• বঙ্গবন্ধু বিপিএল ২০২২
  • " />

     

    তারকাদের পাশাপাশি বিপিএলে চমকে দিচ্ছেন যেসব 'অখ্যাতরা'

    তারকাদের পাশাপাশি বিপিএলে চমকে দিচ্ছেন যেসব 'অখ্যাতরা'    

    বঙ্গবন্ধু বিপিএলের এবারের আসরের সিলেট পর্বের আগে চমক দেখিয়েছেন আনকোরা অনেকেই; আবার নিজেদের মেলে ধরেছেন এমন অনেকেই যারা ছিলেন নিজেদের দলের বাজির ঘোড়া। এরকমই কিছু খেলোয়াড়দের পারফর্ম্যান্সের সারমর্মই এখানে তুলে ধরা হল।

    চমক দেখাচ্ছেন যারা

    উইল জ্যাকস
    ম্যাচ: ৮
    রান: ২৮০
    স্ট্রাইক রেট: ১৫৮.১৯

    টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এই ইংলিশকে হয়ত কেউ হিসাবেই রাখেনি; এমনকি প্রথম একাদশে তার নিয়মিত সুযোগ পাওয়াটাও ছিল সন্দিহান। সেই উইল জ্যাকস এবার ব্যাট হাতে খেলেছেন বিস্ফোরক সব ইনিংস, যার প্রমাণ তার স্ট্রাইক রেট। ইনিংস লম্বা করতে পারেননি যেসব ম্যাচে সেখানেও এনে দিয়েছেন ঝড়ো শুরু। একটি ম্যাচে প্রথম ওভারেই ফিরে গিয়েছেন। বাকি সব ম্যাচেই তার কার্যকারিতার প্রমাণ ৩ ফিফটি সহ তার ৩৫ ব্যাটিং গড়। পাওয়ারপ্লেতে তিনি ব্যাট করেছেন ৮ ইনিংসেই। শুধু পাওয়ারপ্লের ব্যাটিং বিবেচনায় নিলে তার ব্যাটিং গড় হয়ে দাঁড়ায় ৬৫ ও স্ট্রাইক রেট হয়ে দাঁড়ায় ১৮০.৫৫! চট্টগ্রামের ঝড়ো ব্যাটিংয়ের কান্ডারি এই ডানহাতি ইংলিশ মেরেছেন টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ১৪টি ছয়ও।


    বেনি হাওয়েল
    ম্যাচ: ৮
    রান: ১৬৪
    স্ট্রাইক রেট: ১৬৫.৬৫
    উইকেট: ৩

     
    এবারের আসরে কমপক্ষে ১০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে এই ইংলিশ অলরাউন্ডারের স্ট্রাইক রেট সর্বোচ্চ। ডেথ ওভারগুলোতে ব্যাটিংকে এবার তিনি নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। যেসব উইকেটে অন্যদের হাত খুলে খেলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে সেখানেও তিনি খেলেছেন দারুণ সব ক্যামিও। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০টি ছয় এসেছে তার ব্যাট থেকে। শুধু তাই নয়, আধুনিক যুগে বোলারদের অভিযোজনের আদর্শ এক নিদর্শনরুপেই এবার মেলে ধরেছেন নিজেকে। মিডিয়াম পেসার হিসেবে পরিচিত হাওয়েল এবার প্রায়ই করেছেন অফ স্পিন, মাঝেমধ্যে করেছেন লম্বা রানআপে লেগ স্পিনও। উইকেট হয়ত খুব একটা পাননি, তবে তার ৭.২৪ ইকোনমি রেট তার হয়েই কথা বলে। ব্যাটে-বলে সিদ্ধহস্ত হাওয়েল টুর্নামেন্ট শেষে হয়ত টুর্নামেন্ট সেরাদের দৌড়েও থাকবেন শীর্ষ সারিতে।

     

    কামরুল ইসলাম রাব্বি
    ম্যাচ: ৬
    উইকেট: ১১

    খুলনার হয়ে এবার ধারাবাহিকভাবেই উইকেটের মাঝে ছিলেন কামরুল ইসলাম রাব্বি। এবারের আসরে তার সেরা বোলিং ফিগার ৩/৪৫ হওয়া সত্ত্বেও ১১ উইকেট নিয়ে তিনি টুর্নামেন্টে যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। ৯.৮৫ ইকোনমি রেট অবশ্য তার চিন্তার খোরাক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে উইকেট শিকারের দিক দিয়ে তিনি যে সামনের সারির একজন তার প্রমাণ তিনি রেখে চলেছেন প্রতি ম্যাচেই।   

