• " />

     

    রং হারাচ্ছে বিপিএল?

    রং হারাচ্ছে বিপিএল?    

    দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেট বাণিজ্যের অন্যতম বিপণন মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টিটোয়ন্টি লিগ। আর্থিক লাভের পাশাপাশি রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে রঙটা আরেকটু চড়িয়ে দিয়ে ব্যাট-বলের লড়াইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ানোও যার লক্ষ্য। জাতিগত ক্রিকেট উন্মাদনায় উপরের দিকেই থাকা বাংলাদেশের ঘরোয়া টিটোয়েন্টি লিগটিকে বলা হচ্ছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের পরই সর্বাধিক অনুসৃত। তবে মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে আসলেই কতোটা আকর্ষণীয় হচ্ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ? চতুর্থ আসরের প্রথম পর্বে আলো ফেলে সে প্রশ্নরেই জবাব খোঁজার চেষ্টা করা যাক।  

     

    নিষ্প্রভ শুরু...

     

    কুড়ি ওভারের ক্রিকেটটাকে বলা হয় যুগের দাবী। পাঁচদিনের টেস্ট এমনকি একদিনের একশ’ ওভার খেলাও যাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়, টিটোয়েন্টি তাঁদের জন্য ‘পিকনিক’ বিনোদন। ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ এখানে যতোটা না মুখ্য, তারচেয়ে বেশী প্রত্যাশিত চার-ছয়ের ফুলঝুরি আর নয়-দশ ‘আস্কিং রান রেট’-এ লক্ষ্য তাড়া করার নখ কামড়ানো রোমাঞ্চ। কিন্তু বিপিএলের এবারের শুরুটা হল বড্ড নিষ্প্রাণ। প্রথম দিনের দু’ ম্যাচে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হল ২৯ রান আর ৮ উইকেটে। প্রথম পর্বে হওয়া ১৩ ম্যাচের ৭টিতেই জয় এসেছে অনায়াসে।

     

    রানের খেলায় রানখরা

     

    টিটোয়েন্টির ধর্ম মেনে শেষ ওভারের উত্তেজনা কিছু ম্যাচে ছড়ালেও অধিকাংশ ম্যাচেই ছিল রানের অভাব। ঢাকা পর্বে হওয়া ১৩ ম্যাচে ২৬ ইনিংসের মাত্র ৮টিতে রান হয়েছে দেড়শ’র বেশী। বিপিএলে সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহের নতুন রেকর্ডও গড়ে ফেলেছে খুলনা। তাঁদের ৪৪ রানের ঐ ইনিংসটি আবার টিটোয়েন্টির ইতিহাসেই যৌথভাবে তৃতীয় সর্বনিম্ন। উইকেটে রান না থাকায় সংবাদ সম্মেলনে সরাসরিই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বরিশাল বুলসের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম।

     

    তবে আশার কথা, রান আসতে শুরু করেছে পরের ম্যাচগুলোয়। ‘ডিউ ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় এগিয়ে আনা হচ্ছে খেলার সময়ও। তবে সেটা কতোটা কার্যকর হবে সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া টানা খেলায় পিচ আর আউটফিল্ডের বেহাল দশা গতবার ছিল লক্ষ্যনীয়। এবারও যে তেমন কিছু হবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে?

     

    মাঠে গড়াচ্ছে 'পরিত্যক্ত' ম্যাচ! 

