• " />

     

    সেদিনের এই দিনেঃ এক যে ছিল লারা...

    সেদিনের এই দিনেঃ এক যে ছিল লারা...    

    ‘মহাকাব্যিক’ শব্দটা ক্রিকেটে ঠিক কখন ব্যবহার করা যায়? কখন একটা ইনিংসের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘গ্রেটনেসের’ তকমা? সেঞ্চুরি তো কত শত শত আছে, ডাবল-ট্রিপলও বিরল নয়। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়টি সত্যি সত্যিই হয়ে ওঠে ক্রিকেট-পুরাণের গল্প? একবার চোখ বন্ধ করুন, ব্রায়ান লারার ওই ১৫৩ রানের ইনিংসটাই কি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে?

    আজ থেকে ১৮ বছর আগে গভীর রাতে যারা বুঁদ হয়ে ছিলেন টিভি পর্দায়, তারা নিশ্চয় সেটি ভুলতে পারবেন না। একটা সময় যে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার, পঞ্চম দিনে ২২ গজে যেখানে বল সাপের মতো ফণা তুলছিল অতর্কিতে,  ক্রিকেট-কাননে সব পাপড়ি মেলে সেখানেই সৌরভ ছড়ালেন ব্রায়ান লারা। ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালে লারার ব্যাট হয়ে উঠেছিল খাপখোলা তলোয়ার, ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রাদের কচুকাটা করছিলেন একের পর এক। ধ্রুপদী হয়ে যাওয়া ব্যাকলিফটের পর সেই পুল, ওয়ার্নকে এক হাতে করা সেই সুইপ, গিলেস্পির বলে প্রায় শ্বাসরোধ করে দেওয়া ভয়ঙ্কর সুন্দর কভার ড্রাইভ- ২২ গজে এমন অপার্থিব কিছু কি আগে দেখেছে?

    এমন নয়, ২২ গজে এর চেয়ে ধ্রুপদী ইনিংস আগে হয়নি। কত গ্রেট ক্রিকেটারের কত দুর্দান্ত ইনিংস আছে, ব্রায়ান লারারই তো তার আগে ৩৭৫ রানের ইনিংসও ছিল। আগের টেস্টেই ২১৩ রানের আরও একটা মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেছিলেন। তারপরও ব্রিজটাউনের ওই ইনিংসটা ঠিক কী কারণে ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল?’ ঠিক কী কারণে টনি কোজিয়ারের মতো বহুদর্শী ধারাভাষ্যকারও সবিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন, ‘বিশ্বাস করুন, আমি কোনো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানকে এভাবে খেলতে দেখিনি’? সেটা জানতে ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে।

    অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওই সিরিজ ত্রিনিদাদের রাজপুত্রের কাছে ছিল অগ্নিপরীক্ষার চাইতেও বেশি কিছু। ১৯৯৭-৯৮, এই দুই বছর কেটেছিল বিভীষিকার মতো, টেস্টে এই সময়েও একবারও ছুঁতে পারেননি তিন অঙ্ক। ঠিক ওই সিরিজের আগে ঐতিহাসিক দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটা তো ছিল দুঃস্বপ্নের চেয়েও বেশি। বেতনভাতা নিয়ে বিতর্কজর্জর দলটা পাঁচ টেস্টে হয়েছিল ধবলধোলাই, অধিনায়ক আর ব্যাটসম্যান- দুই ভূমিকার লারাকেই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল সোচ্চারে। পোর্ট অব স্পেনের প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ৫১ রানে অলআউট ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অনেকেই ক্যারিবিয় ক্রিকেটের এপিটাফ লিখে ফেলেছিলেন। লারা ঠিক করলেন, ব্যাট হাতে সব সংশয় উড়িয়ে দেবেন। ২১৩ রানের ওই ইনিংসটা ছিল দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর রূপকথার এক গল্পই।

    কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর পরও আরও কিছু কাজ বাকি থাকে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ তখনও পারে মরণকামড় দিতে, তাদের দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার জন্য দরকার ছিল আরও অতিমানবীয় কিছুর, অপার্থিব কিছুর। কে জানত, কেনসিংটন ওভালের জন্য লারা নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন?

