গেরো কাটাতে পারবেন জিজু?
মৌসুমঃ ১১-১২। স্থানঃ ক্যাম্প ন্যু। তারিখঃ ২১ এপ্রিল, ২০১২। মৌসুমের শেষভাগের লিগনির্ধারণী হয়ে যাওয়া ক্লাসিকোতে মাত্রই গোল করে বার্সাকে সমতায় আনলেন অ্যালেক্সিস সানচেজ। ডানপ্রান্তে বল পেলেন মেসুত ওজিল। অসাধারণ ভিশনে বাড়ালেন রোনালদোর দিকে। আগুয়ান ভালদেসের সামনে হালকা টাচে বলটা সামান্য ডানে নিয়ে শটে বল জালে জড়ালেন রোনালদো। সামনেই থাকা ক্যামেরায় গিয়ে করলেন প্রথমবারের মত করলেন বিখ্যাত ‘কালমা কালমা’ সেলিব্রেশনটি। এরপর কেটে গেছে বছর চারেক। কিন্তু রিয়ালের আর লিগ জেতা হয়ে ওঠে নি। তবে ১৬-১৭ মৌসুম শুরুর আগে মাদ্রিদ সমর্থকদের আশা, মাত্র ছয় মাসেই দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো ক্লাব আইকন জিদানেই হবে আক্ষেপমোচন।
নাভাসেই আস্থা জিজুরঃ
ডি গেয়া-নাভাসের সেই ‘ফ্যাক্স মেশিন’ কাহিনীর পর নিজেকে প্রমাণ করা যেন অপরিহার্যই হয়ে পড়ে কোস্টারিকার এই গোলরক্ষকের জন্য। ডি গেয়ার অভাব তো বুঝতে দেনইনি, সাথে সাথে জয় করে নিয়েছেন পেরেজ ও জিদানের আস্থা। তাই তো এই মৌসুমেও ডি গেয়ার জন্য বিড করার গুঞ্জন শোনা গেলেও পেরেজ, জিদান উভয়েই সাফ বলে দিয়েছেন, নাভাসেই শতভাগ আস্থা তাদের।
অবশ্য ইঞ্জুরির জন্য মৌসুমের শুরু থেকে নাভাসকে নাও পেতে পারে রিয়াল। সেক্ষেত্রে রিয়ালের গোলবার পাহারা দিতে দেখা যাবে কিকো ক্যাসিয়াকে। ১৪ বছর পর শৈশবের ক্লাবটিতে ফিরে আসা ক্যাসিয়া গত মৌসুমে পাওয়া স্বল্প সুযোগেই তাকে ফিরিয়ে আনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া এবারের প্রাক-মৌসুম থেকে আছেন ভাল ফর্মেই। তাই গোলকিপার নিয়ে খুব একটা ভাবতে হবে না জিজুকে।
অভিজ্ঞতা, তারুণ্যের মিশেলঃ
‘আক্রমণভাগ জেতায় ম্যাচ, ডিফেন্স জেতায় শিরোপা’- স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের এই বিখ্যাত উক্তিটি মাদ্রিদের সমর্থকদের মত আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে বলে মনে হয় না। মাদ্রিদে কখনোই গোলদাতাদের অভাব হয় নি। অভাব হয়েছে ইস্পাতদৃঢ় ডিফেন্সের। বিশ্বমানের ডিফেন্ডার থাকা সত্বেও বরাবরই ডিফেন্স শক্ত করাই ছিল মাদ্রিদের কোচদের মূল মাথাব্যাথা।
দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কারভাহাল, পেপে, রামোস, মার্সেলো এবং বিকল্প হিসেবে দানিলো, নাচো, ভারান, কোয়েন্ত্রাওদের নিয়ে রিয়ালের ডিফেন্স বেশ শক্তপোক্তই করে তুলেছেন জিদান। দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিক ক্লিনশিট নিয়ে ম্যাচ শেষ প্রচুর বাহবাও কামিয়েছেন ফরাসি এই কিংবদন্তী। ডিফেন্স নিয়ে জিদানের একমাত্র মাথাব্যথা হবে রামোসের সাথে পেপে বা ভারানের যেকোনো একজনকে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে। অসাধারণ এক ইউরো কাটানোর পর পেপেকেই রামোসের পাশে দেখছেন অধিকাংশই। কিন্তু ভারানও পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন বলেই জানিয়ে রেখেছেন জিজু। ডানপ্রান্তে কারভাহাল-দানিলোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন তিনি।
মধুর সমস্যার নাম মিডফিল্ডঃ
জাবি আলোনসো যাবার পর থেকে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের খোঁজে ব্যাকুল ছিল রিয়াল। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের অনুপস্থিতিই দলকে দূর্বল করে দিচ্ছে- এমনটাই ছিল অনেকের ধারণা। তবে নিজের স্বল্পসময়ে রিয়ালকে তাদের এই সমস্যার উপযুক্ত এক সমাধানই এনে দিয়েছেন বেনিতেজ।
