• বঙ্গবন্ধু বিপিএল ২০২২
  • " />

     

    যেসব কারণে তারকা সংকটে পড়তে পারে বিপিএল

    যেসব কারণে তারকা সংকটে পড়তে পারে বিপিএল    

    ২য় কোয়ালিফায়ার, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০২২। 

    চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ছুঁড়ে দেয়া ১৫০ রানের লক্ষ্য ৪২ বল আর সাত উইকেট হাতে রেখে টপকে গিয়েছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। মৃত্যুঞ্জয়-নাসুম-শরীফুলদের কোনো টোটকাই কাজে আসেনি সেদিন কুমিল্লার তিন বিদেশি ক্রিকেটারের সামনে। সুনিল নারাইন, মঈন আলী আর প্রথমবার বিপিএল খেলতে আসা ফাফ ডু প্লেসির চওড়া ব্যাটের দাপটে দেশি তারকারা সেদিন মিইয়ে গিয়েছিলেন। এই তিন বিদেশি তারকার হাত ধরেই কুমিল্লা উঠেছিল ফাইনালে। 

    নিজেদের শিবিরে তারকাদের মেলা বসিয়ে কুমিল্লা ফাইনালে হারিয়েছিল আরেক তারকাসমৃদ্ধ দল ফরচুন বরিশালকে। সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে সেই দলে খেলেছেন ক্রিস গেইল-ডোয়াইন ব্রাভোরা। তবে বিপিএলের আগামী আসরে এমন দৃশ্য দেখতে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই সম্ভাবনার নেপথ্যে আছে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক অন্যান্য টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর ব্যস্ততায় ঠাঁসা সুচি। তবে এর বাইরেও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে, যার দৌড়ে বেশ পিছিয়ে বিপিএল। যার কারণে আগামী আসরে তারকা ক্রিকেটারদের সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। 

     

    পারিশ্রমিক কাঠামো 

    কদিন আগেই বিসিবি জানিয়েছে আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে বিপিএলের নবম আসরের পর্দা নামবে ১৬ ফেব্রুয়ারি। তবে আসন্ন বিপিএলের কাছাকাছি সময়ে মাঠে গড়াবে আরও তিনটি লিগ; আইএল টি-টোয়েন্টি, বিগ ব্যাশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। বিপত্তিও বেধেছে সেখানেই। ব্যস্ত ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ক্রিকেটাররা কোন পথে যাবেন? এর উত্তরে সর্বপ্রথম আসবে পারিশ্রমিকের কথা। স্বাভাবিকভাবেই পেশাদার ক্রিকেটাররা যে টুর্নামেন্টে পারিশ্রমিক বেশি পাবেন, সেদিকেই প্রাধান্য দেবেন। সেখানে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বিপিএল। 

    বিপিএলের গত আসরে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৭০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ছয় ক্রিকেটার। মার্কিন মুদ্রায় সেটা প্রায় এক লক্ষ ডলার। বিশ্বজুড়ে চলা টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর মধ্যে যা সর্বনিম্ন। অথচ মাত্র দুই আসর পুরনো একশো বলের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ‘দ্য হান্ড্রেড’ এর পারিশ্রমিকও প্রায় বিপিএলের চেয়ে প্রায় ৬৪ হাজার মার্কিন ডলার বেশি। এদিকে আট আসরেও তেমন উন্নতি নেই বিপিএলের বেতন কাঠামোতে। 

    পারিশ্রমিক কাঠামোতে শীর্ষে আছে আইপিএল। এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পারিশ্রমিক দেয়ার রেকর্ড আছে জনপ্রিয় এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের। মজার ব্যাপার হচ্ছে মাঠে গড়ানোর আগেই দ্বিতীয় আকর্ষনীয় টি-টোয়েন্টি লিগের তকমা পেয়েছে আরব আমিরাতের আইএল টি-টোয়েন্টি। আগামী ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া এই টুর্নামেন্টে তারকা ক্রিকেটাররা আয় করবেন সাড়ে চার লক্ষ মার্কিন ডলার। 

    জোর গুঞ্জন আছে ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় বিগ ব্যাশকে উপেক্ষা করে আইএল টি-টোয়েন্টিতে খেলবেন ডেভিড ওয়ার্নার। অনুমিতভাবেই আরব আমিরাতের এই টি-টোয়েন্টির প্লেয়ার্স ড্রাফটের শীর্ষ পর্যায়েই থাকবেন তিনি। পারিশ্রমিকও পাবেন নিজ দেশের বিগ ব্যাশের চেয়ে দ্বিগুনের বেশি। 

     

    সরাসরি চুক্তি

    পারিশ্রমিক কাঠামোতে পিছিয়ে থাকলেও বিপিএলের থাকছে সরাসরি চুক্তিতে বেশি অর্থের প্রস্তাব দিয়ে পছন্দের তারকা ক্রিকেটারদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ। তবে সেক্ষেত্রে বিপিএল খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। ইংল্যান্ড-পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির ক্রিকেটারদের হয়তো পাওয়া যাবে অনায়াসে। কিন্তু মঈন আলী-আন্দ্রে রাসেলদের মতো বিশ্বমানের তারকাদের পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে বিপিএলের জন্য।  

