• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    কেমন হবে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকস?

    কেমন হবে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকস?    

    বিশ্বকাপে কেমন হবে আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকস? লিখেছেন ফুয়াদ বিন নাসের...


     

    ২০১৮ বিশ্বকাপের পর লিওনেল স্কালোনি যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার, সেটা হওয়ার কথা ছিল সাময়িক। স্কালোনি নিজেও হয়তো চিন্তা করেননি তিনিই হতে যাচ্ছেন আলবিসেলেস্তেদের কান্ডারি। চিন্তা করবেনই বা কীভাবে? স্কালোনি যখন আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নেন তখন তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে ৫টি ম্যাচ দায়িত্বে থাকা ছাড়া আর কোন অর্জন নেই। আর যেখানে বিয়েলসা, সাম্পাওলি, পেকারম্যান বা ম্যারাডোনার মত রথী মহারথীরা ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রতিভাবান ফুটবলারদের এই ঝাঁকটাকে একটা ‘সত্যিকার’ টিম হিসেবে তৈরী করতে, সেখানে স্কালোনিকে নিয়ে কারোই খুব একটা উচ্চাশা ছিল না। অথচ এই স্কালোনিই হয়ে গিয়েছেন সবার আশা ভরসার দীপশিখা। ২০১৯ এ কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হারের পর থেকে আর কোন ম্যাচ হারেনি আকাশী নীলরা। ঐ ফাইনালের পর থেকে ৩৩ ম্যাচের মাঝে ২৩টি জিতেছে স্কালোনির শিষ্যেরা, ১০টি ম্যাচ ড্র। জিতেছে কোপা আমেরিকা আর ফিনিলাসিমার শিরোপাও। তাহলে একসময় তারকায় ভরপুর ছিল আর্জেন্টিনার স্কোয়াড আর এখন মেসি আর ডি মারিয়া ছাড়া বড় নাম নেই বললেই চলে। তাহলে কীভাবে স্কালোনি এ কীর্তি দেখাচ্ছেন? সবচেয়ে বড় কথা, মেসিকেই বা কীভাবে ব্যবহার করছেন তিনি? 

     

    ফর্মেশন

    গত ৫ বছরে বেশ কয়েকধরনের ফর্মেশন ব্যবহার করেছেন স্কালোনি। কখনো মিডফিল্ডে ডায়মন্ড খেলিয়েছেন, কখনো ডাবল পিভট কখনোবা সিঙ্গেল পিভট। ফরোয়ার্ড লাইনেও কখনো টারগেট ম্যান কখনো বা দুইজন ওয়াইড ফরোয়ার্ড খেলিয়েছেন। ৪-৩-৩, ৪-৪-২, ৪-১-৪-১, ৪-২-৩-১ এবং ৪-১-৩-২ ফর্মেশনে স্কালোনি খেলিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে। কোপা আমেরিকা ফাইনালে তারা খেলেছে ৪-৩-৩ এ আবার ফিনালিসিমার ফাইনালে খেলেছে ৪-১-২-৩ এ। আক্রমণে যা-ই হোক, রক্ষণে ফোর ম্যান ব্যাকলাইনটা স্কালোনির মোটামুটি বাঁধাই। ডি মারিয়া আর লুকাস ওকাম্পোস ছাড়া আর্জেন্টিনায় কোন জাত উইঙ্গার না থাকায় স্কালোনির আর্জেন্টিনা খেলে ন্যারো ফর্মেশনে। হাফ স্পেসে মিডফিল্ডাররা সংখ্যাগত প্রাধান্য তৈরী করেন আর ফুল ব্যাকরা ওয়াইড স্পেসে ওভারল্যাপ করেন। 

     

    আক্রমণ

    স্কালোনির আর্জেন্টিনা বলের দখল রাখতে ভালোবাসে। কিছু পরিসংখ্যানেই তাদের পজেশনভিত্তিক ফুটবলের ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। কাতার বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং এর ম্যাচ গুলোতে আর্জেন্টিনার গড় বল পজেশান ৫৯% এবং তারা প্রতি ম্যাচে গড়ে ৪৮০টার মত সফল পাস দেয়। স্কালোনি বলের দখল ধরে রাখার জন্য ছোট ছোট পাসে আক্রমণ সাজান। গত বছর আর্জেন্টিনার মোট পাসের মাত্র ৬% ছিল লং পাস। 

    বলের দখল নেওয়ার সাথে সাথে আর্জেন্টিনা তাদের ফর্মেশনের ন্যারো স্ট্রাকচার বজায় রেখে এমনভাবে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে যেন যার কাছে বল আছে তার জন্য একাধিক পাসিং অপশন খোলা থাকে। বিশেষ করে বল যখন আর্জেন্টিনার নিজেদের হাফে থাকে সেক্ষেত্রে বল ক্যারিয়ার অন্তত ৩ বা ৪টি পাসিং অপশন যেন পান সেভাবেই বাকি প্লেয়াররা নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেন। একজন সেন্টার ব্যাকের পায়ে বল থাকলে অপর সেন্টার ব্যাক এবং ফুল ব্যাক তার কাছে অবস্থান নেন বং মাঝমাঠ থেকে অন্তত দুইজন নিচে নেমে আসেন পাসিং অপশন তৈরী করার জন্য। 

    বল ধরে রাখার পাশাপাশি অবস্থানের পরিবর্তনটাও স্কালোনির আর্জেন্টিনার জন্য জরুরী। প্রেসের সম্মুখীন হলে বল ক্যারিয়ার নিকটবর্তী কাউকে পাস দেওয়ার পর দাঁড়িয়ে থাকেন না, অবস্থান পরিবর্তন করে এগিয়ে যান এবং নতুন পাসিং অপশন তৈরী করেন। এতে করে বলের দখল ধরে রাখার পাশাপাশি খেলাও আক্রমণের দিকে এগুতে থাকে। 

