• বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ
  • " />

     

    সিলেটে কেন রান নেই?

    সিলেটে কেন রান নেই?    

    প্রেসবক্সে এক সাংবাদিক ঢুকেই বললেন, মিরপুর থেকে সিলেটে আসার পর মনে হয়, গ্রাম থেকে এসেছি। শেরে বাংলা স্টেডিয়াম থেকে চোখ যখন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য্যের দেখা পায়, তখন আসলে সেই সৌন্দর্য্যে অভিভূত না হয়ে উপায় নেই, বলছিলেন সেকথা। সিলেট স্টেডিয়ামের রুপে পাগল হন আসলে সকলেই। তবে আসল সৌন্দর্য্য তো ওই বাইশ গজের মধ্যেই লুকায়িত, যাতে পাশ মার্ক পাওয়া থেকে এখন কিছুটা দূরেই আছে সিলেট স্টেডিয়াম। 

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগ থেকেই স্টেডিয়াম প্রাঙ্গনে শোনা যাচ্ছিলো স্পোর্টিং উইকেটের গান। বিসিবি পরিচালক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এবং নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনও স্পোর্টিং উইকেটের কথাই শুনিয়েছিলেন। কিন্ত বিসিএলের প্রথম তিন দিনের খেলা শেষে দেখা মিললো ভিন্ন এক চিত্রেরই। বল পিচে বাউন্স করে উইকেটকিপারের কাছে সরাসরি পৌছানোর আগে সবুজ ঘাসের সঙ্গেও একবার মোলাকাত করে যাচ্ছে, এমন দৃশ্যেরও দেখা মিলেছে কয়েকবার। উইকেট ছিল স্লো এবং লো। 

    অতিরিক্ত বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত বারো ইনিংসের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতেই স্কোর দুই শ পেরিয়েছে সিলেট স্টেডিয়ামের দুই মাঠে। প্রথম দিনে তো এক ম্যাচে ১৭৮ রানও লক্ষ্যতাড়া করাটাও বেশ দূরহ হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক ইস্ট জোনের দ্বারা তা সম্ভবও হয়নি, ২২ রান দূরেই থেমেছিল ইমরুল কায়েসের দল৷ সেদিনের অন্য ম্যাচে সাউথ জোনের পুঁজিটা বেশ অল্প ছিল। ১৬৩ রানের লক্ষ্যটা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল পারভেজ হোসেন ইমনের ৫৪ বলে ৫৪ রানের ইনিংসে। এখন পর্যন্ত হওয়া চৌদ্দ ফিফটির মধ্যে যে চারটিতেই মাত্র স্ট্রাইক রেট আশির উপরে ছিল, তার মধ্যে ইমনেরটা একটি। 

    দ্বিতীয় দিনে সিলেট স্টেডিয়ামের মূল মাঠে ১৯২ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল তামিম ইকবালের ইস্ট জোন। ২৭ বল খেলে ওয়ানডে অধিনায়ক করতে পেরেছিলেন ৯টি রান। ইমরুল কায়েসও ধীরগতির সে পিচে রান করেছেন ৬৯। তবে তিনিও যে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে গেছেন তা কিন্ত না। সেই রান করতেও তার লেগে গিয়েছিল ৯৭ বল। আর ভোগান্তির কথা বললে আসলে বলতে হয় মোহাম্মদ আশরাফুলেরই কথা। ৫৭ বলে ১৫ রানের ইনিংসই তো তুলে ধরছে ক্রিজে কতটা অসহায় ছিলেন এই ব্যাটসম্যান৷ যদিও তাতে শুধু পিচের দায় দেয়া হলে সেটি হবে নেহাতই এক 'অজুহাত'!