    আসন্ন জানুয়ারিতে মাঠে গড়ানোর কথা দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি লিগের। এই টুর্নামেন্টে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে ইতোমধ্যে চুক্তি সেরেছেন মঈন আলী; পারিশ্রমিক পাবেন তিন লক্ষ ডলার। সম পরিমাণ বা বেশি  অর্থ দিয়ে সরাসরি চুক্তিতে কুমিল্লা কিংবা অন্য কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি তাকে বিপিএলে খেলার জন্য রাজি করাতে পারলেও টুর্নামেন্টজুড়ে তাকে পাওয়া যাবে না নিশ্চিত।  

    টি-টোয়েন্টির অন্য তারকাদের দলে ভেড়াতেও হিমশিম খেতে পারে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। কারণ সবাই ই ব্যস্ত থাকবেন কোনো না কোনো লিগে। তবে ম্যাচের হিসেবে চুক্তি করে তাদের দলে ভেড়ানোর রাস্তা খোলা থাকছে। কিন্তু এতে করে পুরো দলের টুর্নামেন্টকেন্দ্রিক সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকিও থেকে যাবে।     


    সুসংগঠিত ফ্র্যাঞ্চাইজি

    টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টগুলোর সফল দলগুলোর পেছনের কারিগর তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি। অর্থাৎ মাঠের খেলায় দলের পারফর্ম্যান্স, মালিকপক্ষের পরিকল্পনা-পরিমিতিবোধের সমানুপাতিক। এক্ষেত্রেও খুব বেশি সুনাম নেই বিপিএলের। গত আসরে ঢাকার দলের জন্য বিড করেনি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি। প্লেয়ার্স ড্রাফটে ঢাকার দল গুছিয়েছিল স্বয়ং বিসিবি! পরবর্তীতে সেটা হাতবদল হয়ে গিয়েছিল মিনিস্টার গ্রুপের কাছে। 

    ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপের নজিরও বিপিএলে আছে। গত আসরে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কয়েক ম্যাচ যেতে না যেতেই মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তে মিরাজকে অব্যাহতি দেয়া হয় অধিনায়কত্ব থেকে। ক্ষোভে টিম হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চান মিরাজ। সেই ঘটনা নানান ডালপালা ছড়িয়েছিল চারপাশে। এরপর নাঈম ইসলামের হাত ঘুরে অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। এক টুর্নামেন্টেই তিনবার অধিনায়ক বদলের ঘটনা খুব বেশি নেই বিশ্ব ক্রিকেটে।  

    তবে আইপিএলের মতো টুর্নামেন্টের মাঝপথেও অধিনায়কত্ব বদল হওয়ার ঘটনা আছে। দীনেশ কার্তিকের জায়গায় কলকাতা নাইট রাইডার্সের অধিনায়ক হয়েছিলেন এউইন মরগান। তবে সেটা নিয়ে জল ঘোলা হয়নি। স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল কলকাতা। 

    আলোচনা করা যায় দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি লিগের কথা। আইপিএলের আদলে শুরু হতে যাওয়া এই লিগের ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনেছে আইপিএলের ছয়টি দলের মালিক। চেন্নাই সুপার কিংস, শাহরুখ খানের নাইট রাইডার্স গ্রুপ থেকে শুরু করে বিনিয়োগ আছে রাজস্থান রয়্যালসের মালিকপক্ষেরও। আইপিএলের বদৌলতে এই ফ্র্যাঞ্চাইজিদের অধীনে থাকা দলগুলোতে খেলেছেন অনেক তারকাই। তাদের জানাশোনার মধ্যেই আছে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের পরিকল্পনা, আচার-ব্যবহার ও ক্রিকেটারদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। সেই মানদন্ডে বিপিএল ঢের পিছিয়ে। 

    এফটিপি, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মান ও অন্যান্য

    এফটিপি অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারি অর্থাৎ বিপিএল শুরুর সময়টায় কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ নেই কেবল পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডের। পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটাররাও ফাঁকা ই থাকবেন সেই সময়ে। তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতে পারে বিপিএলের দলগুলো। কিন্তু এবার হয়তো সেই সুযোগটাও থাকছে না। কারণ তাদের বেশিরভাগেরই লক্ষ্য বিগ ব্যাশ আর দক্ষিণ আফ্রিকান টি-টোয়েন্টি লিগ। বিপিএল সেখানে তাদের কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে, সেটার উত্তর সময়ের হাতেই তোলা থাকুক। এর বাইরে বাকি দেশের ক্রিকেটাররাও হয়তো নিজ নিজ জাতীয় দলের দায়িত্ব শেষ করে ছুটবেন কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দিকে। 

    এছাড়া মন্থর উইকেটে লো স্কোরিং ম্যাচের জন্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মান নিয়ে বিপিএলের সমালোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এসব নিশ্চয়ই বিদেশি ক্রিকেটারদের জানা আছে। কাজেই বলা যায় তারকা ক্রিকেটার প্রাপ্তিতে বিপিএলের অন্যতম এক অন্তরায় ক্রিকেটের মানও।