• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    কোনো কামব্যাক নয়, লিভারপুলই যাচ্ছে প্যারিসে

    কোনো কামব্যাক নয়, লিভারপুলই যাচ্ছে প্যারিসে    

    ভিয়ারিয়াল (২) ২:৩ (৫) লিভারপুল 


    ‘টেল অব টু হাভস’ এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণটি দেখল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগের প্রথমার্ধে লিভারপুলকে কাঁপিয়ে দিলেও দ্বিতীয়ার্ধে অভিজ্ঞ অলরেডদের সামনে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে উনাই এমেরির ভিয়ারিয়াল। ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যাওয়া ইয়েলো সাবমেরিনরা দিনশেষে ম্যাচ হেরেছে ২-৩ ব্যবধানে। অ্যাগ্রিগেটে ৫-২ ব্যবধানের সহজ জয় নিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে লিভারপুল।

    সেমিফাইনালের প্রথম লেগে দুই বা ততোধিক গোলে পিছিয়ে পড়ার পরার দ্বিতীয় লেগে ফিরে আসার নজির আছে একটিই। সেটি লিভারপুলের। বার্সেলোনার বিপক্ষে অ্যানফিল্ডের সেই ‘কর্নার টেকেন কুইকলি’ ম্যাচকে কামব্যাকের সবচেয়ে নিখুঁত ব্লু-প্রিন্ট বলা চলে। অনুপ্রেরণার জন্য এই ম্যাচের দিকে তাকাতে হতো উনাই এমেরিকে। তিনি তাকিয়েছিলেনও।

    প্রথম লেগে হারার পরই ভিয়ারিয়াল ম্যানেজার এমেরি ঘোষণা দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় লেগে ভোগতে হবে লিভারপুলকে। অ্যানফিল্ডে হেসেখেলে প্রতিপক্ষকে হারানো ইয়ুর্গেন ক্লপ হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি কতটুকু ভোগতে হতে পারে তাদের। দ্বিতীয় লেগে তার কামব্যাকের নকশা থেকেই এক পাতা ছিঁড়ে মাঠে নামে ভিয়ারিয়াল।

    ৫০ হাজার বাসিন্দার ছোট শহর ভিয়ারিয়ালের প্রায় অর্ধেক এদিনে হাজির হয় স্তাদিও দে লা সিরামিকায়। ভক্তরা ম্যাচের আগেই তৈরি করে এক অ্যানফিল্ডীয় পরিবেশ। এরপর খেলোয়াড়দের পালা, একটি আগ্রাসী সূচনা দেওয়ার। যেই কথা (পড়ুন পরিকল্পনা), সেই কাজ।

    ম্যাচের তৃতীয় মিনিটেই গোলের দেখা পেয়ে যায় ভিয়ারিয়াল। লিভারপুল কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই বোলায়ে দিয়ার গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা।

    গোলের পর প্রেসের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় ভিয়ারিয়াল, অব্যাহত রাখে আক্রমণও। স্বাগতিকদের এই আকস্মিক ‘অ্যামবুশের’ জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না লিভারপুল। স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপে পড়ে যায় ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যরা। প্রেসিং, পাসিং, অ্যাটাকিং, ডিফেন্ডিং; সব বিভাগেই খারাপ খেলতে শুরু করে তারা।

    প্রথমার্ধে লিভারপুলকে থিতু হওয়ারই সুযোগ দেয়নি ভিয়ারিয়াল। আগের লেগে ৭৬ শতাংশ বলের দখল রাখা অলরেডরা প্রথমার্ধে বলের চেহারা দেখেছে মাত্র ৪৯ শতাংশ সময়। বিরতির আগে তাদের সঠিক পাসের পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৬ শতাংশ। পুরো মৌসুমে এরচেয়ে বাজে প্রথমার্ধ খেলেনি মোহামেদ সালাহরা।

    লিভারপুলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিরতির আগে আরেকটি গোল করে ভিয়ারিয়াল। ৪১ মিনিটে ইতিয়েন কাপুর ক্রস থেকে হেড করে অ্যাগ্রিগেটে সমতা ফেরান ফ্রান্সিস কোকোলাঁ।

    ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে যখন বিরতিতে যায় ভিয়ারিয়াল, তখন তাদের কামব্যাককে শুধু সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল। মৌসুমে কখনো দুই গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করেনি লিভারপুল। এই অর্ধে স্মরণকালের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় নাকানি-চুবানি খাওয়া অলরেডদের জন্যই তখন দ্বিতীয়ার্ধ হয়ে উঠে কামব্যাক বা ফিরে আসার মঞ্চ।

    মধ্যবিরতিতে একাদশে একটি বদল আনেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। ডিয়গো জোটার জায়গায় নামেন লুইস ডিয়াজ।

    এ মৌসুমে বেঞ্চের খেলোয়াড়রা এসে অনেকবার ম্যাচ ঘুরিয়েছে লিভারপুলের জন্য। এদিনেও তাই হয়। জানুয়ারি সাইনিং ডিয়াজের অন্তর্ভুক্তি সার্বিকভাবে লিভারপুলের মধ্যে নতুন এক প্রাণশক্তি এনে দিয়েছে। ভিয়ারিয়ালের মাঠে সেই প্রাণশক্তিরই যেন দরকার ছিল ক্লপের। প্রাণশক্তির পাশাপাশি দরকার ছিল শৃঙ্খলাও।

    দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই সুশৃঙ্খল ফুটবল খেলতে শুরু করে লিভারপুল। বলের দখল রেখে, ছোটখাটো সুযোগ তৈরি করে ধীর ধীরে ম্যাচে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে তারা। ম্যাচে প্রথমবারের মতো ‘রেগুলার লিভারপুল’-এর দেখা পায় সফরকারী ভক্তরা।

    পরিচিত ফর্মুলার ফুটবলেই আবার ম্যাচে ফিরে আসে লিভারপুল। ৫৫ মিনিটে ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ডের শট বারে লাগে। তার দুই মিনিটের মধ্যে আরেকটি দুর্দান্ত আক্রমণ করে সফরকারীরা। কিন্তু ফাঁকা পোস্টে বাইসাইকেল কিক নিতে গিয়ে সুযোগটি নষ্ট করেন ডিয়াজ।

    তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি অলরেডদের। ৬২ মিনিটে ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে ভিয়ারিয়ালের বক্সে ঢুকে পড়া ফ্যাবিনহোকে পাস দেন মোহামেদ সালাহ। বল নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে সিক্স ইয়ার্ড বক্সের ডানপাশ থেকে শট নেন ফ্যাবিনহো। গোলরক্ষকের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে সেই বল জায়গা করে নেয় জালে। অ্যাগ্রিগেটে আবারও এগিয়ে যায় লিভারপুল।

    এই গোলের পর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি ভিয়ারিয়াল। ৬৭ মিনিটে আলেকজান্ডার আর্নল্ডের বাঁ পায়ের ক্রসে হেড করে দ্বিতীয় গোল করেন ডিয়াজ। ৭৪ মিনিটে বক্স ছেড়ে এগিয়ে আসা গোলরক্ষকের সামনে থেকে বল কেড়ে নিয়ে গোল করেন সাদিও মানে।

    ৬২ থেকে ৭৪; ১২ মিনিটের ঝড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় স্বাগতিকরা। ম্যাচের বাকি সময়েও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখে লিভারপুলই, তৈরি করে বেশ কয়েকটি বড় সুযোগ। শেষ পর্যন্ত ২-৩ ব্যবধানেই শেষ হয় ম্যাচ।

    দ্বিতীয়ার্ধে পেশাদারি পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে ফাইনালের টিকিট কাটে লিভারপুল। গত পাঁচ মৌসুমে ক্লপের শিষ্যদের তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল এটি। কোয়াড্রপল স্বপ্ন টিকিয়ে রাখা লিভারপুলের মৌসুমের তৃতীয় ফাইনালও এটি।

    পুরো মৌসুমজুড়ে প্রায় নিখুঁত ফুটবল খেলে যাওয়া লিভারপুলের সামনে প্যারিসের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ ও ম্যান সিটির মধ্যে যেই দলই পড়ুক না কেন, তাদের কাজটা যে সহজ হবে না তা এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে।