• " />

     

    ডি ভিলিয়ার্স, রেখে যাচ্ছেন অজস্র স্মৃতি...

    ডি ভিলিয়ার্স, রেখে যাচ্ছেন অজস্র স্মৃতি...    

    গ্রেটনেস কী?

    ৩০ রানে চার উইকেট নেই, এমন অবস্থায় এসে ভালো খেলবেন। আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্সের মতে মহত্ত্ব হল যখন আপনি চাপের মধ্যে ভাল খেলতে পারবেন, যখন দলের আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন পারফর্ম করবেন। 

    ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে তারা। ৪৩০ রানের লক্ষ্য সামনে থাকলে দক্ষিণ আফ্রিকার চোখে জয় ঝাপসা না দেখানোর কোন কারণ ছিল না। অ্যাডিলেইডে চতুর্থ দিনে অস্ট্রেলিয়া ৩৮ ওভার ব্যাট করে ডিক্লেয়ার করলে বাকি থাকে দেড় দিনেরও বেশি। বিশতম ওভারেই ৪৫ রানে তৃতীয় উইকেট হারিয়ে ফেলে প্রোটিয়ারা। ভিলিয়ার্স আসেন, রুখেন, রুখতে থাকেন…

    শেষমেশ যখন আউট হন, খেলে ফেলেছেন ২২০ বল, নামের পাশে তার রান ৩৩! তখনও ছিলেন ডু প্লেসি। ডু প্লেসির সঙ্গে ভিলিয়ার্সের পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই। একটা সময় ছিলেন একে অপরের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। পরে দুজনেই হাইস্কুলে একই স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করলে হয়ে উঠলেন বন্ধু! ৩৭৬ বলে ১১০ রান করে যখন ডু প্লেসি মাঠ ছেড়ে ফিরছেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ড্র নিয়েই মাঠ ছাড়ছে। স্কুল ক্রিকেটের দুই পার্টনার ৪০৮ বলে ৮৯ রানের পার্টনারশিপ করে বাঁচিয়ে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে।

    ***

    ক্রিকেট মাঠে ভিলিয়ার্স ‘অবিশ্বাস্য’ কান্ড করতেন। ব্যাট হাতে বিধ্বংসী রুপে যেমন বোলারদের ভয়ের কারণ হতেন, তেমনই ‘কচ্ছপ’ গতির এমন ইনিংস খেলেও। অ্যাডিলেইডের মতো ইনিংসের দেখা মিলেছিল আরও দুবার। দুবারই যদিও দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১৪ সালে কেপটাউনে ২২৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেললেও এড়াতে পারেননি ২৪৫ রানের হার। পরের বছর দিল্লিতে ২৯৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংস খেললেও জুটেছিল ৩৩৭ রানের হার। 

    ‘সে নিজের রানের কথা চিন্তা করে না, দলের অবস্থা চিন্তা করে’, ভিলিয়ার্সকে নিয়ে বলেছিলেন ভিরাট কোহলি। দলের প্রয়োজনে যেমন তিনি ১৪.৪৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করতে পারেন, তেমনই পারেন ৩৩৮.৬৩ স্ট্রাইক রেটে ৪৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসও খেলতে! ভিলিয়ার্সের অ্যাডিলেইডের ইনিংসকেও ‘অবিশ্বাস্য’ বললে ভুল হওয়ার কথা নয়, তবে জোহানেসবার্গে তিনি যা করেছেন, তা বুঝাতে হয়তো অবিশ্বাস্য শব্দটাও অক্ষম! ৪৪ বলে ১৪৯ রানই বুঝিয়ে দিচ্ছে কেমন ইনিংস ছিল সেটি, তবে সেই ১৪৯ রান এসেছে যেভাবে সেটিই ছিল মুলত ‘অসাধারণ! 

    দৃষ্টিনন্দন সব শটের মধ্যে একটি শট আপনার স্মৃতিতে আজীবনের জন্য জায়গা করে নিবে, শাফল করে স্টাম্প ছেড়ে অফসাইডের দিকে সরে এসে হাঁটু গেড়ে ভিলিয়ার্সের স্লগ সুইপ! টি-টোয়েন্টির আগমনে নিত্যু-নতুন উদ্ভাবনী শটের দেখা মিললেও ভিলিয়ার্সের সে শটটা অনন্য তো ছিলই, ছিল আকর্ষণীয়ও! যে শটই হয়তো অনেককে টেনে এনেছে ক্রিকেটে, ক্রিকেটের প্রেমে মজিয়েছে! সবশেষে সেই শটটাই হয়ে গেছে তার পরিচয়। 

    সেই ১৪৯ রানের ইনিংসের পথে ভিলিয়ার্স ওয়ানডেতে ১৬ বলে পঞ্চাশ করে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড করেছেন, ৩১ বলে সেঞ্চুরি করে দ্রুততম সেঞ্চুরির। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন, ২০১৫ সালে আরেক ওয়ানডেতে দ্রুততম দেড়শোর রেকর্ডটারও মালিক হয়ে গিয়েছিলেন ১৬২ রানের ইনিংসে। কিন্ত ভিলিয়ার্সের একটা আফসোস রয়ে গেছে, দ্রুততম দেড়শোটা আরও দ্রুত করা যেত! 