‘বাইব্যাক’ ক্লজসহ পোর্তোতে বিক্রি করা ক্যাসেমিরোকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এই স্প্যানিশ কোচই। ধারাবাহিকতার অসাধারণ এক নিদর্শন রেখে ক্রুস, মদ্রিচের সাথে মিডফিল্ড নিজের করে নিয়েছেন এই পাওয়ারহাউজ। ডিফেন্সে রামোস, পেপেদের সাহায্য করার পাশাপাশি ক্রুস, মদ্রিচকেও দিয়েছেন নিশ্চিন্তে ওপরে উঠে বল যোগানোর লাইসেন্স। মাঝে মধ্যে দূরপাল্লার আগুনে শট নিতেও পিছপা হননা ক্যাসেমিরো। আসন্ন মৌসুমে তাই এই ত্রয়ীর কেউ ইঞ্জুরি, ফর্মহীনতায় ভুগলে বা জিদান তাদের বিশ্রাম দিলেই কেবল মাঠে দেখা যাবে ইস্কো, কোভাচিচ, হামেস, অ্যাসেনন্সিওদের।
রোনালদো, বেলের পাশে কেঃ
জিদানের প্রথম পছন্দের ৪-৩-৩ ফরমেশনে আক্রমণভাগে থাকবেন রিয়ালের বিখ্যাত ত্রয়ী বেল-বেনজেমা-ক্রিস্টিয়ানো তথা ‘বিবিসি’-এমনটাই ছিল এতদিন। বেনজেমার বিকল্প হিসেবে কোনো বিশ্বমানের স্ট্রাইকার না থাকায় এবারের দলবদলে শুরু থেকেই একজন স্ট্রাইকারের খোঁজে ছিল রিয়াল। অবামাইয়াং, লেওয়ান্ডস্কি, আগুয়েরোদের নাম শোনা গেলেও ঘরের ছেলে মোরাতাকেই জুভেন্টাস থেকে ফিরিয়ে এনেছেন জিদান। তুরিনের বুড়িদের হয়ে গত দুই বছরে মোরাতার পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াল। এজন্যই রিয়ালে আর ‘নিরাপদ’ নয় বেনজেমার অবিসংবাদিত ‘নাম্বার ওয়ান স্ট্রাইকার’এর স্থান। বেনজেমা এখনো ইঞ্জুরি থেকে সেরে না ওঠায় অন্তত মৌসুমের শুরু থেকে মোরাতাকেই দেখা যাবে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে।
দুই উইঙ্গে বেল-রোনালদোই থাকবেন বরাবরের মতই। ইউরো ফাইনালে দিমিত্রি পায়েটের ভয়ঙ্কর ট্যাকেলের পর আশঙ্কা করা হচ্ছিল, দীর্ঘদিনই মাঠের বাইরে থাকতে হবে রোনালদোকে। কিন্তু রিয়াল সমর্থকদের সুসংবাদই দিয়েছেন জিদান। জানিয়ে রেখেছেন, মৌসুমের প্রথম ম্যাচটি শিরোপার জন্য হলে সোসিয়াদাদের বিপক্ষে এই সপ্তাহেই মাঠে দেখা যেত পর্তুগীজ যুবরাজকে। তা না হলেও নিশ্চিতভাবেই সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে মৌসুমের প্রথম হোম ম্যাচেই এই কিংবদন্তীকে পাচ্ছেন জিদান। আর অসাধারণ এক ইউরো কাটিয়ে ‘ইউয়েফা বেস্ট প্লেয়ার ইন ইউরোপ’-এ জায়গা করে নেয়া বেলকে দেখা যাবে ডানপ্রান্তে। অবশ্য ম্যাচে জিদানের ট্যাকটিক্ষ অনুযায়ী একাধিকবার জায়গা পরিবর্তন করতে দেখা যেতে পারে এই তিনজনকে।
বিকল্প হিসেবে থাকছেন আরেক ‘ঘরফেরত’ লুকাস ভাজকেজ এবং কাস্তিয়া গ্র্যাজুয়েট মারিয়ানো দিয়াজকে। অ্যাসেন্সিওকেও মাঝে মধ্যে মধ্যমাঠ ছেড়ে দেখা যেতে পারে উইঙ্গে।
রিয়াল সমর্থকদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ছিল দলবদলে পেরেজের অহেতুক নাক গলানো। কিন্তু জিদানের আগমনের পর থেকেই ট্রান্সফার সম্পর্কিত বিষয় আশয় সম্পূর্ণ এই ফরাসির হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন রিয়াল প্রেসিডেন্ট। ফলস্বরূপ অপ্রয়োজনীয় সাইনিং না করে দলের প্রয়োজন অনুযায়ী খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়েছেন জিদান। বিগত দশকে বার্সার প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য দমিয়ে রিয়ালের সাম্রাজ্য শুরু করার স্বপ্নটা দীর্ঘদিনের। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে শুভসূচনা করায় জিদানের এই দলটি থেকে আসন্ন মৌসুমে বড় কিছুই প্রত্যাশা কছেন ‘লস বালঙ্কোস’ সমর্থকেরা।