• লা লিগা
  • " />

     

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ৩

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ৩    

     


    আরো পড়ুনঃ
    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ১

    যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ২


     

    বার্সার হয়ে ডেভিড ভিয়া যখন লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে উল্লাসে মেতেছিলেন, কিংবা ৪৪ বছর পর লিগ জিতে ম্যানচেস্টার সিটির ডেভিড সিলভার বুনো উল্লাসের সময় কি কেউ ভ্যালেন্সিয়া ফ্যানদের কথা চিন্তা করেছিল? অনুভূতিটা কেমন ছিল তাদের? স্পেনের রাঘব বোয়াল রিয়াল, বার্সা ছাড়া একমাত্র ক্লাব হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে ভ্যালেন্সিয়া। অথচ তাদেরকেই নিরূপায় হয়ে ধনী ক্লাবগুলোর কাছে নিজেদের তারকা খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু সেই কাজটা না করলে ভ্যালেন্সিয়ার দলটা কেমন হতো ?

     

    ভ্যালেন্সিয়ার মত ‘সেলিং ক্লাব’-এ টানা ১৯ বছর থাকা বিরল দৃষ্টান্তই বটে। কিন্তু এই কাজটিই করেছিলেন গোলকিপার ভিসেন্তে গাইতা। মাত্র আট বছর বয়স থেকে ভ্যালেন্সিয়ায় থাকা গাইতা তাদের ইয়ুথ ডিভিশন গুলোতে খেলে কিংবদন্তী কিপার সান্তিয়াগো ক্যানিজারেজের অবসরের পর ২০০৮ সালে মূল দলে অভিষিক্ত হন। কিন্তু এরপরপরই সেগুন্দা ডিভিশনের রেক্রিয়েটিভোতে ধারে পাঠানো হয় তাকে। ঐ মৌসুমে অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য জামোরা ট্রফি জেতেন । ঐ মৌসুমের শীতকালীন দলবদলে সানচেজ ও রেনানের ইঞ্জুরির কারণে তাকে ফেরত আনে ভ্যালেন্সিয়া। রেক্রিয়েটিভো থেকে আসার সময় ফর্মটাকেও সাথে নিয়ে আসেন তিনি। পরের আড়াই মৌসুমের মত সময় ভ্যালেন্সিয়ার মূল গোলকিপার ছিলেন তিনি। ২০১১ তে নতুন চুক্তি সই করেন তিনি। কিন্তু ১১-১২ মৌসুমে হাত ভেঙ্গে যাওয়ার পর আর নিজের আগের অবস্থান ফেরত পেতে পারেননি তিনি। ফলশ্রুতিতে গেতাফের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে দিয়েগো আলভেসের অসাধারণ ধারাবাহিকতার জন্য তার অভাব অতটা বোঝা না গেলেও ভ্যালেন্সিয়ার দলে একসময় তার প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিহার্য।

     

    গাইতার মতই দীর্ঘদিন খেলতে না পারলেও যে কয়্যদিন দলে ছিলেন, এতেই দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন জোওয়াও পেরেইরা এবং নিকোলাস ওতামেন্দি। স্পোর্টিং লিসবন থেকে কেনা পেরেইরা এসেই রাইট ব্যাক পজিশনটি নিজের করে নেন। প্রথম ম্যাচেই রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে ১-১ ড্র করা ম্যাচের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। পরের তিন বছর টীমশীটে প্রথম নামগুলোর মধ্যে একটি ছিল পেরেইরার আর থাকবেই বা না কেন? প্রায় প্রতি ম্যাচেই সামর্থ্যের জানান যে দিয়ে গিয়েছেন! কিন্তু সব  হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায় নুনো ভ্যালেন্সিয়ার কোচ হয়ে আসার পর। খেলার সুযোগের অভাবে হ্যানোভারে চলে যান তিনি। ভ্যালেন্সিয়াতে মাত্র এক মৌসুম ছিলেন ওতামেন্দি। কিন্তু ওই মৌসুমে তিনি কতটা ভাল খেলেছিলেন, তা প্রমাণ করে ওই মৌসুমের ‘টিম অফ দ্যা সিজন’-এ তার অন্তর্ভুক্তি। এই মৌসুমেই রিয়ালের বিপক্ষে গোল করে তাদের টানা ২২ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড ভেঙ্গে দেন তিনি। কিন্তু ম্যানসিটির লোলুপ দৃষ্টির কাছে হার মানতে হয় ভ্যালেন্সিয়াকে। এক মৌসুম পরেই ওতামেন্দিকে বিক্রি করে দেয় ম্যানসিটির কাছে।

