• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    বদলে যাওয়া লামেলা

    বদলে যাওয়া লামেলা    

    ১.
    ২০১১ সালের জুনের শেষ। বুয়েনস আইরেসের মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে এর চেয়ে বিষাদময় দিন আসেনি আগে কখনও। নিজেদের ক্লাবের ১১০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রেলিগেটেড হয়ে গেছে রিভারপ্লেট। গ্যালারির দর্শকদের শোকের প্রতিফলন ঘটছে দাঙ্গায়। আর্জেন্টিনায় তখন শীতকাল সবে মাত্র শুরু হয়েছে। মাঠ থেকে জলকামান নিক্ষেপ করে গ্যালারির দর্শকদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টাইন পুলিশ। রিভারপ্লেটের খেলোয়াড়, কোচ- সবার মুখে হতাশার ছাপ। লাল-সাদা জার্সি দিয়ে বারবার চোখ মুছছিলেন খেলোয়াড়রা। নাকি মুখ লুকোতে চাইছিলেন! স্টেডিয়ামে দর্শকদের দাঙ্গায় সে সুযোগটুকুও মিলছিল না। মাঠ ছাড়তে হল খেলা শেষেরও অনেক সময় পর, পুলিশি পাহারায়।

    বেল্গ্রানোর কাছে হারা ওই ম্যাচে রিভারের দলে ছিলেন এক তরুণ। এরিক লামেলা। পায়ের জাদুতে যার নামের সাথে এরই মধ্যে 'নতুন মেসি' ট্যাগটা জোড়া লেগে গিয়েছে। রিভার প্লেটের ‘নাম্বার টেন’ হতাশা নাকি আকস্মিতায় ভেজা চোখ লুকোতে চাইছিলেন জার্সির আড়ালে। মাত্র ৭ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন এই ক্লাবে। বার্সেলোনার মতো ক্লাবের প্রস্তাবও উপেক্ষা করেছিলেন। শৈশবের ভালোবাসাটা টেনে নিয়ে এসেছিলেন কৈশোরেও। মাত্র ক’দিন আগেই আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছে। রিভার প্লেটের অবনমনে ঘনিয়ে আসলো লামেলার বিদায়বেলাও। লামেলা পাড়ি জমালেন রোমে।

     

    ২.
    ২০১৩ এর গ্রীষ্মের দলবদলের মৌসুমের হট কেক তখন গ্যারেথ বেল। অনেক দিন ধরেই নজর কাড়ছেন বিশ্বের নামী-দামী সব  দলগুলোর। পরের মৌসুমে টটেনহ্যামের চ্যাম্পিয়নস লিগে ঠাই না পাওয়াটাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করছিল। বেলের ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন সত্যি হওয়া তাই অবধারিতই ছিল। বিশ্বরেকর্ড গড়া ট্রান্সফার ফিতে গ্যারেথ বেল রিয়ালে যোগ দেয়ার  আগের দিন লামেলাকে দলে ভেড়ায় স্পার্স। রিভার প্লেট থেকে রোমায় দু মৌসুম খেলে লামেলা ততোদিনে বেশ পরিপক্ক, কিন্তু বেলের মতো তারকাখ্যাতি তাঁর কখনই ছিল না। সিরি আতে প্রথম মৌসুমে নতুন হিসেবেই প্রথম একাদশের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন; পরের মৌসুমে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১৫ গোল করে সিরি আর সর্বোচ্চ গোলদাতাদের পাঁচ জনের তালিকার শেষ নামটিও লামেলার।

    ওয়েলশ ম্যানের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতে একটু তড়িঘড়ি করেই লামেলাকে কেনা হয়েছিল কিনা তা বিতর্কের দাবি রাখে। নিজেদের ক্লাব রেকর্ড ভেঙে ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডে রোমা থেকে লামেলাকে স্পার্সে ভেড়ান তখনকার ম্যানেজার আন্দ্রে ভিয়া বোয়াস। মৌসুমের শুরুতেই পড়লেন ইনজুরিতে। লন্ডনে নিজের ক্যারিয়ারের সূচনালগ্নেই জায়গা হারালেন মূল একাদশে। ডিসেম্বরে এভিবির বিদায়ের পর স্পার্সের দায়িত্ব নেন টিম শেরউড। নতুন ম্যানেজারের অধীনে দলে আরও ব্রাত্য হয়ে পড়েন এই আর্জেন্টাইন। আর সাথে ইঞ্জুরি তো  ছিলই। ইনজুরি জর্জরিত প্রথম মৌসুমে খেললেন মাত্র ১৭ ম্যাচ। পরের মৌসুমের নতুন ম্যানেজার হিসেবে টটেনহ্যাম ঘোষণা করলো মারুসিও পচেত্তিনোর নাম।

