• " />

     

    তাঁরা তিনজন আছেন এবারও

    তাঁরা তিনজন আছেন এবারও    

    পি সারা ওভালে দীর্ঘতর হয়ে আসে শেষ বিকেলের ছায়া। জীবনের সমুদ্র সফেন শেষে বাংলাদেশ দল একটা সুখী পরিবার। অনুযোগ, বঞ্চনা আজ এক পাশে সরিয়ে রাখার দিন। সেই আনন্দ হিল্লোলের মধ্যে বাকিদের ওপর ছায়া হয়ে থাকেন তিনজন। কম তো নয়, এক যুগ হয়ে গেল, কত ঝড় ঝাপটা সামলেছেন একসঙ্গে। মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল জানেন, এই জয়টা তো আর দশটা জয়ের মতো নয়। অন্তত তাঁদের তিনজনের জন্য তো বটেই।

    দশ বছর আগে এই সময়ের কথা কি মনে পড়ে তাঁদের? সেই পোর্ট অব স্পেনের রোদেলা দুপুর, বিশ্বকে সদম্ভে জানিয়ে দেওয়ার দিন, আমরা এসে গেছি। জহির খানকে সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলা তামিমের সেই ছয়, এরপর মুশফিক-সাকিবের অপরিণত ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ভারতকে হারানো- তিনজন তো একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটা দিয়েছিলেন তখনই। এরপর বাংলাদেশের ক্রিকেট-মানচিত্রে নতুন সীমানা এঁকে দেওয়ার কাজে তাঁরাই তো ছিলেন সবার সামনে।

    সেই পোর্ট অব প্রিন্স থেকে শুরু। এরপর সেন্ট জর্জেস, মিরপুর, চট্টগ্রাম, অ্যাডিলেড- বাংলাদেশ সব সাফল্যে কুশীলব হয়ে থেকেছেন তাঁদের কেউ না কেউ। তবে তারপরও, কলম্বো টেস্টের গল্পটা তো অন্যরকমই।

    টেস্ট শুরুর দুই দিন আগেই কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে একটু অনুযোগের সুরেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের এমন অনভিজ্ঞ বোলিং আক্রমণ নিয়ে লড়াই করা কঠিন। সাকিবেরও আগের মতো সেই ম্যাচ জেতানো বোলিং করার সামর্থ্য নেই। সাকিব কি কোচকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই কিছুদিন আগেও চট্টগ্রাম টেস্টে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সাত উইকেট নিয়েছিলেন? নাকি ঠিক করে রেখেছিলেন, মাঠেই সেই জবাবটা দেবেন অনুচ্চারে? চতুর্থ দিনে যখন ম্যাচটা বাংলাদেশের মুঠো গলে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে, মুস্তাফিজের সঙ্গে তাঁর স্পেলটাই তো মোড় ঘুরিয়ে দিল ম্যাচের। সেঞ্চুরি ও  ছয় উইকেটের কীর্তি তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়, সেঞ্চুরি ও দশ উইকেটের কীর্তিই তো তাঁর আছে। তবে চারদিক থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনা, অনেক প্রশ্ন –সংশয়ের পাহাড়কে পাথরচাপা দেওয়ার জন্যই কি সাকিব ম্যাচটা অনেক দিন মনে রাখবেন? সিরিজসেরা হওয়ার গৌরবের চেয়ে সেটাই কি সাকিব বড় করে দেখবেন?

    প্রমাণ করার তো কিছু মুশফিকুর রহিমেরও ছিল না। এই সিরিজের আগেই সিদ্ধান্ত হলো, মুশফিক গ্লাভস তুলে রাখবেন। আর উঠে আসবেন চারে। গলেও সেটিই হলো। কিন্তু কলম্বোতে লিটন দাশের চোটে আবার হাতে গ্লাভস ওঠাতে হলো। তবে ম্যাচের আগে বোমাটা ফাটালেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। ‘লিটন চোট না পেলে দলে আরও বড় পরিবর্তন হতে পারত-’ দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না সবার। তাহলে কি মুশফিককে বাদ দেওয়ার ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন বোর্ড সভাপতি? অবিশ্বাস্যের চেয়েও কথাটা বেশি কিছু, তবে সভাপতির বক্তব্য বিশ্বাস করলে সেরকমই কিছু হতে চলেছিল।

    মুশফিক জানতেন, কাজটা কঠিন হবে। ব্যাট হাতে নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই, এই বছরে তাঁর চেয়ে বেশি রান তো আছে শুধু সাকিবেরই। তবে অধিনায়কত্ব নিয়ে তো কম প্রশ্ন ওঠেনি। কলম্বো টেস্টে হার কি পায়ের তলার মাটি আরেকটু সরিয়ে দিত? ব্যাটসম্যান মুশফিক তো পাশ নাম্বার পেয়েছেনই, দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। অধিনায়ক মুশফিকের কি কিছুটা কৃতিত্ব পাওনা নয়? মুশফিক অবশ্য ম্যাচ শেষে সতীর্থদের কৃতিত্বটাই বড় করে দেখলেন, একজন অধিনায়কের যেমন দেখা উচিত।

    তামিমের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। বাকি দুইজনের মতো তাঁকে নিয়ে অন্তত কোচের কোনো অদৃশ্য ইশারার কথা শোনা যায়নি। তামিমের প্রমাণ করার ছিল নিজের কাছে। এই সিরিজে শুরুটা ভালো করেও কেন যেন বড় কিছু করতে পারছিলেন না। ৪৯, ৫৫ রানের ইনিংস তো তামিমের জন্য নয়। সেরাদের যেমন হয়, সবচেয়ে কঠিন সময়েই নিজের সেরাটা বের করে আনলেন। চতুর্থ ইনিংসে শ্রীলঙ্কার মাঠে ১৯১ রান, প্রতিপক্ষ রঙ্গনা হেরাথের আবার শেষ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ৫ উইকেট- বাংলাদেশের চলার পথে তো কম কাঁটা বেছানো ছিল না। তামিম সন্তর্পণে সব কিছু তুলে ফেললেন একে একে, থিতু হওয়ার পর সেই দুর্গম পথটাকে করে ফেললেন ফুলে ফুলে শোভিত। ৮২ রানের ইনিংসের শেষটা মনমতো হয়নি, তবে ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়ার জন্য সেটিই যথেষ্ট ছিল। বাংলাদেশের এভারেস্ট ছুঁতে যাওয়ার জয়ে সাকিব যদি হিলারি হন, তামিম তো অবশ্যই তেনজিং নরগে।

    তবে তাঁরা জানেন, এ কেবল শুরু। যে টেস্ট জয়ের জন্য একটা সময় অপেক্ষা করতে হতো চাতকের মতো, ছয় মাসের মধ্যেই সেই জয় পেয়েছে দুইবার। একটা সময় টেস্ট না জেতার অপবাদ ছিল, সেটা ঘুচেছে। দেশের বাইরে বাংলাদেশ জিততে পারে না- জবাব দেওয়া হয়ে গেছে সেই প্রশ্নেরও। বাংলাদেশ জানে, এই তিন জন থাকলে জবাব পাওয়া যাবে আরও অনেক প্রশ্নের, তিন জনের হাত ধরেই আসবে আরও অনেক সূর্যোদয়।