     

    পেরেইরা, ওতামেন্দির মত প্রতিভা দেখাতে শুরু করা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি কিংবদন্তিতুল্য খেলোয়াড়কেও বিক্রি করতে হয়েছিল ভ্যালেন্সিয়াকে। এমনই দুজন হলেন বর্তমান বার্সেলোনা সতীর্থ জর্দি আলবা ও জেরেমি ম্যাথিউ। উনাই এমেরি ভ্যালেমসিয়ার কোচ হয়ে আসার পরই ম্যাথিউকে তার প্রথম সাইনিং বানান। ফ্রেঞ্চ ক্লাব তুলুজ থেকে কেনা হয় তাকে। সতীর্থদের আসা যাওয়ার মিছিলে একমাত্র ব্যাতিক্রম ছিলেন তিনি। ২০০৯-১৪ এই পাঁচটি বছর ভ্যালেন্সিয়াকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । ভাল পারফরম্যান্সের পাশাপাশি বার্সা-রিয়ালের সাথে গোল দেওয়ায় অল্পদিনেই ‘লস চে’দের চোখের মণি হয়ে ওঠেন। দীর্ঘদিন ধরে ডিফেন্ডার খুঁজতে থাকা বার্সেলোনার চোখ পড়ে ম্যাথিউর ওপর। ২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে ভ্যালেন্সিয়া। ত্রিশোর্ধ্ব যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ট্রান্সফার ফি। ম্যাথিউর এককালীন সতীর্থ জর্দি আলবা ভ্যালেন্সিয়ায় ছিলেন চার বছর। প্রথম দিকে  ইয়াথিউর সাথে লেফটব্যাক নিয়ে প্রতিদ্বন্দীতা হলেও দুজনেরই নজরকাড়া পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাথিউকে সেন্টারব্যাক ও আলবাকে লেফটব্যাকে খেলান উনাই এমেরি। এরপরের চার বছর তাকে আর কেউ প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। নিজেদের ঘরের ছেলেকে অন্যের হয়ে এত ভাল করতে দেখে বার্সা তাকে ফেরত আনতে উঠে পড়ে লাগে। অতঃপর ২০১২ তে ১৪ মিলিয়নের বিনিময়ে তাকে কিনে নেয় তারা। এই দুইজনের অভাব ভ্যালেন্সিয়ার ডিফেন্সে এখনো প্রকট।

     