     

    ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রথম তিন দিন মাঠেই গড়াতে পারে নি বিপিএল। প্রথম তিনটি ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পর আয়োজকদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় ম্যাচগুলো আবার খেলানোর। কারণ হিসেবে বানিজ্যিক ক্ষতির কথা বলা হলেও এভাবে বাতিল ম্যাচ পুনরায় অনুষ্ঠানের ঘোষণা আয়োজনের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আরও একবার।

     

    প্রেসবক্সে সংবাদ সম্মেলন

     

     

    রংপুর রাইডার্স আর খুলনা টাইটানসের ম্যাচ। খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনের আগে সাংবাদিকরা মাঠে প্রবেশ করে ড্রেসিংরুমের দিকে যাবেন, যেমনটা তাঁরা যান প্রতি ম্যাচের পরই। তবে এদিন বাধা হয়ে দাঁড়ান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিসিবির একজন স্বেচ্ছাসেবী। এ নিয়ে শুরু হওয়া বিতন্ডার জেরে সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে প্রেসবক্সে ফিরে আসেন সাংবাদিকরা। তারপর? সাংবাদিকদের চমকে দিয়ে তাঁদের সাথে কথা বলতে প্রেসবক্সেই চলে আসেন সে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় আরাফাত সানি।

     

    কার জন্য কনসার্ট?

     

    বিপিএলের এবারের আয়োজনে ছিল না কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত হয় প্রতিদিন দুই ম্যাচের মাঝের বিরতিতে কনসার্ট আয়োজনের। তবে মাঠের এক কোণে বানানো মঞ্চ থেকে গাওয়া গান গ্যালারিতে উত্তাপ ছড়াতে পারছে সামান্যই। দেশের নামী শিল্পীরা সেখানে পারফর্ম করছেন। কিন্তু তা উপভোগ করা দূরে থাকুক, ক’জন সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছেন? শিল্পীদের জন্যও কি সেটা অপমানজনক নয়?

     

    প্রেসবক্সের উপর আতশবাজির ‘অত্যাচার’

     

    উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন রাতের ম্যাচের ইনিংস বিরতিতে থাকছে আতশবাজির উৎসবও। তবে সেটার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে প্রেসবক্সের পিছনে অবস্থিত ক্রীড়া পরিষদের একটি ভবন। বিরতির সময় সংবাদ সরবরাহে ব্যস্ত থাকা সাংবাদিকদের জন্য আতশবাজি পোড়ানোর বিকট আওয়াজ যথেষ্টই পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

     

    গ্যালারির হাহাকার কমছে, তবে...

     

    টিকিটের উচ্চ মূল্য, কর্মদিবসে ভর দুপুরে খেলা শুরু, ঢাকার ট্র্যাফিক, লো স্কোরিং ম্যাচ...সব মিলিয়ে বিপিএলে প্রত্যাশিত দর্শক মিলছে না গ্যালারিতে। তবে গত আসরের তুলনায় উপস্থিতি বেড়েছে কিছুটা হলেও। অনলাইনে টিকিট সহজলভ্য করার ব্যাপারটিকে কৃতিত্ব দিতেই হবে সেজন্য। তুলনামূলক কম দামের কারণে পূর্ব গ্যালারি আর সৌজন্য টিকিটের বদান্যতায় গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড ভরে উঠছে প্রায় প্রতি রাতেই। কিন্তু চড়া মূল্যের জুয়েল-মুশতাক স্ট্যান্ডে উল্লেখযোগ্য দর্শকের দেখা মিলছে কেবল ছুটির দিনগুলোয়। অথচ মূল্যটা সাধারণের নাগালের মধ্যে এনে পুরো গ্যালারি ভরিয়ে তোলা গেলে মোটা দাগে লাভটা হতো বিপিএলেরই।

     

    সম্প্রচারে নিম্নমান অব্যাহত

     

    চ্যানেল নাইনের সম্প্রচারের মান নিয়ে বড় আকারে প্রশ্ন উঠেছিল গতবারই। সে সূত্রে সম্প্রচার স্বত্বাধিকার বদলের কথাও শোনা যাচ্ছিল এবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলো চ্যানেল নাইনই। তবে কর্তৃপক্ষের আশ্বাস ছিল মান বাড়ানোর। বলা হয়েছিল এলইডি স্ট্যাম্প, অত্যাধুনিক ক্যামেরা, স্পিডমিটারসহ থাকবে আধুনিক সম্প্রচারের সব ব্যবস্থা। অথচ কথার সাথে কাজের মিল পাওয়া যাচ্ছে সামান্যই।

