• অন্যান্য
  • " />

     

    ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো: জন্মেই যার নিয়তি ছিল ফুটবল

    ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো: জন্মেই যার নিয়তি ছিল ফুটবল    

    মাদেইরা জায়গাটা পর্তুগালের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে লিসবন থেকে প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার দূরে। মরক্কোর উপকূলও খুব দূরে নয় অবশ্য। আটলান্টিকের পাড়ে ছবির মতো এই মাদেইরার রাজধাহী ফুনচাল। জনসংখ্যা কত হবে? লাখখানেকের কিছু বেশি। এর মধ্যে কুয়েন্তা দো ফলকাও জায়গাটা আবার এক প্রান্তে, সেখানে মূলত শ্রমজীবি মানুষেরাই বেশি। রোনালদোর বাবা হোসে দিনিস আভেইরো আর মা মারিয়া দলোরেস দস সান্তোসও তাই ছিলেন। বাবা ছিলেন মালী আর মা রাঁধুনী, সংসারটা তাদের টানাটানিরই ছিল। বড় তিন ভাই আগেই জন্ম নিয়েছিলেন, রোনালদোকে পৃথিবী আনার পরিকল্পনাটাও খুব পরিকল্পনা করে ছিল না বলেই পরে জানিয়েছেন মারিয়া। ছোট্ট একটা বাসায় থাকতেন তারা ছয় জন, তার এখানে ওখানে খসে যাওয়া রঙচটা পলেস্তারা উঁকি দেয়। জোর বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পানি পড়তে থাকে, ছেলেমেয়েদের এককোণায় নিয়ে বাবা মাকে সামলাতে হয় বৃষ্টির পানি ঠেকাতে। বাসাটা এতোই ছোট, নিজেদের পুরনো মডেলের ওয়াশিং মেশিনটাও সেখানে রাখার জায়গা ছিল না। বারান্দায় রাখতে হয়েছিল মেশিন, সেখানে আরও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না।

    দিনিস লোকটা মালী হলেও আসলে তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল ফুটবল। স্থানীয় ক্লাব আন্দোরিনহাতে ফুটফরমাশ খাটতেন অবসরে, টুকটাক খেলতেনও মাঝেমধ্যে। রোনালদো নামটা এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে, মারিয়া-দিনিস দুজনেই তার ভক্ত ছিলেন। আর ক্রিশ্চিয়ানো নামটা রেখেছিলেন খালা। দিনিসের যে চতুর্থ ছেলেকে ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন খুব একটা ছিল তা নয়, কিন্তু ফুটবলের সঙ্গে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে মিতালি হয়ে গেল রোনালদোর জন্মের পর পরেই।

    মারিয়া-দিনিস দুজনেই ছিলেন ক্যাথলিক। নিয়ম অনুযায়ী ছেলেকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা তো দিতে হবে। তো ছেলেকে যেদিন এই দীক্ষা দেওয়ার কথা, সেদিন আবার আন্দোরিনহার একটা ম্যাচ পড়ে গেল। আবার কাউকে তো গডফাদার বানাতে হবে,দিনিস ক্লাবের অধিনায়ক ফেরনাও সোসাকে অনুরোধ করলেন। সোসাও রাজি হলেন, তবে আগে তো ম্যাচটা শেষ করতে হবে। ম্যাচ শুরু চারটায়, ওদিকে ফাদার সময় দিয়েছেন ছয়টায়।

    এদিকে সময় হয়ে গেল, মায়ের কোলে চড়ে ছোট্ট রোনালদো চলে এসেছে। কিন্তু বাবা আর ধর্মপিতার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছেন ফাদার। ম্যাচ শেষ করে আধ ঘণ্টা দেরিতে এলেন দুজন। রোনালদো দীক্ষা পেলেন ক্রিস্টধর্মে।

    আন্দোরিনহাতেই যে রোনালদোর ফুটবলের হাতেখড়ি হবে, সেই চিত্রনাট্য আসলে আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। তবে রোনালদো যে বাকি দশটা চেয়ে অন্যরকম ফুটবল খেলে, সেটা ছেলেবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলেন দিনিস। মা আর দুই বোনের অবশ্য ফুটবল নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ছোট্ট রোনালদো গোল করে আসার পর দিনিস বলত, আজ ছেলেটা দারুণ খেলেছে- মারিয়া আর দুই মেয়ের মধ্যে সেটা নিয়ে তেমন কোনো ভাবান্তর ছিল না। ছেলেমানুষ তো ফুটবল খেলবেই, গোলও দেবে- সেটা এত বড় করে বলার কী আছে। কিন্তু মারিয়া যখন মানুষের কাছ থেকে শুনতে শুরু করলেন, ‘তোমার ছেলে কিন্তু বড় ফুটবলার হতে পারে একদিন’, ভাবলেন একদিন ছেলের খেলা দেখতে যাওয়া দরকার। ছোট্ট রোনালদো দেখল, বাবার সাথে মাঠের পাশে তিন ভাই বোনও দাঁড়িয়ে আছে।

