• ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ সিরিজ
  • " />

     

    "হোয়াই অলওয়েস স্টোকস?"

    "হোয়াই অলওয়েস স্টোকস?"    

    ম্যাচ শেষ। জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। খেলোয়াড়রা হাত মেলাচ্ছেন একে অন্যের সঙ্গে। এমন সময় ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তামিম ইকবালের সঙ্গে খিটিমিটি বেঁধে গেল বেন স্টোকসের। সাকিব আল হাসান দ্রুত এসে ছাড়িয়ে নিলেন দুজনকে। সে সময় স্বাভাবিক থাকলেও মনের রাগটা চেপে রাখেননি ইংল্যান্ড অলরাউন্ডার। টুইটারে লিখেছেন, “বাংলাদেশকে দারুণ জয়ের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার কোনো সতীর্থকে কঠিন কিছু বলা আমি একদমই বরদাশত করব না।”

    পরের ঘটনা গতকালের। দ্বিতীয় প্রস্তুতি ম্যাচে দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন ওপেনার আব্দুল মজিদ। প্রায় প্রতি ওভারেই চার মেরে চড়াও হচ্ছিলেন ইংলিশ বোলারদের ওপর। মজিদের আত্মবিশ্বাস দেখে তাঁকে উত্যক্ত করা শুরু করেন বেন স্টোকস। ৯২ রানে অপরাজিত থেকে যখন লাঞ্চে যাচ্ছিলেন মজিদ, হাত মিলিয়ে সৌহার্দ্য বিনিময় করতে যান প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে। অন্যরা স্বাভাবিকভাবে হাত মেলালেও স্টোকস ছিলেন ব্যতিক্রম। যেন কিছু দেখেননি এমন ভাব করে মজিদের বাড়িয়ে দেয়া হাত পাশ কাটিয়ে চলে যান। দেখেশুনে মনে হতে পারে স্টোকস কেন বারবার এমন করেন?

     



    ক্রিকেটটা যে বেন স্টোকস খুব ভালোবাসেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রাগবি কোচ বাবার সন্তান স্টোকস জয়ের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিতে ভালোবাসেন মাঠে। সেটা করতে গিয়ে প্রায়ই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। ঝামেলায় জড়ান প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের সঙ্গে। রসালো শিরোনামের জন্ম দেন ট্যাবলয়েড পত্রিকার পাতায়।

    রাগটা একটু বেশিই তাঁর। বেশি ভালো করার তাড়নাটাও। ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি কেনসিংটন  ওভালে ক্রিশমার সান্টোকির প্রথম বলেই আউট হয়ে যান স্টোকস। ব্যাট হাতে ব্যর্থ হয়ে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি ২৫ বছর বয়সী অলরাউন্ডার। ড্রেসিংরুমে ফিরে গিয়ে লকারের দরজায় সর্বশক্তি দিয়ে বসিয়ে দেন বিরাশি সিক্কার ঘুসি। ফলাফল কবজিতে চিড় ধরে তাঁর। অবশ্য পরে স্টোকস পরে জানিয়েছিলেন মাঠের রাগ দরজা-জানালায় ঝাড়ার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। ছেলেবেলায় ক্লাব ক্রিকেট খেলার সময় রেগেমেগে একবার ‘ফায়ার এক্সিট’ দরজায় লাথি কষিয়ে হাড় ভেঙ্গেছিলেন ২৫ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার।

    স্লেজিংটাকে খেলার অংশ ভাবেন বেন স্টোকস। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ওপর চড়াও হয়ে তাদের অপ্রস্তুত করে ফলটা নিয়ে আসতে চান দলের স্বপক্ষে। কদিন আগেই বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অনুযোগ করে বলেছিলেন আম্পায়াররা অনেক সময় বাড়াবাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখান স্লেজিংয়ের প্রতি। স্টোকস মনে করেন দেশের হয়ে খেলার সময় এমন একটু-আধটু হতেই পারে। এসব ঘটনাকে নমনীয়ভাবে দেখলেই ভালো করবেন আম্পায়াররা। দর্শকরাও মাঠে এমন আগ্রাসন দেখতে পছন্দ করেন বলে দাবি করেন এই অলরাউন্ডার।

