• ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    এমসিজি ম্যাজিকঃ 'নায়ক' কোহলি, 'নায়কের বন্ধু' হার্দিক

    এমসিজি ম্যাজিকঃ 'নায়ক' কোহলি, 'নায়কের বন্ধু' হার্দিক    

    ৯০২৭৩, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এমসিজিতে হাজির হওয়া দর্শক সংখ্যা। নীল আর সবুজের সমুদ্রেই পরিণত হয়েছিল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। নব্বই হাজারের বেশি মানুষের গর্জন তো নিশ্চয়ই আপনার টিভি পর্দায়ও ভেসে আসছিলো! জাতীয় সংগীতে দুই দলের যারা হাজির হলেন মাঠে, এমন কিছুর অভিজ্ঞতা তাদের কারো নেই, সর্বশেষ এমসিজিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছিল সেই ১৯৮৫ সালে। 

    আর্শদীপ যখন তার বিশ্বকাপের প্রথম বলেই বাবরের পায়ে বল ফেলে আম্পায়ারের আঙুল তোলালেন, কিংবা আশ্বিন যখন মিড অফের উপর দিয়ে চার মেরে জয় নিশ্চিত করলেন, এমসিজি তখন যে গর্জন দিয়েছে, তা নাকি শেন ওয়ার্নের ৭০০ উইকেটের পরের গর্জনের চেয়েও বড়! ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে মিচেল স্টার্ক ম্যাককালামের স্টাম্প ভেঙ্গে দেওয়ার পরেও নাকি এমন গর্জন শোনা যায়নি। মাঠে থেকে স্বাক্ষী ইএসপিএনক্রিকইনফোর সাংবাদিক অ্যালেক্স ম্যালকম তো জানালেন এমনই। 

    অস্ট্রেলিয়ার মাঠে অস্ট্রেলিয়ারই কোন খেলা এত উত্তেজনা-উল্লাস সৃষ্টি করতে পারেনি! ক্রিকেট, এফএল ফাইনাল, কিছুই না! এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহের পারদ এতটাই উঁচুতে, টিকেট ছাড়ার পাঁচ মিনিটও শেষ হয় না, টিকিট ফুরিয়ে যায়! ভারত বনাম পাকিস্তান, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, এমসিজিরও সবচেয়ে বড় ‘স্পোর্টিং ইভেন্ট’- এমন মঞ্চই তো চাই বিরাটের। বিরাটের জন্য উপযুক্ত মঞ্চ। 

    ***

    ভারত সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রাসী ব্র‍্যান্ডের ক্রিকেটে মনযোগ দিয়েছে। সুইং, সিম মুভমেন্টের সাথে পেস আর বাউন্স, এদিনের এমসিজিতে পাকিস্তানী পেস আক্রমণের সামনে যদিও ভারতের সাবধানী না হয়ে উপায় ছিল না। কিন্ত সতর্কতার সাথে খেলতেও চেয়েও রাহুল ও রোহিত ফিরলেন এক অঙ্কের ঘরেই। সুরিয়া এসে তার মতো শুরু করলেন, প্রথম বলেই বাউন্ডারি। ১৫ রানে তাকেও ফেরালেন পিন্ডির হারিস রউফ। ৩১ রানে আক্সারও রান আউট হয়ে গেলে ভারতের আশা…

    আশায় বুক বাঁধা যায়। কিন্ত বাস্তবতা বলে ভিন্ন কিছু। ইতিহাস বলে, এত কম রানে চার উইকেট হারিয়ে ভারতের কোন জয়ের হদিস নেই। সামনে পাকিস্তানের জ্বালাময়ী পেস আক্রমণ। হার্দিক তবু বিশ্বাস রাখেন। বিরাটকে বিশ্বাস করান, 'বিশ্বাস রাখো, আমরা পারবো, শেষ পর্যন্ত থাকি'। টানা ২৯ বল পার করে দিল ভারত, বাউন্ডারির দেখা নেই! 