    দায়িত্ব নিয়েই লামেলাকে পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিলেন পচেত্তিনো। ইংল্যান্ডের মারমার-কাটকাট ফুটবলের সাথে মানিয়ে নেয়াটা সব ফুটবলারের জন্যই কঠিন। প্রথম মৌসুমটায় সেই মারফতে মাফ পেয়ে গেলেন লামেলা। এবার প্রমাণের পালা। দলের ম্যানেজারও একজন আর্জেন্টাইন। সবার মতো লামেলা নিজেও বোধ হয় আশা করেছিলেন, এবার হয়ত গ্যারেথ বেল না থাকার হা-হুতাশটা কমাতে পারবেন স্পার্স সমর্থকদের।

    বল নিয়ে কারিকুরিতে তাঁকে মেসির সাথে তুলনা দিলে একটু বাড়াবাড়ি হয়। তবে সে ‘বাড়াবাড়ি’টা অতিরঞ্জনের পর্যায়ে না। ড্রিবলিং আর চোখ ধাঁধানো সব কৌশল তাঁর জানা। গোলও করতে পারেন এই উইঙ্গার- খেলোয়াড় হিসেবে লামেলা সম্পর্কে ছোট করে বলতে গেলে এ কথা গুলোই বলতে হয়।

    কিন্তু পচেত্তিনোর কৌশল পুরো উল্টো। অভেদ্য ডিফেন্স ঠিক রেখে তারপর আক্রমণ সাজান; রক্ষণই এই আর্জেন্টাইনের প্রধান আক্রমণ। সেই ধাঁচে একজন ফরোয়ার্ডও বল দখলের জন্য সমান লড়াই করেন, যতোটা তিনি গোলে অবদান রাখতে চেষ্টা করেন। লামেলা এবারও পড়লেন পুরনো সমস্যায়। আক্রমণ ভাগে যেমন তেমন, রক্ষণে যাচ্ছেতাই লামেলা। হ্যাংলা-পাতলা গড়নের অমন খেলোয়াড়কে দিয়ে বল দখলের লড়াই হয় নাকি? হ্যারি কেন, এরিকসনদের সাথের বোঝাপড়াটাও অধারাবাহিক। প্রথম মৌসুমে যথেষ্ট ম্যাচ খেলতে পারেননি, দ্বিতীয় মৌসুমেও অধারাবাহিক। এমন অযাচিত সোনার হরিণ পুষবার মতো বিলাসিতা স্পার্সের নেই। ইউটিউবে এমন অনেক খেলোয়াড়ের ভিডিওই পাওয়া যায়। বল নিয়ে তাঁদের কারিকুরি দেখলে মনে হয় বিশ্বের সেরা কোন খেলোয়াড়ই হবেন তিনি। লামেলাও বোধ হয় তাঁদেরই একজন। মোটা দাগে যাকে বলে ‘ফ্লপ’।  

    পচেত্তিনোর অধীনে প্রথম মৌসুমে দল ভালোই করল। প্রিমিয়ার লিগে পঞ্চম হওয়ার পাশাপাশি স্পার্স উঠল লিগ কাপের ফাইনালেও। গ্যারেথ বেলের জায়গার শুন্যতা রয়ে গেল ঠিকই। অনুমিতভাবেই পরের মৌসুম শুরুর আগেই লামেলাকে বিক্রির তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেল। দলবদলের শেষদিনে অলিম্পিক মার্শেইতে লামেলার যোগ দেয়াও প্রায় নিশ্চিত। কোনো এক দৈব কারনে হয়েও হল না; লামেলা থেকে গেলেন নর্থ লন্ডনেই।

     

    ৩.

    এরিক লামেলার বদলে যাবার গল্পের শুরুটা এখন থেকে। থাকতে হলে যে নিজেকে প্রমাণ করেই থাকতে হবে এখানে। এই মানসিকতাই বদলে দিল লামেলার কপাল। এমন বোধ হয় খুব বেশি খেলোয়াড় পাওয়া যাবে না যারা টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজের খেলা বদলাতে পারেন বা বদলে দেবার সেই দুঃসাহস দেখান। এ কথাটি আরও প্রযোজ্য একজন আর্জেন্টাইনের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে মাত্র ২০ বছর বয়সে যার আর্জেন্টিনা দলে অভিষেক, নতুন মেসির ট্যাগটা যার নামের সাথে ঝুলেছে- তাঁর জন্য তো কোনোভাবেই না।