    বেন স্টোকসের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্বৈরথটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান মারলন স্যামুয়েলসের সঙ্গে। ২০১৫ সালে গ্রেনাডা টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সে সময় ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানের সঙ্গে কথার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন স্টোকস। ব্যাপারটা যে সহজভাবে নেননি স্যামুয়েলস সেটা বোঝা যায় ইংল্যান্ডের ইনিংসে বেন স্টোকস ব্যাট করতে নামলে। দেবেন্দ্র বিশুর বলে জার্মেইন ব্ল্যাকউডের হাতে স্টোকস ক্যাচ দিলে অদ্ভুত একটা কাজ করেন স্যামুয়েলস। নতমুখে ড্রেসিংরুমের দিকে টলতে টলতে যাওয়া স্টোকসের সামনে গিয়ে ঠকাস করে ঠুকে বসেন স্যালুট।

    সেই থেকে স্যামুয়েলসের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক স্টোকসের। এ বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে সে সংঘাত আরেক দফা চাগিয়ে ওঠে। কথার লড়াইয়ের জবাব অবশ্য ব্যাট হাতে দুর্দান্তভাবে দেন অপরাজিত ৮৫ রান করে ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এনে দেয়া স্যামুয়েলস। শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাথওয়েট স্টোকসের বলে টানা তিনটি ছয় মারার ক্যারিবীয়দের বাঁধভাঙ্গা উদযাপন স্টোকসের ক্ষতে নুন জল ঢেলে দিয়ে থাকবে। সে জন্য পরে ডেইলি মেইলে লেখা এক কলামে স্যামুয়েলসকে তুলোধুনো করেন ইংলিশ অলরাউন্ডার। দুপক্ষের গালাগালির কদর্য ফিরিস্তি তুলে ধরে লেখেন, “এই লোকটাকে আমার মোটেই সহ্য হয় না।”

    এ বছরের জানুয়ারিতে কেপটাউন টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যান টেন্ডা বাভুমাকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন স্টোকস। যা ধরা পড়ে স্টাম্পের মাইক্রোফোনে। সে ম্যাচে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করে শেষ হাসি হাসেন বাভুমাই।

    স্টোকসের ‘কীর্তি’ ছড়িয়ে আছে মাঠের বাইরেও। এ বছরের জুনে চতুর্থবারের মতো গতিসীমা ভেঙ্গে গাড়ি চালানোর জন্য আদালতে যেতে হয় ২৫ বছর বয়সী স্টোকসকে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে আবারও গতিসীমা ভেঙ্গে গাড়ি চালালে স্টোকসকে জেলে যেতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেন আদালত। সেই সঙ্গে দেন গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা।

    এমন রগচটা, আক্রমণাত্মক শুরু থেকে ছিলেন না বেন স্টোকস। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্মানো এই ক্রিকেটারের প্রতিভা বোঝা যাচ্ছিল শৈশব থেকেই। চাকরি হারিয়ে এক বছর বাড়িতে বসে ছিলেন রাগবি কোচ বাবা। অর্থাভাবে ঠিকমতো কোচিং করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই জ্বলে উঠেছেন স্টোকস। জায়গা পাকা করে ফেলেছে  ইংল্যান্ডের তিন ফরম্যাটের দলেই।

    ইংল্যান্ড তো বটেই সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার স্যার ইয়ান বোথাম তো বলেই দিয়েছেন যে ২৪ বছর বয়সে তিনি স্টোকসের মতো খেলতে পারতেন না। আরেক বিখ্যাত ইংলিশ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ মনে করেন ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বকালের সেরাদের একজন হওয়ার সামর্থ্য আছে স্টোকসের। তবে সবচেয়ে বড় প্রশংসাটা এসেছে কোচ ট্রেভর বেলিসের কাছ থেকে। টি-টয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ চার ওভারে টানা চারটি ছয় দিয়ে ইংল্যান্ডের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করার পরও স্টোকোসের সমর্থনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়ান ইংল্যান্ড কোচ। বলেন, “বেন স্টোকস ইংল্যান্ড ক্রিকেটের হৃদয় ও আত্মা।”

    সেটা যে তিনি সত্যিই সেটা বুঝিয়েছিলেন এ বছর কেপটাউনে ১৯৮ বলে ২৫৮ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলার পর। বিশ্ব ক্রিকেটেরও ‘হৃদয় ও আত্মা’ হয়ে ওঠার সামর্থ্য আছে বেন স্টোকসের। তবে সেজন্য মেজাজটাতে হয়তো একটু লাগাম বাঁধতে হবে।