    স্টিভ ওয়াহর দুর্দান্ত ১৯৯ আর পাকেচক্রে সুযোগ পেয়ে সেঞ্চুরি পেয়ে যাওয়া রিকি পন্টিংয়ের কল্যাণে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে করল ৪৯০। ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংসে শুরু থেকেই বিপর্যয়ে, লারাও মাত্র আট করে ফিরে গেলেন। ৯৮ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর ক্যালিপসো সুর যখন স্তিমিত, জীবনের সেরা ইনিংসটা খেলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন শেরউইন ক্যাম্পবেল। রিডলি জ্যাকবসের সঙ্গে দাঁতে দাঁত কামড়ে লড়ে গেলেন, আউট হলেন ১০৫ রান করে। শেষ দিকে অ্যামব্রোস-পেরিরা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় ফলো অন এড়াল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কে জানত, সেটাই পার্থক্য গড়ে দেবে দিন শেষে?

    সেই প্রেরণা থেকেই কি না, দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যামব্রোস-ওয়ালশ দেখা দিলেন রূদ্রমূর্তিতে। ধুঁকতে ধুঁকতে ১৪৬ রানেই অলআউট অস্ট্রেলিয়া। তারপরও কেনসিংটনের প্রহেলিকাময় উইকেটে ওই রানটাই ম্যাকগ্রা-ওয়ার্নদের জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। সেটা হচ্ছিলও, কিন্তু বাধ সেঁধে বসলেন একজন।

     

     

    লারা যখন ক্রিজে নেমেছেন, এর মধ্যেই ৭৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে টলছে ক্যারিবিয় নৌকা। একটু পর লারা আবিষ্কার করলেন, ১০৫ রান তুলতেই ৫ উইকেট নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার এগিয়ে যাওয়া তখন সময়ের ব্যাপার। শুধু নিজে অবিশ্বাস্য কিছু করলেই তো হবে না, দরকার একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গীর। জিমি অ্যাডামসে লারা পেলেন সেই চলার পথের সাথী।  

    দুজনের ১৩১ রানের জুটিটা যখন ছাড়াছাড়ি হলো, সেখানে অ্যাডামসের অবদান ৩৮। ব্রিজটাউনের বাতাসে তখন অলৌকিকের গন্ধ, বিউগলের আওয়াজ-সোল্লাসে চিৎকার যেন লারাকে করে তুলেছিল ২২ গজের হারকিউলিস। কিন্তু নাটকের তখনও অনেক কিছুই বাকি, ১০ রানের ভেতর ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাকগ্রা আবার ফিরিয়ে আনলেন অস্ট্রেলিয়াকে। আরও ৬০ রান দরকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের, হাতে আছে মাত্র ২ উইকেট।

    লারা এক হাতেই শুরু করলেন পাল্টা আক্রমণ। আর অন্য পাশে অ্যামব্রোস আরও একবার বর্ম হয়ে দাঁড়ালেন ম্যাকগ্রা-গিলেস্পিদের গোলার সামনে। একেকটি রানের সঙ্গে কেনসিংটন ওভালে উল্লাসের গগনবিদারী কোরাস, ক্যারিবিয় সৈকত থেকে কান পাতলেও যেন সেটি শোনা যাবে। এর পর আবার নাটক, জয় থেকে ৬ রান দূরত্বে আউট হয়ে গেলেন অ্যামব্রোস। ওয়ালশের ওপর ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখাটা কিছু বাড়াবাড়িই, কিন্তু কীভাবে যেন ম্যাকগ্রার দুর্দান্ত একটা ইয়র্কার ঠেকিয়েও দিলেন। বাকি কাজটা সারতে লারা ভুল করলেন না, গিলেস্পিকে কভার ড্রাইভ করেই দুই হাত উড়লেন আকাশে। ব্রিজটাউনের মাঠ একটু পরে লোকে লোকারণ্য, লারা হারিয়ে গেলেন ভক্তদের আলিঙ্গনে। ক্রিকেট আরও একবার আস্থা রাখল ভীষণ অসম্ভবে।  আর ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে টিভি সেটের সামনে নির্ঘুম বসে থাকা এক কিশোর জানল, সে এক লারা আছে, কেবলই লাবণ্য ধরে!