    সিলেট স্টেডিয়াম লাগোয়া একাডেমি মাঠে অবশ্য দ্বিতীয় দিনে রানের দেখা মিলেছে। দুটি ইনিংসেই স্কোর দুইশের অধিক হয়েছিল৷ তবে সেখানেও যদিও পিচ ততটা ব্যাটিং সহায়ক ছিল না। কৃতিত্বের সিংহভাগই যায় ব্যাটসম্যানদের পক্ষে। সে পিচে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে লো বাউন্সের কাছে পরাস্ত হয়ে হতাশ হওয়ার দৃশ্যটা দেখা গেছে বারবার। সেখানেও প্রথম ম্যাচে ৬২ রান করা নাঈম ইসলাম দ্বিতীয় ম্যাচেও দারুণ ছন্দে ছিলেন, তবে তাঁরও ৭২ রানের ইনিংসটা ছিল ৯২ বলের। 

    চার-ছক্কা কিংবা রানকেই যদি উপভোগের মূল উপকরণ ধরেন, তাহলে সে বিবেচনায় সিলেট স্টেডিয়ামের পাশ মার্ক তুলাটাই কি বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়াল? প্রথম চার ম্যাচে প্রতি ইনিংসে গড় রান ছিল প্রায় ১৯২। অতিরিক্তবিহীন যে ম্যাচে ওভারপ্রতি সবচেয়ে বেশি রান এসেছে, সেটিও ৪.৫৫ এর বেশি নয়৷ অতিরিক্ত বাদ দিলে দেখা যায়, আট ইনিংসের পাঁচটিতেই ওভারপ্রতি রান এসেছে চারের কম। 

    প্রথম রাউন্ডের ছয় ম্যাচে যে চৌদ্দ ফিফটি হয়েছে, তার মধ্যে দশটিতেই স্ট্রাইক রেট ছিল আশির কম। ব্যাটসম্যানদের জন্য স্পিন সামলানোটা বেশ কষ্টকরই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সব দলের অধিনায়কই তাই ব্যাটারদের সামনে স্পিন ছুড়ে দেওয়াতেই আগ্রহী। প্রতিটি ম্যাচেই স্পিনাররাই মোট ওভারের প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার বোলিং করেছেন। সবমিলিয়ে প্রথম চার ম্যাচে ৩৬০ ওভারের মধ্যে ২২৬.২ ওভার বোলিংই করেছেন ঘূর্ণিবাজরা। তাতে তারা ওভারপ্রতি রানও দেননি ৩.৬৪ এর বেশি করে। বলা যায়, সিলেটের পিচ তাই উপভোগ্যই হয়ে উঠেছে স্পিনারদের জন্য। ব্যাটসম্যানদের জন্য হয়তো ঠিক ততটাই অস্বস্তির!

    এক শ স্ট্রাইক রেটেই খেলাটা যেখানে অনেক কষ্টসাধ্য! সেদিন অবশ্য ১০০ স্ট্রাইক রেটে খেলা একজন ব্যাটসম্যানও আশা করছিলেন, উইকেটটা আরেকটু ভালো হতে পারতো। তৃতীয় দিনের খেলা দেখতে আসা ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুসেরও আশা ছিল ঠিক তেমনই। আচ্ছা, বাংলাদেশের পিচের চরিত্রই তো এমন! তাহলে এত হাহুতাশ কেন? আশা যখন নিরাশায় পরিণত হয় তখনই যে হাহুতাশের জন্ম হয়৷ সিলেটের পিচগুলো স্পোর্টিং হবে সে আশাটাই এর পেছনের কারণ! 

    আচ্ছা, ব্যাটসম্যানদের এই ভোগান্তির কারণ হিসেবে কি পিচই শুধু দায়ী? ওয়ানডে ক্রিকেটের সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেটারদের দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে বহুদিনে। লম্বা সময়ই ছিলেন তাঁরা লংগার ভার্সন ক্রিকেটের আঙ্গিনায়। জাতীয় ক্রিকেট লিগের পর খেলেছেন লাল বলের বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ। দীর্ঘদিন সাদা পোশাকে খেলে এসে নির্দিষ্ট ওভারের ক্রিকেটে মানিয়ে নিতেও সময় লাগতে পারে, সে কারণটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সময় গড়ানোয় মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা খানিকটা স্পষ্টও হয়েছে তৃতীয় দিনের খেলায়। 

    তৃতীয় দিনের দুই খেলায়ই স্কোর দুইশের অধিক হয়েছে। তবে প্রথম দুই দিনের তুলনায় সেদিনও পিচে আসলে আসেনি আহামরি পরিবর্তন। যদিও পিচ মন্থরতা খানিকটা কমানোর সঙ্গে লো বাউন্সও কমিয়েছে কিছুটা। একাডেমি মাঠে রিয়াদ, মার্শালের ফিফটির পরও ২১৭ রানের সংগ্রহই ছিল নর্থ জোনের। যা তামিমের ৩৫ রানের পর ইমরুলের ফিফটিতে অবশ্য সহজেই পেরিয়ে গেছে ইস্ট জোন।