     

    শেষ ওভারে 'শনি'র ভর

     

    এ পর্যন্ত হওয়া ১৩ ম্যাচের ৪টিতে দেখা গেছে শেষ ওভারের রোমাঞ্চ। এর মধ্যে কেবল একবার পরে ব্যাট করা দল জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে, বাকি তিন দফাতেই উইকেটে থাকা ব্যাটসম্যানরা শেষ ওভারে প্রয়োজনীয় ৬-৭ রান তুলে নিতে পারেন নি। এ নিয়ে দলগুলোর অধিনায়করাও প্রকাশ করেছেন হতাশা। প্রশ্নবিদ্ধ করছেন ব্যাটসম্যানদের মানসিকতাকে। দুয়েক রান করে নিয়ে যেখানে ম্যাচ বের করা যায়, সেখানে বড় শট খেলতে গিয়ে তীরে এসে তরী ডোবানোর প্রবণতা হতাশাজনকই।

     

    ‘অদ্ভুত’ আউট

     

    বরিশাল বুলস বনাম রাজশাহী কিংসের ম্যাচ। বরিশালের পাহাড়সম ১৯২ রান তাড়া করতে নেমে শুরুটা ভালোই করেছিল রাজশাহী। প্রথম ওভারে প্রথম উইকেটের পতনের পর সাব্বির-মমিনুলের ঝড়ো গতির জুটি ৩১ বলে তুলে ফেলেছিল ৪৮। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারে আল-আমিনের লেন্থ বল আড়াআড়ি ব্যাটে পুল করতে গিয়ে মিড অনে থিসারা পেরেরার হাতে ধরা পড়েন মমিনুল। ঘটনা তার পরের বলে। আল-আমিনের বল আঘাত হানলো উমর আকমলের পায়ে। কিন্তু সেটা যথেষ্টই উপরে হওয়ায় আবেদন করার প্রয়োজন বোধ করেন নি স্বয়ং বোলারই। কিন্তু উইকেটরক্ষক মুশফিক আর স্লিপে দাঁড়ানো ফিল্ডারের নিয়মরক্ষার আবেদনই আঙ্গুল তোলার জন্য যথেষ্ট জ্ঞান করলেন পাকিস্তানি আম্পায়ার খালিদ মাহমুদ। রিপ্লেতে দেখা গেলো, বলটা স্পষ্টই স্ট্যাম্প মিস করছিল। হতাশামাখানো হাসি দিয়ে মাঠ ছাড়লেন আকমল। দিন শেষে সে হতাশা কি ছড়িয়েছিল কিংস ক্যাম্পেও? ম্যাচটা যে মাত্র ৪ রানে হারতে হয়েছিল তাঁদের!

     

    লাগাম থাকুক উদযাপনে

     

    চিটাগং ভাইকিংসের মুখোমুখি বরিশাল বুলস। চট্টগ্রামের ১৬৩ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমেছে বরিশাল। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভার। মিডল স্ট্যাম্পে শুভাশিস রায়ের গুড লেন্থ ডেলিভারি স্লগ করতে চেয়েছিলেন জশুয়া কব। কিন্তু লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে গেলেন। প্রতিপক্ষের প্রথম উইকেট, বড় ব্রেক থ্রু বটেই। কিন্তু শুভাশিস যেভাবে কবের সামনে গিয়ে দৃষ্টিকটু ভঙ্গিমায় উদযাপনে মজলেন, মনে হচ্ছিল সম্প্রতি জাতীয় দলে ডাক পাওয়া এই পেসারের গোটা ক্যারিয়ারেই ওটা প্রথম শিকার!