    ম্যাথিউ, আলবার মত ভ্যালেন্সিয়ার দীর্ঘদিনের কান্ডারি ছিলেন এভার বানেগা। আর্জেন্টাইন এই মিডফিল্ডার ভ্যালেন্সিয়ায় ছিলেন ছয় বছর। এর মধ্যে একটা বড় সময় ইঞ্জুরিতে কাটালেও ১০-১১ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে পারার পেছনে অন্যতম মূল কারিগর ছিলেন বানেগা। ভ্যালেন্সিয়াতে এসেই অ্যাতলেতিকো মাদ্রিদে ধারে খেলতে চলে যান তিনি। ধার থেকে ফিরে এসেই ভ্যালেন্সিয়ার মিডফিল্ডের মূল চালিকাশক্তি বনে যান। পরের দুই মৌসুমে অসংখ্যবার ‘টীম অফ দ্যা উইক’-এ সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০১২ তে নিজ গাড়ি পায়ের উপর দিয়ে চলে গেলে গুরুতর ইঞ্জুরিতে পড়েন। বাম অ্যাংকেল ও টিবিয়া-ফিবুলা ভেঙ্গে যাওয়ায় ইঞ্জুরিতে থেকে ফিরে আসলেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। ২০১৪ তে নিজদেশের ক্লাব নিউওয়েলস ওয়ল্ড বয়েজে ধারে পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে। এরপর সেভিয়াতে চলে যান বানেগা। মাত্র এক মৌসুম খেললেও ভ্যালেন্সিয়ার সমর্থকদের মতে তাদের হয়ে খেলা অন্যতম দর্শনীয় খেলোয়াড় ছিলেন বানেগার স্বদেশী ফারনান্দো গাগো। ইঞ্জুরিপ্রবণ এই খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার অসম্ভব প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হলেও ইঞ্জুরির জন্য প্রতিভার খুব কমই দেখাতে পেরেছিলেন তিনি। ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে খেলা মাত্র ১৮ ম্যাচ খেলেছিলেন। বার্সার বিপক্ষে এক ম্যাচে মেসিকে পকেটবন্দি করে রাখার ফলে তাকে উঠিয়ে নেওয়ার সময় পুরো স্টেডিয়াম তাকে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল।

     

    বানেগা, ম্যাথিউদের মত দীর্ঘদিন ধরে ভ্যালেন্সিয়ার আক্রমণ ভাগের অন্যতম মূল সেনানী ছিলেন হুয়ান মাতা। সিলভা, সলদাদো ও ভিয়ার সাথে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর এক অ্যাটাক। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে ০৭-০৮ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়াতে এসেই বার্সার সাথে প্রথম ম্যাচেই দুই গোল দিয়ে কোপা দেল রে ফাইনালে নিয়ে যান ভ্যালেন্সিয়াকে। এরপর থেকেই ভ্যালেন্সিয়ার মূল একাদশে জায়গা পাকা করতে থাকেন তিনি। ০৯-১০ এবং ১০-১১ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার তৃতীয় হওয়ার পেছনে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এরপর থেকেই তাকে কেনার জন্য উঠেপড়ে লাগে বড় দলগুলো। অবশেষে চেলসি ২৩.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসে যোগদেন তিনি।

     

    আক্রমণভাগে মাতার সতীর্থ ডেভিড সিলভার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ভ্যালেন্সিয়াতেই। ইয়ুথ দল থেকে মূল দলে উত্তীর্ণ হওয়ার পরের দু’বছর অবশ্য তাকে এইবার ও সেল্টা ভিগোতে ধারে কাটাতে হয়। এই দুই দলেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও ২০০৬-এ ভ্যালেন্সিয়াতে ফেরত এসেই মূল একাদশে জায়গা করে নেন তিনি। এরপরের দুই বছর ভ্যালেন্সিয়ার নিউক্লিয়াসই ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে আসে ভ্যালেন্সিয়ার জার্সিতে তার সবচেয়ে বড় সাফল্য। সে বছর বার্সা রিয়ালকে টপকিয়ে কোপা দেল রে জিতে ভ্যালেন্সিয়া। বলাই বাহুল্য, সিলভা ছিলেন দলের সেরা খেলোয়াড়।  ০৯-১০ মৌসুমে সিলভা তার ক্যারিয়ারে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল (৮) করেন। ২০১০ সালে ম্যানসিটির ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডের অফারে রাজি হয় ভ্যালেন্সিয়া এবং সিলভা পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে।

     