    মূল মাঠে সাকিববিহীন সেন্ট্রাল জোন ভুগেছে বেশ। একসময় দুই শ রানও দুঃসাধ্য মনে হওয়া সেন্ট্রাল জোন শেষমেশ ২২০ রানে পৌঁছে গিয়েছিল, আবু হায়দার রনির ২৭ বলে ছয়টি চার ও চারটি ছয়ে ৫৪ রানের ইনিংসের বদৌলতে। সাউথ জোন হৃদয়ের অপরাজিত ৬৬ রানের ইনিংসের অবদানে লক্ষ্যতাড়া করতে সমর্থ হয়েছিল ৮ বল হাতে রেখেই, তবে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাদেরও। 

    নির্বাচক প্যানেলের সদস্য হাবিবুল বাশার সুমন টুর্নামেন্টের শুভ সূচনার আগেই সিলেটে পা রেখেছেন। ক্রিকেটারদের প্রতি তাঁর নজর তো থাকবেই, নিঃসন্দেহে থাকবে সিলেটের পিচের প্রতিও! আফগানিস্তান বাংলাদেশে আসবে বিপিএল শেষ হতে না হতেই। জালাল ইউনুস আজ জানিয়েছেন, সেই সিরিজে তিন ভেন্যুই বিবেচনায় থাকবে। অর্থাৎ, সিলেট স্টেডিয়ামেরও তাই সুযোগ আছে বহুদিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়ার। কিন্ত নির্বাচক হাবিবুল বাশার ঘরোয়া ক্রিকেটারদের রিপোর্ট কার্ড যেমন জবা দিবেন, তেমনই নিশ্চয়ই দিবেন সিলেট স্টেডিয়ামেরও!

    জালাল ইউনুস আফগানিস্তান সিরিজে চট্টগ্রাম ভেন্যু নিশ্চিত করেছেন। আগে শোনা গিয়েছিল ঢাকায় আফগানিস্তান সিরিজ নাও হতে পারে। কিন্ত সিলেটের পিচও যদি কিছুটা ভালো না হয়, তবে সেক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে সিলেট। জৈবসুরক্ষা বলয় তৈরির কঠিন কাজটাও মাথায় রাখতে হবে। আর সে ঝামেলা পুহিয়ে আবার এ ধরনের পিচেই আফগানিস্তানের স্পিনের সামনে তো নিশ্চয়ই পড়তে চাইবে না বাংলাদেশ। পরীক্ষায় ভালো করার সুযোগটা যদিও এখনই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বিপিএলের ছয়টি ম্যাচও যে এখানেই হতে যাচ্ছে! 

    সবুজে ঘেরা সিলেটের স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দেখা পেয়েছিল সেই ২০২০ সালে। এরপর বড় টুর্নামেন্ট হয়নি খুব একটা। আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দল সফরে এসেছিল, নারী দলের খেলাও হয়েছে। জাতীয় লিগের অনেক ম্যাচও হয়েছে। সেসবের কোনটিতেই করোনাকালীন বাস্তবতায় দর্শকদের সামিল হওয়ার সুযোগ ছিল না। এবারের বিসিএলেও নেই। সাকিব-তামিম-রিয়াদদের উপস্থিতি তবু জৌলুস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে এই আসরের। 

    মাঠকর্মীদের ব্যস্ততা ও গণমাধ্যমকর্মীদের আগমনে তাই সিলেট স্টেডিয়াম সরগরম। সেটি সত্যিকারেরই এক উৎসবে পরিণত হতে পারতো, যদি প্রাণেরও উপস্থিতি থাকতো। বিপিএলে দর্শকরা ফেরার সুযোগ পেলে সেই উৎসবের দেখা মিলবে। তবে আপাতত, সিলেটের ক্রিকেটপ্রেমীদের চাওয়া হয়তো একটাই থাকবে, সে উৎসব শুরু হওয়ার আগেই যেন তাতে জল না ঢেলে দেয় 'পিচ'!