানী তিরাসপোল। তবে শেরিফ তিরাসপোল নাম শুনে যেই অফিসারের কথা চোখে ভাসে তার সাথে ক্লাবের জন্মের ইতিহাসের খুব একটাও অমিল নেই। সেই মলদোভিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকের হয়ে লড়াই করা দুই রাশিয়ান বংশোদ্ভূত অফিসারের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাইভেট ফার্ম শেরিফ কোম্পানি। ক্লাবের মালিকানাও শেই শেরিফ কোম্পানিরই।

    ১৯৯৬ সালে মলদোভান বি ডিভিশনে এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। তখন অবশ্য নাম ছিল এফসি তিরাস তিরাসপোল। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল শেরিফ কোম্পানির কর্মকর্তা ও সাবেক পুলিশ ভিক্টর গুজান ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবের নাম রাখেন এফসি শেরিফ তিরাসপোল। শেরিফ কোম্পানির অধিভুক্ত হওয়ার পরের বছরেই এ ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয়ে কোচ আহমেদ আলাসকারোভের অধীনে ১৯৯৯ সালেই প্রথম মলদোভান কাপ জয়ের স্বাদ পায় ক্লাবটি।

    স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রাধান্য দিয়ে তাদের কেন্দ্র করেই যেখানে কোনও ক্লাবের প্রাথমিক পরিকল্পনা সাজানো হয় সেখানে শেরিফ তিরাসপোল বা শেরিফ ছিল একেবারেই ভিন্ন। ক্লাবের জন্মলগ্ন থেকেই তাদের মূলমন্ত্র ছিল- খেলোয়াড় কিনো আর খেলোয়াড় বেচো। মূলত লাতিন আমেরিকান আর আফ্রিকান খেলোয়াড়দের কিনে তাদের তারকার তকমা কাজে লাগিয়ে দুই তিন বছরের মাথায় বিক্রি করে দেওয়াটাই ছিল তাদের ব্যাবসায়িক কাঠামো। আর সেই দুই এক বছরেই এই খেলোয়াড়দের হাত ধরে সাফল্য আসায় স্থানীয় খেলোয়াড়দের জন্য আলাদা কোনও পরিকল্পনার কথাও তারা কখনও মাথায় আনেননি।

    তবে শুরু থেকেই ক্লাবের সুযোগ সুবিধা ছিল উচ্চ মানসম্পন্ন। সেদিকেও তাদের ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল। পুরো মলদোভার লিগেই শেরিফের মত সুযোগ সবিধাসম্পন্ন স্টেডিয়াম আর অনুশীলন মাঠ নেই আর কারও। প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে ক্লাবের অবকাঠামো। শেরিফের প্রত্যাশা ছিল, ইউক্রেন আর রাশিয়ার ক্লাবগুলো তাদের এই মাঠের সুবিধা নিবে, সেখান থেকে গড়ে উঠবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে মলদোভার লিগের দৈন্যদশা তাদের সেই আশা পূর্ণ করেনি। একই কারণেই খেলোয়াড় বিক্রির সেই পন্থাও আখেরে খুব একটা লাভবান হয়নি। তাতে অবশ্য থেমে থাকেনি বিনিয়োগ। ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার সরকারী বাজেটেরও প্রায় দ্বিগুণ শেরিফ তিরাসপোলের বার্ষিক বাজেট। মলদোভান লিগে আক্ষরিক অর্থেই অন্যান্য ক্লাবকে গুড়িয়ে দিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপেই এগিয়ে চলছে শেরিফ তিরাসপোল।  

    ****
    তিরাসপোলের অদ্ভুত আনুগত্য

    ইউক্রেন ও মলদোভার মধ্যে ঠিক যেন স্যান্ডউইচের মাঝের মাংসের প্রলেপ হয়ে আছে এই ট্রান্সনিস্ত্রিয়া। ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পরে সেখানে বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে সীমান্তে চলছে আরও কড়াকড়ি। যেখানেই নানাবিধ বিধিনিষেধের কারসাজি সেখানেই চলে ফাঁকফোকরের খজ, হয় চোরাচালানের উত্থান, ব্যতিক্রম নেই এখানেও।

    ২০১৪ সালের পর থেকে ট্রান্সনিস্ত্রিয়া থেকে ইউক্রেনের শহর ওডেসাতে এই সীমান্ত দিয়েই চোরাচালানের হার বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় দুর্নীতি ক্রমবর্ধমান হওয়ার পেছনে এই চোরাকারবারির আছে মুখ্য ভূমিকা। ২০১৪ সালে অবশ্য মলদোভার সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে ট্রান্সনিস্ত্রিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর থেকেই রাশিয়ান জনগণের অধ্যুষিত সেই স্বঘোষিত রাষ্ট্র থেকে রাশিয়াতে রপ্তানির হার বেড়েছে হুহু করে। রাশিয়ার প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রমাণ আজও মেলে তাদের সীমান্তের ব্যানারগুলোতে। স্বাধীনতার উদযাপনের উদ্দেশ্যে তৈরি ব্যানারগুলোর একটাতে লেখাও আছে: “নিস্তারের এই প্রান্তে শান্তি কায়েম করার জন্য ধন্যবাদ, রাশিয়া!”

    দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার করাল গ্রাসে বিপন্ন ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার জনজীবন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরকারের অরাজকতা নিয়ে সাধারণ জনগণ কিছুটা রুষ্ট হলেও শেরিফ তিরাসপোলকে নিয়ে তাদের আনন্দের কমতি নেই। ক্লাবটার আদর্শ, কাঠামো বা খেলোয়াড় কোনোটাই সেই অর্থে সেই অঞ্চলের মানুষের পরিচায়ক না। সেসব নিয়ে তিরাসপোলের মানুষের বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই।

    এতো বছর মলদোভান লিগের কিছু বিধিনিষেধের কারণে বিদেশি খেলোয়াড়দের আধিক্য সেই অর্থে না থাকলেও সেসব নিয়মকানুন শিথিল করায় দলটার প্রায় পুরোটাই এখন বলতে গেলে বিদেশি।  ২০১৯ সালে পুরো ক্লাবেই মলদোভান পাসপোর্টধারী খেলোয়াড় ছিল মোটে ১১ জন। এই মৌসুমে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬। তাদের মধ্যে দুজন আবার বদলি গোলরক্ষক আর দুইজন মোটে অ্যাকাডেমি থেকে উঠে এসেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ স্কোয়াডেও ব্রাজিল, পেরু, ঘানা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, উজবেকিস্তান, মালাউয়ি, লুক্সেমবোর্গ এসব দেশের খেলোয়াড়দের আধিক্য। তার ওপর পুরো পূর্ব ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর মধ্যে একমাত্র তাদের স্লোগান লাতিন- “উবি কঙ্কোর্ডিয়া-ইবি ভিক্টোরিয়া”, যার অর্থ, যেখানে ঐক্য আছে বিজয় সেখানে আসবেই। প্রখ্যাত লাতিন ভাষার লেখক পুব্লিলিয়াস সাইরাসের দেওয়া উক্তি মূলত এটি।

    তবে ইউরোপে তাদের এই অঞ্চলের ঝান্ডা বহন করছে তো এরাই। এর আগে ইউরোপা খেলা এই দল যে এবার লড়বে চ্যাম্পিয়নস লিগেও। তাছাড়াও মলদোভান লিগে একাধিপত্য কায়েম করে তাদের শিরোপার ঝুলি দিনে দিনে আরও ফুলেফেঁপে উঠছে। সাফল্যের বিড়ম্বনাস্বরূপ লিগ অবশ্য হারিয়েছে তার জৌলুশ। একঘেয়েমি কাঁটাতে ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচগুলো তাই যেমন তাদের জন্য কাজ করবে টনিকের মত তেমনই ইউরোপে তাদের পরিচিতি বহন করবে এই ক্লাব, সেই ভাবনাতেই তারা বেজায় খুশি। দিনশেষে এই মানুষগুলোর চাওয়া দুই দন্ড শান্তি, আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি।

    ****

    চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে নতুন রঙ

    মলদোভান লিগের যেই জরাজীর্ণ হাল তাতে শেরিফের রাজত্বে হানা দেওয়ার ক্ষমতা আপাতত কারও নেই বলা যায়। লিগে নিজেদের খেলা ২১ মৌসুমের মধ্যে ১৯টিতেই শিরোপা ঘরে তুলেছে তারা। গত ঘরোয়া মৌসুমেও ৩৬ ম্যাচের মধ্যে ৩২টিতেই জয় পেয়েছে তারা, হার মাত্র ১টিতে।

    তবে গলার কাটা বলতে তাদের ঐ ব্যবসায়িক কাঠামোটাই। দেশের জনগণের দুর্দিনে এই ফুটবল ক্লাবের এতো চড়া বাজেট বড্ড বেমানান, তার ওপর লোকসান সত্ত্বেও বিনিয়োগের পরিমাণ যখন সেখানে দিন দিন বাড়তে থাকে তখন তা চিন্তার উদ্রেক করে বটে। তবে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য পিটার লুলেনভের মনে হয় না যে ক্লাবের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এতো চিন্তার কোনও জায়গা আছে। বরং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সুযোগ পেয়ে ইউয়েফার কাছ থেকে টিভি সত্ত্বা পেতে চলেছে ক্লাবটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার বদৌলতে তাদের এই কাঠামোর সুফলও তারা অচিরেই পেতে যাচ্ছেন বলে ধারণা তার।

    লুলেনভের আকাঙ্খা হয়ত পূরণ হবে। তাতে করে ফুটবল ফেডারশেনও লাভবান হবে নিশ্চিতভাবেই। আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তাদের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচটাও যে ইতিহাসের সেই গোলমেলে অধ্যায়েরই একটি অংশ হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়েছে। প্রথম ম্যাচেই যে শেরিফ মুখোমুখি হয়েছে নিস্তার নদীর ওপারের দেশ ইউক্রেনের ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের। এই ম্যাচের জয় যে তাদের ফুটবল বিপ্লবের পালে আরও জোর হাওয়া লাগাবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই সাথে তারা ইন্টার মিলান ও ইউরোপের সর্বাধিক শিরোপাজয়ী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদকেও গ্রুপ পর্বে ঘরের মাঠে আপ্যায়ন করবে। লুলেনভের ব্যবাসায়িক আকাঙ্ক্ষাও তাই যেমন পূর্ণ হতেই পারে সেই সাথে এই ফুটবলকে ঘিরেই দুদণ্ড শান্তির খোঁজে হাতড়ে ফেরা ট্রান্সনিস্ত্রিয়ার ঐ জনগণের মুখেও ফুটবে হাসি, উঠবে ফুটবলের রব আর মুখে মুখে উচ্চারিত হবে এফসি শেরিফ তিরাসপোলের নাম।