    ভ্যালেন্সিয়ার ক্লাব ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফরওয়ার্ড ছিলেন ডেভিড ভিয়া। ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে মাত্র ১৬৬ ম্যাচে গোল করেছিলেন ১০৭ টি এবং জিতেছিলেন কোপা দেল রে। জারাগোজা থেকে মাত্র ১২ মিলিয়ন ইউরোতে কেনা ভিয়া ভ্যালেন্সিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা সাইনিং। ২০০৫-২০১০ এই পাঁচ বছর ভ্যালেন্সিয়াকে দু’হাত ভরে সাফল্য দিয়ে গেছেন। যেকোনো স্প্যানিশ ক্লাবের খেলোয়াড় দুই বড়ে মিয়া বার্সা রিয়ালের পক্ষে গোল দিলে এমনিতেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে । সেখানে ভিয়া এই দুই দলের বিপক্ষে তার প্রথম দুই ম্যাচেই গোল দিয়েছিলেন এবং দলকেও জিতিয়েছিলেন। ঐ পাঁচ বছরে বেশ কয়বার কোচ বদল করেছে ভ্যালেন্সিয়া; কিন্তু ভিয়া ঠিকই তার জায়গা থেকে একের পর এক অসাধারন পারফরম্যান্স দিয়ে গিয়েছেন। ২০০৮ সালে কোপা দেল রে এবং ইউয়েফা ইউরো জেতার পর ২০০৯ সালের ব্যালন ডি অরের জন্য মনোনীত হন । এই মৌসুম থেকেই মূলত ভিয়াকে নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে। প্রায় সব বড় ক্লাবই তাকে কিনতে ইচ্ছুক-এমন গুঞ্জনের মাঝে বার্সার ৪০ মিলিয়ন ইউরোর অফারে তাকে কাতালান জায়ান্টদের কাছে বিক্রি করে দেয় ভ্যালেন্সিয়া। নেগ্রেদো, সলদাদোরা আসলেও অনেক ভ্যালেন্সিয়া সমর্থকের কাছেই তার সর্বকালের সেরা ফরওয়ার্ড ‘এল গুয়াজে’।

     

    ভিয়া যাওয়ার পর থেকেই ভ্যালেন্সিয়া সমর্থকদের মনে একটা আশঙ্কা ভর করেছিল; ভিয়ার বদলি যে আসবে, সে কি আদৌ পারবে ভিয়ার ওভাব পূরণ করতে? ভ্যালেন্সিয়া সমর্থকদের মনের সেইসব আশংকার কালোমেঘ দূর করে দেন রবার্তো সলদাদো। ভিয়ার মত ‘খুনে’ গোলস্কোরার না হলেও ১১-১২ মৌসুমে লা লিগার চতুর্থ সেরা গোলদাতা হন। ঐ মৌসুমে সব মিলিয়ে মোট পঁচিশবার জাল খুঁজে পান স্প্যানিশ এই ফরওয়ার্ড। যতদিন ছিলেন, ভ্যালেন্সিয়া সমর্থকদেরকে ডেভিড ভিয়ার অভাব বুঝতে দেননি। ফেগুলি, আলকাসেরকে নিয়ে বেশ দক্ষ একটা আক্রমণভাগ গড়ে তোলেন তিনি। কিন্তু ১২-১৩ মৌসুম শেষে স্পার্সের ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডের অফারে রাজি হয় ভ্যালেন্সিয়া এবং আবারো নিজেদের প্রিয় খেলোয়াড়দের একজনকে বিদায় জানাতে হয় ‘লস চে’ সমর্থকদের।

     

    মাতা, ভিয়ারা ছাড়াও আরো বেশকিছু প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়কে বিক্রি কতে হয়েছে ভ্যালেন্সিয়ার। এদের মধ্যে অ্যাথলেতিক বিলবাও স্ট্রাইকার আদুরিজ, রিয়াল মাদ্রিদের তারকা মিডফিল্ডার ইস্কো, সার্জিও ক্যানালেস, আদিল রামি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

     

    লা লিগাতে বার্সা-রিয়াল ছাড়া অন্যদল গুলো তাদের তারকা খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে না পারাটা লা লিগার ‘দুই ঘোড়ার রেস’ উপাধি পাওয়ার পেছনে অন্যতম বড় কারণ। বার্সা-রিয়াল বাদে লা লিগার একমাত্র চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী দল ভ্যালেন্সিয়া ভিয়াদের ধরে রাখতে পারলে লা লিগার গল্পটা অন্যরকমও হতে পারত।

     


    ভ্যালেন্সিয়া, যা হতে পারতো...