• বাংলাদেশ বনাম শ্রীলংকা
  • " />

     

    "ব্রেইন ফেড" এবং শততম টেস্টের আগে আত্মজিজ্ঞাসা

    "ব্রেইন ফেড" এবং শততম টেস্টের আগে আত্মজিজ্ঞাসা    

    কদিন ধরেই “ব্রেইন ফেড” শব্দটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে খুব চলছে। কী বাংলা করা যেতে পারে এর? বুদ্ধিনাশ, মতিভ্রম জাতীয় কিছু হয়তো ব্যবহার করা যায়। মতিষ্কবিকৃতি আক্ষরিক অনুবাদ হতে পারে, তবে সেটার অর্থটা একটু আলাদা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আত্মহননের মাত্রা বোঝাতে ঠিক কোনো শব্দই লাগসই নয়। কিন্তু পাঁচ দিনের ম্যাচে ১৬ বছর পর পার হয়ে যাওয়ার পর শততম টেস্ট যখন দোরগোড়ায়, তখন এই প্রবণতার উর্ধ্বমুখী গ্রাফ আসলে কী বোঝায়?

     

    একটু পেছন থেকেই ঘুরে আসা যাক। ইংল্যান্ডের সঙ্গে মিরপুর টেস্টের দ্বিতীয় দিন। ২ উইকেটে ১৫২ রান নিয়ে স্বস্তির একটা দিনের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। দিনের খেলা শেষ হওয়ার যখন আর তিন ওভার বাকি, মাথায় কী যেন একটা ভূত চেপে বসল মাহমুদউল্লাহর। জাফর আনসারির স্পিনটা উড়িয়ে মারতে গিয়ে লাইন মিস করলেন। এরপর থেকে ধারাভাষ্যকারের সেই “ব্রেইন ফেইড” কথাটা এভাবে বাংলাদেশকে তাড়া করে বেড়াবে সেটা কে ভেবেছিল? এরপর ক্রাইস্টচার্চে সাকিবের ওই আউট নিয়ে যে তুমুল বিতর্কটা তো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তুমুল ঝাঁকি দিয়েছিল। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ইনিংস খেলার পর দ্বিতীয় ইনিংসে অফ স্টাম্পের বলে শর্ট বল তাড়া করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন। ম্যাচের পরিস্থিতি যখন দাবি করছিল স্থিতধী হয়ে খেলার, সাকিব নিজের উইকেটটা উপহারই দিয়ে এলেন। সেটা নিয়ে কদিন ধরেই ধুন্দুমার। তবে আসল বিতর্কটা শুরু হলো হায়দরাবাদ টেস্টে। প্রথম ইনিংসে দারুণ খেলতে খেলতেই করে ফেলেছিলেন ৮২ রান। কিন্তু আগের মতোই হঠাৎ করে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে খেলতে গেলেন অশ্বিনকে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই অপমৃত্যু হলো একটা ইনিংসের। সাকিব বোমাটা ফাটালেন এরপর। সোজাসুজিই বলে দিলেন, এভাবে খেলেই তিনি সাফল্য পেয়েছেন। নিজের খেলার ধরন বদলানোর ইচ্ছাও তাঁর নেই। গলে প্রথম ইনিংসে অবশ্য এতোটা আত্মঘাতী ছিলেন না। তারপরও সান্দাকানের লেগ স্টাম্পের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া বলটা তাড়া না করলেও পারতেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠেই যাচ্ছে।

     

    সাকিব না হয় তাঁর ধরনটা স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সীমারেখাটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুশফিকুর রহিমের তো এমন হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের এই টেস্ট দলে পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী খেলতে পারার জন্য সর্বোচ্চ নম্বর তো তাঁর কাছেই যাওয়া উচিত। হায়দরাবাদের অশ্বিন-জাদেজাদের স্পিন সামলে যেভাবে মনযোগ ও সংযমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, তাতে তাঁর অন্তত উইকেট দিয়ে আসার কথা নয়। কিন্তু ১৩৭ রানের ওই দুর্দান্ত প্রথম ইনিংসের পর অশ্বিনকে উড়িয়ে মারতে যাওয়ার “দুঃসাহস” দেখাতে গেলেন। আউট হয়ে ফলটা পেলেন হাতেনাতেই। পরে মুশফিক ব্যাখ্যা করেছিলেন, অশ্বিনকে থিতু হতে না দিতে চাওয়ার জন্যই ওই কৌশল ছিল। গলে সান্দাকানের বলে সাকিবের কার্বন কপি আউটের পরও মুশফিকের কথা, ওই মুহূর্তে ওই শট থেকে রানই আশা করেছিলেন। আউট হয়ে যাওয়াটা স্রেফ দুর্ভাগ্যই। কিন্তু এই যুক্তি কি আসলেই ধোপে টেকে? অমন দারুণ শুরুর পরও উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসার জন্য সৌম্যর মতো নবীনকে কি তাহলে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায়? সিনিয়ররাই যেখানে উইকেট দিয়ে আসার লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছেন, জুনিয়ররা তো সেটা থেকে শিখতেই পারেন।