    নাহিদুল ইসলাম
    ম্যাচ: ৫
    উইকেট: ৯
    ইকোনমি রেট: ৪.৫৭

    দেশের ক্রিকেট বিবেচনায় এই আসরের সেরা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে নাহিদুল ইসলাম। কমপক্ষে ১৫ ওভার বল করা বোলারদের মধ্যে এই আসরের সেরা ইকোনমি রেট ও সেরা বোলিং গড় (৯.৬৬) তার। তার পরিসংখ্যান আরও মাহাত্ম্য পায় তার পাওয়ারপ্লে বোলিংয়ের জন্য। এবারের আসরে কুমিল্লার প্রধান পাওয়ারপ্লে বোলার ছিলেন তিনি। শেষ দুই ম্যাচে কিছুটা খরুচে হওয়ার পরেও তার পাওয়ারপ্লে ইকোনমি রেট ৪.৭৮! ৯ উইকেটের মাঝে ৬টি উইকেটও তিনি পেয়েছেন পাওয়ারপ্লেতেই। স্টাম্পের রাস্তায় টানা বল করে যাওয়ার যে অনন্য দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন তা নিশ্চিতভাবেই ব্যাটারদের ভাবিয়েছে; সাথে আছে তার কার্যকর আর্ম বল। ব্যাটারদের কাছে দুষ্পাঠ্য নাহিদুল টুর্নামেন্ট শেষেও তাই হয়ত থাকবেন উইকেটশিকারীদের তালিকায় শুরুর দিকেই।   

    মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী
    ম্যাচ: ৪
    উইকেট: ৮
    স্ট্রাইক রেট: ৭.৮

    আসরের প্রথম হ্যাটট্রিক এসেছে তার হাত ধরে। সিলেট যখন লক্ষ্যের দিকে বেশ শক্তভাবেই এগুচ্ছিল তখনই মৃত্যুঞ্জয়ের ওই হ্যাটট্রিকে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে তাদের ইনিংস। পরের ম্যাচেও হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন তিনি; তা না পেলেও মাত্র ২ ওভারেই নিয়েছেন ৪ উইকেট। দারুণ সব ওয়াইড ইয়র্কারের পসরা সাজিয়ে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। ২০২০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। টুর্নামেন্টের মাঝপথে সেবার ছিটকে পড়ার আক্ষেপটা হয়ত তাকে এখনও পোড়ায়। তবে সেসব পেছনে ফেলে তিনি যে নিজেকে প্রমাণ করতেই মনযোগী তার প্রমাণ তিনি দিয়ে চলেছেন এবারের আসরের প্রতি ম্যাচেই।

    যাদের ওপরে ছিল নজর  

    সাকিব আল হাসান
    ম্যাচ: ৬
    রান: ১৩৭
    উইকেট: ১০

    আসর শুরুর আগেই যদি আপনাকে একজন টুর্নামেন্ট সেরা অনুমান করতে বলা হত তাহলে সাকিবের নাম নিশ্চয়ই আপনার মাথায় আসত। টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে ব্যাট হাতে সাকিব ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ; বল হাতে রান কম দিলেও উইকেটের দেখা মিলছিল না। ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে পা রাখতেই সাকিব আল হাসান নিজেকে খুঁজে পেলেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে টানা দিন জয়ে বরিশালকে একবার নিয়ে গিয়েছিলেন পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে। বরিশালের ভঙ্গুর ব্যাটিং লাইন আপে আশার আলো রুপে আবর্তিত হয়ে তিনি খেলেছেন দারুণ দুটো ইনিংস, পেয়েছেন আসরে নিজের প্রথম ফিফটির দেখা। তবে সাকিব নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন বোলিং দিয়ে। মাত্র ৪.৭৬ ইকোনমি রেটে ১০ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টে যৌথভাবে ২য় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী তিনি। ১৪০+ দলীয় সংগ্রহ নিয়েও দারুণ অধিনায়কত্বের পাশাপাশি পাওয়ারপ্লেতে করেছেন কিপটে বোলিং; ৪ ইনিংসে পাওয়ারপ্লেতে বল করে তার ইকোনমি রেট মাত্র ৩! বরিশালকে সাকিব শিরোপা এনে দিতে পারবেন কিনা তা সময়ই বলবে। তবে টুর্নামেন্ট সেরাদের দৌড়ে তিনি যে এবারও শীর্ষ সারিতেই থাকবেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার খুব বেশি মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না।