    ঝুঁকিহীন স্ট্রাইক রোটেটে খেলতে চাইছিলেন, কিন্ত সিঙ্গেলও আসছিল না সহজে। ৭ম ওভারে হার্দিক ক্রিজে কোহলির সঙ্গে যোগ দেওয়ার পরের ২৪ বলে ভারত ডট দেয় ১৩টি বল, ১১ সিঙ্গেলের সাথে আনে একটি ডাবল। বিরাটের মাথায় তখন বড় শটের চিন্তাও আসতে শুরু করেছিল। চার উইকেট হারিয়ে ফেলায় সেটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণই হতো, হার্দিক বিরাটকে সতর্ক করে তার মনযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করলেন। আশ্বস্ত করলেন, ‘খেলা গভীরে নিয়ে যাই, যেকোন কিছু হতে পারে।’ 

    ‘কোহলির মতো চাপ সামলাতে কেউ পারবে না’, হার্দিকের বলা কথা। এমন বিশালতার ম্যাচ কোহলির কাছে নতুন নয়। মাঠে যাকে দেখলে মনে হয়, যেন আত্মবিশ্বাসের খনি। সেই কোহলিও ৩১ রানে চার উইকেট হারানোর পর পড়েছিলেন সীমাহীন চাপে, সেটা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেননি একটুও। 

    হার্দিক জানিয়েছেন পরে, যখন মাঠে ঢুকছেন, তখন তার একটাই নাকি চিন্তা ছিল। সেটি হার্দিকের ভাষায়, তিনি বুলেট বুকে নিতেও রাজি, কিন্ত কোহলিকে আউট হতে দিবেন না। সেজন্য তিনি যেমন করেই হোক, কোহলির জীবন সহজ করে দিবেন। ভারত ইনিংসের অর্ধেক পথ শেষে তুলল ৬০ বলে ৪৫ রান। যার ২১টি খেলে ১২ রান করেছিলেন কোহলি, তখনও তিনি তার প্রথম বাউন্ডারির খুঁজে। 

    ড্রিংকস ব্রেকের পরের ওভারেই শাদাবকে চার মেরে বাউন্ডারি খরা কাটালেন হার্দিক। পরের ওভারে নাওয়াজের বল পাঠালেন লম্বা মিড উইকেট বাউন্ডারি দিয়ে। পরে আরেকটি, মাঝখানে নিজের ২৫তম বলে এসে কোহলিও প্রথম বাউন্ডারির মার মারেন নাওয়াজকেই। পরে ভুগলেও ওই তিন বাউন্ডারি দিয়ে অন্তত কোহলির জীবন কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়েছিলেন হার্দিক। ভারতীয় দর্শকদের মনেও হয়তো তখন বিশ্বাস জেগে উঠেছে, সম্ভব। বাবরের চাই একটা উইকেট। শাহিন, নাসিমকে আনলেন। কোহলি তাদের চার মারছিলেন, কিন্ত সেই ছয়ের পর ওদিকে হার্দিকের ভোগান্তির শুরু। 

    রউফ এসে আরও ঝামেলা বাধালেন। মেলবোর্নে স্টার্সের এই তারকার এমসিজিতে যত অভিজ্ঞতা, দুই দলের কারোরই আর তা নেই। তার বলে কিছুতেই কিছু করতে পারছিলেন হার্দিকের মতো হিটার। ১৫তম ওভারে এসে দেন মাত্র ৫ রান(ওয়াইড-বাই তিন)। ১২ ওভার শেষে ১৮ বলে ২৬ রানে থাকা হার্দিক আউট হওয়ার আগে আরও ১৮ বল খেলে আনতে পারেন মাত্র ১৪ রান! ১২ ওভার থেকে ১৭তম ওভার- এই পাঁচ ওভারে আসে মাত্র তিনটি বাউন্ডারি। ১৭ ওভার শেষে তাই ভারতের সমীকরণ হয়ে দাঁড়ায় ১৮ বলে ৪৮ রান। 

    ***

    শেষ তিন ওভারে এত রান করে ভারত জেতেনি কোনদিন। শেষ ১৮ বলে এর চেয়ে বেশি রান করে টি-টোয়েন্টি ইতিহাসেই জয়ের ঘটনা আছে মাত্র একটি (২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৫৯ রান এনেছিল শ্রীলঙ্কা)। বিশ্বকাপে তো নেই-ই! পাকিস্তানের এমন অবস্থান থেকেও হারার দুঃখ আছে যদিও, শেষ তিন ওভারে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান দিয়ে হেরেছিল তারাই। ২০১০ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সেদিন মাইক হাসিরা সমান ৪৮ রানই এনেছিলেন। 