    ভিলিয়ার্স, মরকেল, স্টেইনদের দক্ষিণ আফ্রিকা অধরা বিশ্বকাপ ধরার স্বপ্ন দেখেছিলো ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে জোহানেসবার্গে ঝড় তুলে বিশ্বরেকর্ড গড়লেন ভিলিয়ার্স। এরপর পরের মাসেই সেই বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেললেন ৬৬ বলে ১৬২ রানের ইনিংস, যে ইনিংসে ৬৪ বলে দেড়শো পূর্ণ করে আরেকটি বিশ্বরেকর্ডের মালিক হলেন। পুরো বিশ্বকাপটাতেই দুর্দান্ত খেললেন, শুধু ওই সেমিফাইনাল ছাড়া! ব্যাট হাতে সেদিনও ৪৫ বলে ৬৫ রান করেছিলেন, কিন্ত ফিল্ডিংয়ে সব গড়বড় হয়ে গেল! ভিলিয়ার্সের হাত ফসকে বল চলে গেলে নিশ্চিত রান আউট মিস হয়, ভিলিয়ার্স নিশ্চিত রান আউট মিস করেন স্টাম্পে ডিরেক্ট হিট না করতে পেরে! ৯৬.৪০ গড়ে ৮ ম্যাচে ৪৮২ রান করে সেই বিশ্বকাপের তৃতীয় রান সংগ্রাহক ভিলিয়ার্স মাঠ ছেড়েছেন কাঁদতে কাঁদতে! এরপর আবার সেই ক্ষুধা নিয়ে মাঠে ফেরা, সময়টা তখন বড্ড কঠিন হয়ে গিয়েছিল ভিলিয়ার্সের জন্যে। 

     

    **

    ডি ভিলিয়ার্সের আরও দুই ভাই ছিলেন। একজন নয় ও আরেকজন ছয় বছরে বড়। দুজনই বড় বলে তাদের সাথে ছোট ভিলিয়ার্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই নিজের জায়গা খুঁজে নিতে হতো। ক্রিকেট মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীতার মানসিকতা ছোট থেকেই ছিল ভিলিয়ার্সের মধ্যে। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে পুরো এক মৌসুম খেলার আগেই ডাক পেয়ে গিয়েছিলেন জাতীয় দলে। 'সবার থেকে সেরা' হওয়ার 'ক্ষুধা ও ইচ্ছা' ছিল তার সবসময়ই। আর সে সেরা হওয়ার প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষার বদৌলতে বিশ্বব্যাপীই ভালোবাসা জুটেছে তার কপালে। ২০১৫ সালে মুম্বাইয়ের ওয়াঙ্খেড়ে স্টেডিয়ামে একদিন। ভারতের মাঠে ভারতের বিপক্ষে খেলা, অথচ ভিলিয়ার্স যখন ব্যাট হাতে ড্রেসিং রুম থেকে বাইজ গজের পথ ধরছেন, তখন পুরো মাঠ গর্জন তুলছে 'এবিডি, এবিডি, এবিডি…' 

    ধর্মশালায় একদিন ম্যাচের আগে ওয়ার্ম আপে বের হয়েছেন, গর্জন শোনা যায় 'এবি, এবি, এবি...'। হার্শা ভোগলে তার ক্রিকেট দেখা ক্যারিয়ারে দেখেছেন অনেক রথী-মহারথীদের ভারতে এসে খেলতে, কিন্ত ভিলিয়ার্সের মতো ভালোবাসা পেতে কাউকে দেখেননি তিনি! ভারত, পাকিস্তান, সমস্ত ক্রিকেটঅঙ্গনে যেখানেই আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্সের বিচরণ ঘটেছে সেখানেই তো তিনি 'ভালোবাসা' কুড়িয়েছেন! 

    কিন্ত সেই 'ক্ষুধা ও ইচ্ছা'রও ফুরিয়ে আসার সময় হলো একদিন। হয়তো প্রত্যাশার ভার মেটানোর ম্যারাথন দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। নিজের মনমর্জি মতো বেছে নিয়ে জাতীয় দলে খেলাটা তার কাছে ভালো দেখাচ্ছিলো না। ২০১৮ সালে তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্ত কদিন আগেও সাইত্রিশেও উড়ছিলেন তিনি, এবার সাইত্রিশেই থেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। একেবারে ক্রিকেটটাকেই বিদায় জানিয়ে দিলেন সত্যিকারের এই অলরাউন্ডার! 