     

    **

    আন্দোরিনহা অধিনায়ক সোসার সবসময় আলাদা একটা দৃষ্টি ছিল ধর্মপুত্রের প্রতি। প্রায়ই দিনিসের কাছে জানতে চাইতেন ছেলে কেমন আছে। একবার রোনালদোর জন্মদিনে একটা রিমোট কন্ট্রোল চালানো গাড়ি দিয়েছিলেন সোসা। কিন্তু রোনালদো সেটা রেখে বল নিয়েই কাটিয়ে দিত বেলা। রাতে ঘুমোতে যেত ওই বল নিয়েই, এক মুহূর্তের জন্যও ওটা কাছছাড়া করা যাবে না। রোনালদো এদিকে বড় হতে শুরু করল। স্কুলে সে খারাপ ছাত্র ছিল না। হাসিখুশি আর মিশুক হিসেবেই জানত সবাই। ফুটবলের যে সে পোকা, সেটা ক্লাসটিচার থেকে শুরু করে বন্ধুরা সবাই জেনে গিয়েছিল। রোনালদো এদিকে বাসায় এসে সামান্য বাড়ির কাজ সেরে আবার ব্যস্ত হয়ে যেত ফুটবল নিয়ে। মা আর বাবা কাজে থাকতেন বলে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখারও সুযোগ হতো না। এর মধ্যেই খেলা চলত রাস্তায়, ইট দিয়ে বানাতে হতো গোলপোস্ট। মাঝেমধ্যে শুধু ওপাশের বাগানে বল গেলে একটু তটস্থ থাকতে হতো। বাগানের মালিক বদরাগী ছিলেন বেশি, বলটা একবার পেলে সহজে দিতে চাইতেন না। এর মধ্যে আন্দোরিনহাতে হাতেখড়ি হয়ে গেছে রোনালদোর, নয় বছর বয়সে প্রথম আনুষ্ঠানিক স্পোর্টিং লাইসেন্স পেল- ফুটবলার নম্বর ১৭১৮২। তখন থেকেই লম্বায় বেশ বেড়ে উঠছিল রোনালদো, কিন্তু গায়ে একরত্তি মাংস নেই যেন। খেতেও চাইত না বেশি, সেজন্যই অমন লিকলিকে। বড়দের সাথে খেলতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হলে পড়েও যেত। কিন্তু রোনালদো এত বেশি ক্ষিপ্র ছিল, তাকে ধরতে পারার সাধ্য কী?  মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে বেড়াত সে যেন, সেজন্য তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ছোট্ট মৌমাছি’। অনেক বছর পর মাদ্রিদে নিজের প্রিয় কুকুরের নাম সেটিই রেখেছিলেন রোনালদো।

    আন্দোরিনহাতে সময়টা খারাপ কাটছিল না রোনালদোর, বয়সভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলাও শুরু করল। কিন্তু দলে রোনালদো ছাড়া বাকি ফুটবলার সবাই তেমন একটা ভালো ছিলেন না। এলাকার ছোট্ট ক্লাব, আসলে আন্দোরিনহার খুব একটা উচ্চাশাও ছিল না। কিন্তু হেরে গেলেই রোনালদোর মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। ফুটবল তো আর একা জেতা যায় না, নিজে চেষ্টা করার পরও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে এঁটে ওঠা কঠিন হতো। একটা সময় আন্দোরিনহা তাই হেরে যাচ্ছিল টানা। রোনালদো তখন মাঠে নামতে চাইত না একেবারেই, হারাটা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারত না। আর হেরে গেলেই কেঁদেকেটে একাকার করে বাড়ি ফিরত। মারিয়া আদর করে ছেলের নাম দিয়েছিলেন ছিঁচকাদুনে। এরপর ফুটবল মাঠে অনেকবারই কেঁদেছেন রোনালদো, কষ্টের সঙ্গে আছে আনন্দের কান্নাও। চোখের পানি লুকানোর কোনো চেষ্টাই গোপন করেননি কখনো।

    (এই লেখাটি অম্লান মোসতাকিম হোসেনের নায়কদের নেপথ্যে বইয়ের অংশবিশেষ। রোনালদোসহ ক্রীড়াজগতের ১১ মহারথীর গল্প আছে এই বইয়ে। প্রি অর্ডার করুন এখানে  বা এখানে)