    পাসিং ট্রায়াঙ্গল ও শিফটিং পজিশন 

     

    নিজের অর্ধে কেন স্কালোনি ৪-৫টা পাসিং অপশন রাখেন? কারণ, বলের চারদিকে সংখ্যাগত প্রাধান্য তৈরী করলে দুইটি ব্যাপারের যেকোন একটি হবে। এক, প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রাও চাইবে বলের কাছাকাছি সংখ্যাগত প্রাধান্য তৈরী করে প্রেস করতে। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের কিছু খেলোয়াড়কে নিজেদের অবস্থান ছেড়ে এগিয়ে আসতে হবে, এবং আর্জেন্টিনার ব্যাকলাইন থেকে তখন বল পৌছে দেওয়া হবে আক্রমণভাগের কাউকে যারা ক্ষীপ্র গতিতে প্রতিপক্ষের প্রেসের কারণে অগোছালো রক্ষণের সুবিধা নিয়ে দ্রুত কাউন্টার করতে পারবেন। দুই, যদি প্রতিপক্ষ নিজেদের রক্ষণের শেইপ নষ্ট করে প্রেস করতে না চায় সেক্ষেত্রে ছোট ছোট পাসে আরামেই বল প্রতিপক্ষের থার্ডে নিয়ে যাওয়া যাবে। 

    আর্জেন্টিনার বিল্ড আপ


     

    রক্ষণ

    রক্ষণের ক্ষেত্রে স্কালোনির পছন্দ হাই প্রেস। আর্জেন্টিনা প্রতিপক্ষের হাফেই প্রেস করে যত দ্রুত সম্ভব বলের দখল ফিরে পাবার চেষ্টা করে। আক্রমণের মত আর্জেন্টিনার রক্ষণও মূলত ন্যারো শেইপে হয়। অর্থাৎ তারা মাঝমাঠে প্রেস করে প্রতিপক্ষকে বাধ্য করে ওয়াইড স্পেসে ফুলব্যাক বা উইঙ্গারদের দ্বারা আক্রমন পরিচালনা করতে। প্রতিপক্ষ ওয়াইড স্পেসে বল নিয়ে গেলে তারা সাইড ওভারলোড করে, অর্থাৎ এক উইঙ এ সংখ্যাগত প্রাধান্য তৈরী করে যেন প্রতিপক্ষ লম্বা পাসে উইং সুইচ করতে বাধ্য হয় এবং সেখানেই ভুলের সুযোগ তৈরী হয়। 

    আক্রমণের মত রক্ষণেও সংখ্যাগত প্রাধান্য তৈরী করার কারনে বলের দখল হারালেও বলের আশে পাশে সবসময় একাধিক আর্জেন্টিনার প্লেয়ার অবস্থান করেন। এই কাউন্টার প্রেসের সুযোগে তারা দ্রুত রক্ষণ থেকে আক্রমণে ট্রাঞ্জিশান করতে পারে। 

    সাইড ওভারলোড ও প্রেসিং



     

    মেসির ভূমিকা

    লিওনেল মেসি এর আগে যত জন কোচের নির্দেশনায় আর্জেন্টিনায় খেলেছেন, সবার কৌশলের মূলমন্ত্র ছিল মেসিকে কোনভাবে বল পৌছে দেওয়া। এই কৌশলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের রক্ষণের কাজটা খুব সহজ, মেসির কাছে বল পৌছাতে না দিলেই কেল্লা ফতে। স্কালোনির সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা করেছেন সম্ভবত মেসির ভূমিকায়। আর্জেন্টিনা এখন আর মেসি কেন্দ্রিক খেলা খেলে না। মাঠের প্রতিটা খেলোয়াড়ের আলাদা আলাদা দায়িত্ব আছে এবং তারা নিজেদের প্রতিভা আর দক্ষতা অনুযায়ী সেটা পালন করে যান। মেসি এখনো বেশ একটু নিচে থেকেই খেলা শুরু করেন, তবে এখন আর অন্যান্যরা মেসিকে পাস দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে না। এই নির্ভরশীলতার ব্যাপারটা উঠে যাওয়া মেসির নিজের খেলাও উন্নতি করেছে আর্জেন্টিনার হয়ে। ২০১৮ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের সময়ে যেখানে মেসি ম্যাচ প্রতি ৩৮টার মত সফল পাস দিতে পারতেন, ২০২২ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে এসে প্রতি ম্যাচে তাঁর গড় পাসের সংখ্যা উন্নীত হতেছে ৫৮তে। 

    খেলা আর মেসি কেন্দ্রিক নয়

     

    মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে ৪টি বিশ্বকাপ দল পেয়েছেন। মোটামুটিভাবে বলা যায় আগের দলগুলোর থেকে ২০২২ এর আর্জেন্টিনা দলটা প্রতিভার স্কেলে বেশ পিছিয়ে। কিন্তু এবারের আর্জেন্টিনা তবুও কাতার বিশ্বকাপ ঘরে তোলার অন্যতম দাবীদার, এর মূল কারণ তাদের শৃঙ্খলা এবং টিমওয়ার্ক। একসময় মেসিই ছিলেন আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকাল সিস্টেম, এখন মেসি আর্জেন্টিনার ট্যাকটিকাল সিস্টেমের একটি অংশমাত্র। মেসির উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে নতুন চেহারা দিয়েছেন যেটা বিশ্বকাপের আগের পার্ফর্ম্যান্সে স্পষ্ট। এই ধারা বিশ্বকাপেও বজায় থাকবে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। 

    ২০১৮ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ও ২০২২ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে টিমমেটদের প্রতি মেসির পাসিং এর পরিসংখ্যান