     

    শততম টেস্টের আগে বাংলাদেশ দলকে দাঁড়াতে হচ্ছে এমন অনেক আত্মজিজ্ঞাসার সামনে। ব্যক্তির জায়গায় যদি দাঁড় করানো হয় দলকে, তাহলে উঠে আসবে আরও অনেক প্রশ্নই। এক নিউজিল্যান্ডকে বাদ দিলেম শততম টেস্টের আগে যে সবাই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। প্রথম ১০০ টেস্টে শুধু নিউজিল্যান্ডেরই বাংলাদেশের চেয়ে কম জয় আছে। তবে কিউইরা হেরেছে ৪৬টি ম্যাচে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৭৬ (কলম্বোতে হারলে সেটা হয়ে যাবে ৭৭)। এমনকি সাম্প্রতিক এমন দুর্দশার পরও জিম্বাবুয়ের প্রথম ১০০ টেস্টে জয় আছে ১১টি। পরাজয়ের হিসেবও যদি ধরা হয়, তাহলেও তো বাংলাদেশের লজ্জা সবচেয়ে বেশি। যে ৭৬টি ম্যাচ বাংলাদেশ হেরেছে, এর মধ্যে ৩৬টিই ইনিংস ব্যবধানে। প্রথম ১০০ টেস্টের মধ্যে কাছাকাছি সবচেয়ে বেশি ইনিংস ব্যবধানে হারার রেকর্ড জিম্বাবুয়ের (২৩টি)। নিউজিল্যান্ড ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে ২০টি ম্যাচে, দক্ষিণ আফ্রিকা হেরেছে ১৯টি ম্যাচে। জয়ের হিসেবে অবশ্য বাংলাদেশ পাশে পাবে নিউজিল্যান্ডকে। প্রথম ১০০ টেস্টে বাংলাদেশের আট জয়ের একটিও ইনিংস ব্যবধানের নয়। নিউজিল্যান্ডেরও কোনো ইনিংস ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড নেই। জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার আছে দুইটি করে। প্রথম ১০০ টেস্টে বাংলাদেশ ৪০০ বা তার চেয়ে বেশি রান করেছে ১৫ বার। জিম্বাবুয়েও ৪০০ ছাড়ানো রান করেছে ১৫ বার, এখানে শুধু নিউজিল্যান্ডই বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে (১১ বার)।

     

     

     

    অথচ একটা দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে সবার চেয়ে। প্রথম টেস্ট খেলার ৩২ বছর পর শততম টেস্ট খেলতে পেরেছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া খেলেছে আরও তিন বছর পর। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই মাইলফলকে যেতে লেগেছে সর্বোচ্চ ৬০ বছর। অথচ বাংলাদেশ সবার আগে ১৬ বছরেই পেয়ে গেছে শততমের বরমাল্য। শ্রীলঙ্কার লেগেছিল ১৮ বছর, বড় একটা ধাক্কা না খেলে জিম্বাবুয়ের সময়ও হয়তো ২৪ বছর লাগত না।

     

    ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানেও তো বাংলাদেশ পিছিয়েই আছে। এখনও বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ১০০ টেস্টে চার হাজার রান পেরুনো কোনো ব্যাটসম্যান নেই। অথচ জিম্বাবুয়ের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভারা সেই মাইলফলক পেরিয়ে গিয়েছিলেন আগেই। এখনও কোনো বোলারের ২০০ উইকেট। জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিক বা শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরনেরও শততম টেস্টের আগেই সেই কীর্তি হয়ে গিয়েছিল। অন্য দলগুলোর কথা না হয় বাদই থাকল।

    পরিসংখ্যান, ফর্ম... আশা দেখাচ্ছে না কিছুই। শততম টেস্টে জয়ের আশাও দুরাশাই বলা উচিত। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়েও তাদের শততম টেস্টে হেরেছিল। আপাতত বাংলাদেশকে সেই বন্ধনীতে ঢোকারই হয়তো প্রস্তুতি নিতে হবে। বার বার “ব্রেন ফেড” বলে দিচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেট শেখার এখনো অনেকটা পথ বাকি। কাঁটাভরা সেই পথে বাংলাদেশ কতটা রক্তাক্ত হবে, তার উত্তরটা বলে দেবে সময়ই।