• " />

     

    শ্বেত বসনের শাপমোচনের দিন

    শ্বেত বসনের শাপমোচনের দিন    

    দেড় সহস্রাধিক দিবসের অবসান শেষে, দুঃসহ বেদনাবিধুর কত পরাজয় পরে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের শ্বেত পোশাকে এসেছিল বিজয়ের উজ্জ্বল আভা। সনাতন ক্রিকেটের নবীন সদস্যটি প্রথমবারের মতো রুগ্ন-করুণ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে, অট্টহাস্যে হেসে উঠার সুযোগ পেয়েছিল। অভিজাত আঙিনায় আভিজাত্যের দোর্দন্ড প্রতাপ দেখিয়ে, একদা শত-সহস্র জ্বালা-যন্ত্রণা, লজ্জা-লাঞ্ছনা সব উগরে দিতে পেরেছিল।

    যে সাদা কাপড়টাতে বরাবর লেগেছিল কলংকের দাগ , নিজেদের দৈন্যদশায় মলিন ছিল যে শ্বেত পোশাক, যে পোষাকের ক্রিকেটে চূড়ান্ত লজ্জার কথা শুনতে হয়েছে নিত্য আহার্য্যের মতো, সেদিন সেই পোশাকটাই সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটে।

    নতুন বছরের দশম দিবসে বিশ্বক্রিকেট প্রত্যক্ষ করেছিল, অভিজাত পরিবারের দশম সদস্যের প্রথম টেস্ট বিজয়।

    ***

     

    নতুন বছরে আতিথ্য গ্রহণ করা জিম্বাবুয়েকে ‘সৎকার’ পরিকল্পনাতেই সেবার আতিথেয়তা জানিয়েছিল বাংলাদেশ। কালো-ধলো রেষারেষির জের ধরে বিশ্রী অবস্থায় তখন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট। যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা হয়েছেন দেশান্তরী, কৃষ্ণাঙ্গ যে কেউ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলে। তাই বাংলাদেশ সফররত আনকোরা ও অনভিজ্ঞ জিম্বাবুয়ে দলটির গড় আয়ু ছিল ২২-২৩। দলনায়ক টাটেন্ডা টাইবুর বয়সই যে তখনও বাইশ হয়নি। দলের সবচেয়ে বেশী বয়সী ক্রিকেটার ছিলেন ডগলাস হোন্ডো, ২৬ বছর!

    বিপরীতে অভিজ্ঞতা আর শক্তি বিবেচনায় বাংলাদেশ তখন প্রথমবারের মতো পেয়ে গিয়েছে ‘ফেভারিট’ তকমা। ক্রিকেটে থিতু হতে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জন্য যা কি না ‘শাপ’ হতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।

    তবে সেই শংকা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল প্রথম দিনেই।

    ***

     

    টসজয়ী অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণের দায় তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধেই। উদ্বোধনী দুই ওপেনারও অবশ্য হতাশ করেননি অধিনায়ককে। নাফিস ইকবাল ও জাভেদ ওমর ৯১ রান তুলে এনে দিয়েছিলেন নির্ঝঞাট সূচনা।

    পরপর দুই ওপেনার বিদায় নিলেও প্রথমে আশরাফুল আর পরে রাজিনকে সাথে নিয়ে আপন লক্ষ্যসৌধে অবিচল ছিলেন দলনায়ক। যদিও প্রথম দিন শেষের খানিক আগে, স্নায়বিক-নব্বইতে(৯৪) কাটা পড়ে চতুর্থ টেস্ট শতকটি অল্পের জন্য মিস করে গিয়েছিলেন তিনি। তবুও দিনশেষে ম্যাচের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল স্বাগতিক দলের হাতেই।

     

    যে নিয়ন্ত্রণ দ্বিতীয় দিনেও হাতছাড়া তো হয়ইনি, উলটো আরো পোক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশের ৪৮৮ রানের জবাবে জিম্বাবুয়ে যে তখন ৮৪ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফলোঅন আশংকায় কাঁপছে!

     

    সব ভালোর মাঝে মন্দ দিক ছিল, একজন ব্যাটসম্যানেরও তিন অংকের দেখা না পাওয়া। হাবিবুলের পর রাজিনও ফিরেছিলেন ৮৯ করে। লোয়ার অর্ডারে খালেদ মাসুদ(৪৯), মোঃ রফিক(৬৯) ও মাশরাফির(৪৮) ব্যাট চওড়া না হলে অবশ্য প্রায় পাঁচশ স্কোর পায় না বাংলাদেশ।

     