    মোস্তাফিজুর রহমান
    ম্যাচ: ৫
    উইকেট: ১১

    বাংলাদেশের সেরা টি-টোয়েন্টি বোলার যথারীতি এই আসরেও মেলে ধরেছেন নিজেকে। “ফিজ” গত ম্যাচে চট্টগ্রামের বিপক্ষে পেয়েছেন আসরের প্রথম ৫-উইকেটের দেখা। ৬.৬২ ইকোনমি রেট বলছে এবারও তাকে পড়তে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের। মাত্র ১০.৫৪ গড়ে ১১ উইকেট নিয়ে তিনি যৌথভাবে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী।  টুর্নামেন্ট শেষেও তার নামের পাশে সবচেয়ে বেশি উইকেট থাকার পক্ষেই বোধহয় বেশিরভাগ বাজি ধরবেন।

    তামিম ইকবাল
    ম্যাচ: ৬
    রান: ২৬২
    স্ট্রাইক রেট: ১৩৫.৭৫

    আসর শুরুর আগে অনেকেই তাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন। যেদিন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে ছয় মাসের বিরতির ঘোষণা দিলেন তারপর ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনাও কম সইতে হয়নি। তবে তারপরের দিন তামিম সব জবাব দিয়েছেন ব্যাট হাতে, লেন্ডল সিমন্সের সেঞ্চুরি ম্লান করে ১১১* রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলে। টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন টানা দুই ম্যাচে ফিফটি দিয়ে। ৫২.৪০ গড়ে ২৬২ রান নিয়ে টুর্নামেন্টের ২য় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিমের ১৩৫+ স্ট্রাইক রেটও এখন পর্যন্ত দিয়েছে অনেক সমালোচনার জবাব। একটা ফিফটি নিয়ে হয়ত প্রশ্ন থাকতে পারে তবে বিপিএলের সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম যে দলের জয়ে অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর তার প্রমাণ মিলেছে বেশিরভাগ ম্যাচেই।

    মুজিব-উর-রহমান
    ম্যাচ: ৩
    উইকেট: ৫
    ইকোনমি রেট: ৩.৬৬

    আফগান এই রহস্যময় বোলার আসার পরপরই বরিশাল পেয়েছে টানা তিন ম্যাচে জয়, সাকিব পেয়েছেন বোলিংয়ে যোগ্য সঙ্গী। সাকিব শেষ ম্যাচের পর তো বলেই বসলেন, মুজিব থাকলে নাকি তার চিন্তা করতে হয় ১৬ ওভার বোলিং নিয়ে! আক্ষরিক অর্থেই অধিনায়কের বোলিং নিয়ে চিন্তার অবসান ঘটিয়েছেন; আর চিন্তায় জর্জরিত করে তুলেছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের। কমপক্ষে ১০ ওভার বল করা বোলারদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সেরা ইকোনমি রেট তার। চট্টগ্রাম অর্ধে দলের সাথে যোগ দেওয়ার পর থেকেই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে মুজিব ফেঁদে বসেছেন ঘূর্ণিজাল।

     

    মেহেদী হাসান মিরাজ
    ম্যাচ: ৮
    উইকেট: ৯
    রান: ১২৩

    মিরাজ কান্ড পুরো বিপিএলকেই নাড়া দিয়েছিল। দলীয় হর্তাকর্তাদের সাথে কোন্দলের আগে মিরাজ অবশ্য ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। অধিনায়ক হিসেবে তিনি ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েই দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন শীর্ষে। ব্যাট হাতে যেখানে নেমেছিলেন সেই তুলনায় স্ট্রাইক রেট হয়ত কিছুটা নিচের দিকেই; তবে তার দুটো ইনিংসের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। অধিনায়কত্ব হারানোর পর এখন পর্যন্ত নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। চট্টগ্রামের টানা তিন হারে তার নিষ্প্রভ পারফর্ম্যান্সেরও হাত রয়েছে। তবে শুরুর ফর্ম ফিরে পেলে ব্যাটে-বলে মিরাজ হয়ত হবেন টুর্নামেন্ট সেরাদেরই একজন।