    ক্রিকেটমাঠে ছিলেনই অলরাউন্ডার, ক্রিকেটের বাইরেও! তার স্কুল দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেট ও রাগবিতে সেরা ছিল। রাগবি খেলতেন তার বাবাও। ভিলিয়ার্স রাগবির পাশাপাশি টেনিসটাও ভালো খেলতেন। গলফেও তার আগ্রহ ছিল। তবে শেষমেশ বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেট। যেখানে এসে ওপেনিং করেছেন, উইকেটকিপিং করেছেন, বোলিংটাও করেছেন টুকটাক। ডানহাতি মিডিয়াম পেসে ওয়ানডেতে আছে সাত উইকেট, টেস্টে দুটি।

    আর ফিল্ডিং! কখনো বাউন্ডারিতে লাফ দিয়ে এক হাতে লুফে নিচ্ছেন ক্যাচ, তো কখনো স্লিপ থেকে দৌড়ে বাউন্ডারির পাশ থেকে বল কুড়িয়ে থ্রো মেরে করছেন রান আউট! এমন সব ফিল্ডিং করতেন, পেয়ে গিয়েছিলেন 'সুপারম্যান' নাম! শুধু ব্যাটিংটাই ধরলেও তো সেক্ষেত্রেও তো তাকে অলরাউন্ডারই বলা যায়! ব্যাট হাতে ধ্বংসযজ্ঞ যেমন চালাতে পারেন, তেমন পারেন ক্রিজে পড়ে রইতে! ওপেনিং, টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার খেলতে পারেন সবখানে। 

    ওয়ানডে ও টেস্টে পঞ্চাশের বেশি গড়ে আট হাজারের অধিক রান করেই বিদায় বলেছেন। ওয়ানডেতে পঞ্চাশ গড়ের সাথে একশের বেশি স্ট্রাইক রেটে পাচঁ হাজারের বেশি রান করেছেন একমাত্র তিনিই। তবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রেকর্ডটা কিছুটা মলীন। ১৩৫.১৭ স্ট্রাইক রেটে ২৬.১২ গড়ে ৭৫ ইনিংসে করেছেন ১৬৭২ রান। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটাকে তিনি শুরুতে সম্মান দিতেন না বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে, প্রথম বল থেকেই ধুম-ধাড়াক্কা শুরুর কথা ভাবতেন। পরে বুঝতে পেরেছেন এখানেও ভিত্তি গড়ার প্রয়োজন হয়, সময়ের প্রয়োজন পড়ে। টি-টোয়েন্টির বিবর্তনটা তিনি দেখেছেন পুরোপুরিভাবেই, সেই সাথে নিজেও নিজের খেলাটাকে মানিয়ে নিয়েছেন সেভাবে। যার ফলে অনন্য সব শটের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ক্রিকেটবিশ্বের!

    টি-টোয়েন্টিতে ৩৫ গড়ের সাথে দেড়শের বেশি স্ট্রাইক রেটে এক হাজারের বেশি রান করতে পেরেছেন মাত্র দুজন। একজন গ্রাহাম হিক ৩৬ ইনিংসে ১২০১ রান করেছেন। আরেকজন এবি ডি ভিলিয়ার্স, যিনি ৯৪২৪ রান করেছেন, ৩২০ ইনিংস খেলা শেষেও যার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার গড় ৩৭.২৪ ও স্ট্রাইক রেট ১৫০.১৩। কিন্ত  সংখ্যা তার মাহাত্ম্য বলছে সামান্যই।

    সব ফরম্যাট মিলিয়ে ভিলিয়ার্সের বিশ হাজার চৌদ্দ রানের বেশি করেছেন এগারোজন। সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে নিশ্চিত, কিন্ত ভিলিয়ার্স যে একজনই! 

    ভিলিয়ার্স গান খুব পছন্দ করেন। একটা ব্যান্ডও আছে নাকি তার! তিনি বলেন, তার কান খুব ভালো। গানের ছন্দ ধরতে পারেন, তার ব্যাটিংয়ের মতো! তার স্ত্রী আবার পিয়ানো বাজাতে পারেন বেশ ভালো, ভিলিয়ার্সের চোখে দুর্দান্ত! ভিলিয়ার্স পরিবারে দুই ছেলে আছেন। তারা কি ক্রিকেটার হবেন? হলে ক্রিকেটেরই লাভ। আরেকজন ডি ভিলিয়ার্সের জন্য যে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না!