    কোহলি বললেন, এবার জানের মায়া ছেড়ে আক্রমণে যাওয়া চাই। হার্দিক মনে করিয়ে দিলেন, নাওয়াজের এক ওভার বাকি, তিনি তিন-চারটি ছক্কা মারতেও আত্মবিশ্বাসী! নওয়াজকে বোলিংয়ে আনতে দেরি করছিলেন বাবর, কোহলিরা বুঝে গেলেন, মূল বোলারদের দিয়ে কোহলিদের ম্যাচ থেকে ছিটকেই দিতে চান বাবর। কোহলি সিদ্ধান্ত নিলেন, রউফের ওভারেই চড়াও হবেন। এর আগে শাহিনের ওভারে তিনটি চার মেরে দেন। ১৯তম ওভারে রউফ যখন আসেন, হিসেব এলো ১২ বলে ৩১ রানে। আবার রউফ, আবার একই হাল। প্রথম চার বলে এলো কেবল ৩ রান। 

    ১৬ বলে ২৮। কোহলি ভাবছেন, দুই ছক্কা চাই-ই চাই। রউফ ব্যাক অব লেংথে স্লোয়ার করলেন, কোমরের উপরে বল, একটু সরে গিয়ে সোজা মাথার উপর দিয়ে কোহলির ছয়। হার্দিক তার জীবনে অনেক অনেক ছয় মেরেছেন, কিন্ত ওই শটটাই তার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে, শটটা তার কাছে ‘স্পেশাল, রিয়েলি স্পেশাল’! এমন শট আর কেউ-ই মারতে পারতো না, হার্দিকের সহজ স্বীকারোক্তি। 

    ১৬ রান নিয়ে এসে শেষ ওভারে নাওয়াজ করলেন নো বল, ওয়াইড, বাইয়ে এলো তিন রান। নো বলটা আবার ফুলটস। এত কিছু হচ্ছিলো, সবই যেন কোহলি জিতবেন বলে! না জিতলে কি এই ইনিংসকে এত 'মহান' হিসেবে দেখা হতো?

    কোহলি ম্যাচ জিতে এসে সেই শটের বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ইনিংস নিয়ে কথা বলতে গিয়েও ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে জিম্বাবুয়ের সাবেক ক্রিকেটার চার্লস কভেন্ট্রি খুব সুন্দরভাবেই বলেছিলেন, 'বিরাট কোহলি, তুমি কী? সুপার হিউম্যান না সুপারম্যান? এমন ইনিংস দেখতে আমার পকেটে থাকা শেষ পয়সাও খরচ করে দিতে পারি'!

    দশ ওভারের সময়ে ২১ বলে ১২ রানে থাকা কোহলি পরের ১৮ বলে আনেন ৩১ রান, শেষ চার ওভারে ১৪ বল খেলে আনেন ৩৯ রান! এক মাস বিরতি নিয়ে গেল এশিয়া কাপে ফেরার পর আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ারের একমাত্র শতক হাঁকিয়েছিলেন। কিন্ত রানের সংখ্যাটাই তো শুধু ইনিংসের মাহাত্ম্য বুঝাতে সক্ষম নয়! 'ম্যাচের বিশালত্ব, আর দলের পরিস্থিতি' বিবেচনায় তাই এমসিজির ইনিংসটাই বিরাটের চোখে তার সেরা। রোহিতের কাছে ভারতেরই সেরা। 

    হার্দিকের কাছে এই ইনিংসটা এত স্পেশাল, তাদের জুটিটা এত স্পেশাল, শুরুতে বেশ ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণেই! আর এই ম্যাচটাও নাটকে ভরপুর বলে এত স্পেশাল, কোহলির ওই ইনিংসের জন্য তো অবশ্যই, সাথে হার্দিকের সাথে তার ওই জুটির জন্যেও! শতক পেরুনো ওই জুটিতে শুধু ৩৭ বলে ৪০ রানের অবদান রেখেছেন বলে নয়, ক্রিজে থেকে যেভাবে সাহস জুগিয়েছেন, ‘এমসিজি ম্যাজিকে’ যেভাবে নায়ক কোহলির ‘নায়কের বন্ধু’ চরিত্র ধারণ করেছিলেন।