     

     

    সে ম্যাচে এবং তার আগে রাজশাহীর বিপক্ষে ম্যাচেও জয়ের পর বরিশালের অধিনায়ক মুশফিকের উদযাপনেও ‘অস্বাভাবিকতা’ ধরা পড়েছে অনেকের চোখে। গত টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আগ বাড়িয়ে উদযাপনের পর হেরে গিয়ে হাসির পাত্র হয়েছিলেন। অবশ্য বাংলাদেশের টেস্ট ক্যাপ্টেন দিচ্ছেন অন্য ব্যাখ্যাও, বলছেন আবেগের এমন প্রকাশ ভূমিকা রাখছে তাঁর সপ্রতিভ পারফরম্যান্সে।

     

    আবেগ প্রকাশে বাধা নেই। তবে জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক তারকা হিসেবে স্ব স্ব অবস্থানের সাথে সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হোক, কাম্য এটুকুই।

     

    ভিক্টোরিয়ানসের উল্টোরথ আর ‘মাশরাফি বনাম ম্যানেজম্যান্ট’

     

    গতবারের চ্যাম্পিয়নদের জন্য এবারের বিপিএল এখনও পর্যন্ত বিভীষিকারই নামান্তর রয়ে গেছে। চার ম্যাচ খেলে একমাত্র দল হিসেবে জয়বঞ্চিত মাশরাফি এন্ড কোং। সেটার নেতিবাচক প্রভাবও দলের উপর পড়তে শুরু করেছে বৈকি। ঢাকা ডায়নামাইটসের বিপক্ষে কুমিল্লার ম্যাচের দিন দুপুরে বোমাই ফাটালো স্থানীয় এক অনলাইন গণমাধ্যম। শোনা গেলো, একাদশ নিয়ে টিম ম্যানেজম্যান্টের সাথে মনোমালিন্যে হোটেল ছেড়ে বাসায় চলে এসেছেন মাশরাফি। না-ও খেলতে পারেন ঢাকার বিপক্ষে। পরে অবশ্য জানা গেলো, বাসায় ওরকম প্রায়ই আসেন তিনি।

     

    জল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটাও খেললেন। কিন্তু খেলা চলাকালীন একটি ওভার করার জন্য মাশরাফির বল হাতে নিয়েও ডাগ আউট থেকে কোনো বার্তা পেয়ে নাবিল সামাদের হাতে বল তুলে দেওয়া এবং অতঃপর আবার নিজে বল করতে যাওয়া…দ্বন্দ্ব বিষয়ক চাপানউতোরটাই যেন খানিক প্রকাশ করে দিলো। আগের তিন ম্যাচের পরই সংবাদ সম্মেলনে এলেও সে রাতে সাংবাদিক মহলের উত্তেজনায় জল ঢেলে পাঠিয়ে দিলেন ইমরুল কায়েসকে। শোনা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রামে দলের সাথেও যোগ দেন নি। সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন শিবিরে অস্থিরতাটা টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোভাবেই।

     

               সব মিলিয়ে বিপিএলের প্রথম দু’ আসরের তুলনায় শেষ দু’ আয়োজনে জাঁকজমকটা চোখে পড়ছে একটু কমই। বিখ্যাত বিদেশীদের উপস্থিতিও কম। ম্যাচ পাতানো কেলেংকারির দায়ে মাঝে দু’ বছরের বিরতি একটা বড় কারণ বটেই। অভিযোগ ছিল খেলোয়াড়দের পাওয়া ঠিকমতো পরিশোধ না করারও। সেসব  বিবেচনায় গত আসরটা শেষ করা গেছে কোনোরকম বিপত্তি ছাড়াই। মাঝে সৃষ্ট নিরাপত্তার আশংকা উড়িয়ে চতুর্থ আয়োজনও চলছে নির্বিঘ্নে। পাশাপাশি মাঠের ক্রিকেটের মান আর মাঠের বাইরের পেশাদারিত্ব- সময়ের সাথে দুটোই বাড়ুক, এমনটাই প্রত্যাশা।