    ছোটখাটো গড়নের টাটেন্ডা টাইবুর ব্যাট যে এত প্রকান্ড হতে পারে তা কে জানতো! তাঁর ব্যাটে ভর দিয়ে তৃতীয় দিনে, জিম্বাবুয়ে ফলোঅন লজ্জা থেকে ঠিক রেহাই পেয়ে যায়। যদিও বেচারা টাইবুও কাঁটা পড়েছিলেন স্নায়বিক নব্বইতে(৯২), রফিক একাই জিম্বাবুয়াইন ব্যাটিং লাইনআপের অর্ধেকটা সাবাড় করে দিয়েছিলেন।

    ***

     

    চতুর্থ দিনের শুরু আর শেষে কত ব্যবধান! শেষ পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে ফলোঅনের মতো ম্যাচটাই না বাঁচিয়ে ফেলে, এই শংকা নিয়ে শুরু হওয়া দিনের সমাপ্তিতে যে পুরো ভিন্ন চিত্রের দৃশ্যায়ন! দিনের সূচনায় জিম্বাবুয়ের লেজ কেটে দিতে দশ ওভার সময় নিয়েছিলেন মাশরাফি ও রফিক। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫১ ওভার ব্যাট করে, ইনিংস ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ। দ্রুত রান তোলার সংকল্পে থিতু হতে পারেননি কেউই, ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল অধিনায়ক। ইনিংসের একমাত্র অর্ধশতকটি এসেছিল তাঁর ব্যাট থেকেই।

    সোয়া একদিনে ৩৮১ রানের টার্গেট। নেহাৎ কম নয়, আবার খুব কি বেশী?

    হয়তো বেশী। জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানদের জন্য যা অনেক বেশী হয়ে গিয়েছিল! ম্যাচের চতুর্থ দিনান্তে, তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশকে সাত উইকেটের অপেক্ষায় রেখে রাত পোহাতে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে।

    ***

     

    প্রথম টেস্টের পঞ্চম দিন, ১০ই জানুয়ারী ২০০৫। ম্যাচ জিততে বাংলাদেশের চাই মাত্র সাত উইকেট!  ইতিহাসের স্বাক্ষী হওয়ার সুখস্বপ্নে ক’জন ক্রিকেটপিয়াসীর সুখনিদ্রা হয়েছিল কে জানে! ক্রিকেটাররাই কি ঠিকঠাক নিদ্রামগ্ন হতে পেরেছিলেন? নাকি বারবার তন্দ্রা মতো হয়ে বারংবার নিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছিল সকলের?

    রাত পোহালেই নতুন সূর্য, নতুন সকাল। এক নতুন বিজয়ের অপেক্ষা...। ঘুম কীভাবেই বা হয়?

     

    ***

    টেলর-মাসাকাদজা অপেক্ষার যন্ত্রণা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর রেখেছিলেন অনেকক্ষণ। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছিল এনামুল জুনিয়রের বলে। টেলর আউট হয়ে যেন উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের উইকেট দুয়ার। যে দুয়ারের শেষটাও টেনেছিলেন ওই এনামুলই। দ্বিতীয় ইনিংসে সাত উইকেট নিয়ে যিনি ছিলেন প্রথম জয়ের ম্যাচসেরাও। 

    এনামুলের বল পোফুর ব্যাট ছুঁয়ে আশরাফুলের হাতে জমা পড়তেই, লেখা হয়ে যায় বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম বিজয়কাব্য।

    চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের গ্যালারীর উদ্বেলিত জনতার হর্ষধ্বনি সংক্রামকের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, দেশের নানা প্রান্তে। অলি-গলি, মেঠোপথ-রাজপথ সর্বত্র যেন এক মহা আনন্দের মহা ধুম পড়ে যায়।

    দেশজুড়ে বেরুনো বিজয় মিছিলগুলোর মতো, ক্রিকেটারদের মাঝেও ডেকে যায় আনন্দের অবারিত বান। কঠিন-দুঃসময়ের ব্যাথা তো তাঁরাই সবচেয়ে বেশী অনুভব করেছিলেন, তবে সুখানুভূতিটাই বা নয় কেন?

    মহোল্লাসের মহা আনন্দে, মাঠের চারপাশ জুড়ে আনন্দ-দৌড়ে বিজয়ের এক বৃত্তই যেন এঁকে দিচ্ছিলেন তাঁরা। আনন্দের আতিশয্যে কেউ ডিগবাজি খাচ্ছিলেন, কেউ বা ইচ্ছেমতো লম্পঝম্প করছিলেন। আবার কারও চোখে হয়তো চিকচিক করছিল আনন্দ জল। সেই যে কথায় আছে না,

    ‘অল্প সুখে হাস্য মুখে

    নানা কথা কয়

    বেশী সুখে চোখে জল

    চুপ করে রয়।’

    বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা অবশ্য চুপ করে ছিলেন না। ভেসে গিয়েছিলেন প্রথম টেস্ট জয়ের মহা উচ্ছ্বাস-আবেশে, শাপমোচনের উচ্ছল মহোৎসবে। এক যুগ পরেও যে দিনটা এখনো সজীব।