    লামেলা তাইই করলেন, বদলে দিলেন নিজের খেলার ধরন। হ্যারি কেন, এরিকসন, ড্যালে অ্যালিকে নিয়ে পচেত্তিনোর প্রথম রক্ষণের সবচেয়ে বড় ভরসা এখন এই আর্জেন্টাইন। এক মৌসুম আগেও যে খেলোয়াড় বল পায়েই রাখতে পারতেন না, তিনিই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সারা মাঠ। উইং ধরে অ্যাটাক থেকে ডিফেন্স নামছেন, আবার উঠছেন। অ্যাটাক থেকে বল হারানোর ৩ সেকেন্ডের ভেতর বল ফেরত আনার চাঁচাছোলা নিয়মটাও রপ্ত করে ফেলেছেন। কখনও কখনও প্রতিপক্ষের ফুলব্যাককে আটকে রেখে স্পার্সকে সাহায্য করছেন আক্রমণে। গোল করেছেন নিজেও। এই মৌসুমে ১০ গোলের পাশাপাশি, অ্যাসিস্ট ও আছে ৭টি। আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি দল দখল করেছেন। হ্যাংলা-পাতলা সেই ছেলেটার ওয়ার্করেট এখন ঈর্ষনীয় পর্যায়ের।

    লামেলা ছাড়া স্পার্স তাই এখন অনেকটাই লাগামছাড়া। খুব সাম্প্রতিক একটা উদাহরণই টানা যাক। স্পার্স ম্যানেজার মারুসিও পচেত্তিনো এই মৌসুমে ভুল করেছেন অল্পই। তবে চোখে লাগার মতো ভুলগুলোর মধ্যে একটা ছিল মার্চে আর্সেনালের বিপক্ষের ম্যাচে। ২-১ গোলে এগিয়ে থাকার সময় লামেলাকে বদলী করে মেসনকে মাঠে নামান টটেনহ্যাম ম্যানেজার। এরপরই গোল খেয়ে বসে স্পার্স। অথচ এর আগ পর্যন্ত বেশ অভেদ্যই মনে হচ্ছিল স্পার্সের ডিফেন্স। ওই ম্যাচে পুরো ৩ পয়েন্ট বাগিয়ে নেয়া গেলে এখন হয়ত লেস্টারের পেছনে থেকে আফসোসে পুড়তে হত না পচেত্তিনোকে।

    ওপরের লেখা পড়লে কারো কারো মনে হতে পারে লামেলা বুঝি পুরোদস্তর একজন ডিফেন্ডারেই পরিণত হয়েছেন। তাঁদের ভুল ভাঙাতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। গত দুই ম্যাচের অপ্রতিরোধ্য টটেনহ্যামের খেলা দেখলেই চলবে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ের ম্যাচে এক গোল, এক অ্যাসিস্ট সাথে প্রথম গোলের আক্রমণের সূচনাটাও তাঁর পা থেকেই। পরের ম্যাচে স্টোক সিটির বিপক্ষে আরও উজ্জ্বল ‘ফরোয়ার্ড’ লামেলা। গোল না পেলেও পুরো ম্যাচ জুড়েই ছিলেন লামেলা; নিঃসন্দেহে স্পার্স ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।     

    স্পার্সের এই মৌসুমের সাফল্যের পেছনে হ্যারি কেন, ড্যালে অ্যালে, কাইল ওয়াকারদের নামের সাথে লামেলার নামটা হয়ত আসবে অনেক পরেই, কিন্তু তাতে কোনোভাবেই খাটো করা যাবে না এই ২৪ বছর বয়সী উইঙ্গারের অবদান। লামেলা হয়তো বিশ্বসেরাদের কাতারের কেউ একজন হতে পারেননি, যেমনটি কয়েকবছর আগেও ধারণা করেছিলেন অনেকে। পারেননি গ্যারেথ বেলের মতো কারও অভাব পূরণ করতেও। তবে স্পার্সের প্রয়োজনটা মিটিয়েছেন ঠিকই। বেল লেফট ব্যাক থেকে বনে গিয়েছিলেন উইঙ্গার। এই আর্জেন্টাইন ঘটালেন উল্টো ঘটনা। তিনি এমন এক উইঙ্গার যিনি গোল করেন, করানও আর যার পা থেকে একবার বল কেড়ে নিয়ে গেলে আপনাকে তাড়া করে ফিরবেন আপনার বাড়ি পর্যন্ত।

    প্রিমিয়ার লিগ শুধু নয় পুরো ফুটবলের ইতিহাসটা নতুন করে লেখার খুব কাছাকাছি লেস্টার সিটি। লেস্টার সিটির গল্পের কাছে লামেলার বদলে যাওয়ার গল্পটা সাদাকালো, সিনেমার স্ক্রিপ্ট হবার অযোগ্য। লেস্টার সিটির কাছ থেকে যদি নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজে পান আপনি; লামেলা আপনাকে শোনাবেন টিকে থাকার গল্প। যেখানে সবসময় নিজের ইচ্ছে বা মতের দিকে যাওয়া যায় না। ভাগ্যও সহায় না। প্রয়োজনের তাগিদে কাজের কাজটা করে দিতে হয়। সফলতাটা আসে তখনই।

    বদলে যাওয়া লামেলা তাঁর ও তাঁর কোচের এক অপরূপ সৃষ্টি। বদলে গেলে যদি সফল হয়ে যাওয়া যায়, তবে বদলে যাওয়াই তো ভালো! দিনশেষে তো সফলদের গল্পটাই বলি আমরা।