• চ্যাম্পিয়নস লিগ
  • " />

     

    শরণার্থী শিবির থেকে সবুজ মাঠের রাণী

    শরণার্থী শিবির থেকে সবুজ মাঠের রাণী    

    নারী ইউয়েফা ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্কের প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি। ইতিহাস, ফুটবল ঐতিহ্য- সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক পিছিয়ে। মেয়েদের ফুটবলে সাফল্যও নেই তেমন। অন্যদিকে দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানরা। যারা আবার গত ছয় আসরেই ইউরোর শিরোপা ঘরে তুলেছে বাকিদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! সবমিলিয়ে মোট আটবারের ইউরো জয়ী! এমন ম্যাচের আগে পরিষ্কার ফেভারিট কে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না! সেমিফাইনালের টিকেটটা তাই আগে ভাগেই বুক করে রেখেছিলেন জার্মান সমর্থকেরা।    


    ম্যাচের শুরুতে অনুমিতভাবে এগিয়েও যায় জার্মানি। ডেনমার্কের হারটাও মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তাতে বাধ সাধলেন একজন! নাদিয়া নাদিম। ড্যানিশ নাম্বার নাইনের দ্বিতীয়ার্ধের গোলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ম্যাচে ফিরে আসল ডেনমার্ক। ফিরে আসার সূচনাটা করেছিলেন তিনিই। ওই গোলের পরই যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় ডেনমার্কের খেলা। নাদিয়ার গোল পুঁজি করে জার্মানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লড়ে যায় ড্যানিশ মেয়েরা। হারার আগেই হেরে না যাওয়ার পুরস্কারটাও পায় তারা। আরও এক গোল করে ২-১ ব্যবধানে জিতে জার্মানিকে বিদায় করে সেমিফাইনালে উঠে যায় ডেনমার্ক! নিজেদের ফুটবল ইতিহাসটা নতুন করেই লিখল তারা। আর ১৯৯৩ সালের পর মাত্র তৃতীয়বার ইউরোতে হারের মুখ দেখল জার্মান মেয়েরা।




    ফিরে আসার গল্পটা যার হাত ধরে শুরু সেই নাদিয়া নাদিম কিন্তু আর অন্য দশটা ড্যানিশ মেয়ের মতো সোনালী চুলের নয়। তিনি একটু আলাদাই! সবার চেয়ে আলাদা তার জীবনের গল্পটাও। কাল যখন ডান দিক থেকে আসা ক্রসে মাথা ছুঁয়ে জার্মানির জালে বল জড়ালেন তখন হয়ত পেছন ফিরে তাকিয়ে পুরোনো জীবনটাকেই ধন্যবাদ জানিয়েছেন নাদিয়া। জীবনযুদ্ধ যাকে হার মানাতে পারেনি, তিনিই তো এমন মুহুর্তের জন্ম দিতে পারেন!


    তিনি ড্যানিশ নন। ডেনমার্ক নাদিয়ার আশ্রিত দেশ। একদিন ভুল করেই এসেছিলেন এ দেশটায়। তিনিই এখন ডেনমার্কের ফুটবল প্রতিচ্ছবি, পোস্টার গার্ল।

    বেশিরভাগ মেয়ের মতো তার ফুটবলের হাতেখড়িও বাবার হাত ধরেই। আফগানিস্তানে। পাঁচ বোনের একজন ছিলেন নাদিয়া। কিন্তু এখানেও ছিলেন সবার চেয়ে একটু আলাদাই! পুতুল নয়, নাদিয়ার পছন্দ ফুটবল! আফগান আর্মি জেনারেল বাবার সাথে বাড়ির উঠোনো ফুটবল খেলে সময় কাটত তার।


    সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু নাদিয়ার বয়স দশ না পেরুতেই কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল তার জীবনটা। আফগানিস্তানে তখনও তালিবান শাসন আমল। হুট করেই একদিন বৈঠকে তলব করা হয় নাদিয়ার বাবা রাবানিকে। বাকি দিনগুলোর মতোই ঘর ছাড়েন রাবানি। কিন্তু সেদিন আর ফিরে এলেন না। ফিরলেন না আর কখনই। এই ঘটনারও প্রায় ছয় মাস পর নাদিয়ার মা হামিদা বহু কষ্টে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন তার স্বামীকে ওই বৈঠক থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এক মরূভূমিতে। সেখানেই হত্যা করা হয় তাঁকে।


    হামিদা সহ ছয় নারীর সংসারে তখন একমাত্র সম্বল ওই বাড়িটাই। তালিবানদের অধীনে নারীদের কাজ করারও অনুমতি নেই। কাজ দূরে থাক, ঘরের বাইরে বের হলেই হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। মেয়েদের মুখে তিনবেলা খাওয়া জোটাতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল হামিদাকে। সবকিছুর মাঝেও বাড়ির পেছনের সেই উঠোনেই বল নিয়ে পড়ে থাকতেন নাদিয়া। শুধু বাবাই ছিলেন না। কিন্তু বাবার শিক্ষাটা ধারণ করতে পেরেছিলেন ওই ছোটবেলাতেই। চার দেয়ালে আটকে রাখলেও নাদিয়াদের স্বাধীনচেতা মনোভাবটা কখনোই কেড়ে নিতে পারেনি তালিবানরা।


    স্বাধীন জীবনের তীব্র নেশাতেই পরিবারের সবটুকু সঞ্চয়ের বিনিময়ে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন নাদিয়ার মা। যেখানে দু’বেলা খাওয়া জোটাতে কাজ করার সুযোগই নেই সেখানে যত মায়াই থাকুক- অন্তত শান্তি থাকে না। হামিদার ওই এক সিদ্ধান্তই গল্পের মতো বদলে দিয়েছিল নাদিয়াদের জীবন।


    কিন্তু আফগান তালিবানদের রক্তচক্ষু আড়াল করে দেশ ছাড়াও তো সহজ নয়! নকল পাসপোর্ট জোগাড় হল তাই টাকার বিনিময়েই। পাকিস্তান হয়ে সেখান থেকে ইতালি। এয়ারপোর্ট থেকেই নাদিয়াসহ তার বাকি পরিবারকে তুলে দেয়া হল ট্রাকে। নাদিয়ারা তখনও জানতেন, এই ট্রাকের গন্তব্যস্থল লন্ডন। সেখানে তাঁদের আত্মীয়ের কাছে ঠাঁই পাওয়ার আশাতেই তো দেশ ছেড়ে এসেছেন।


    বেশ কিছুদিন ভ্রমণের পর অবশেষে থামল সেই ট্রাক। কিন্তু লন্ডনের দ্বিতল লাল বাস, কালো ট্যাক্সি কিছুই নেই এখানে! আশে পাশে নেই কোনো সাইনবোর্ডও। ইংরেজিতেও কাউকে কিছু বোঝানো যাচ্ছে না! রাস্তায় মানুষজনও নেই তেমন। যে কাউকে জিজ্ঞেস করে নেবেন নাদিয়ারা। অনেক চেষ্টার পর একজনকে ভাষা বোঝাতে পারলেন তার মা। তিনি জানালেন জায়গাটা লন্ডন নয়, ডেনমার্ক শহরতলীর এক গ্রাম। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া এমন অনেক মুহুর্তের সাথে এই ছোট জীবনেই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল নাদিয়াদের। এ কথা শুনেও তাই খুব বেশি অবাক হলেন না বোধ হয়!
     


     


    সেখানকার এক উদ্বাস্তু শিবিরে জায়গা হল নাদিয়াদের। ভাগ্যের ফেরে ভুল ঠিকানাই যেন পরম আরাধ্য বাড়িঘর হয়ে গেল সব হারানো আফগান শরণার্থী এক কিশোরীর কাছে। সেখানে আবারও শুরু তার ফুটবল অনুশীলন। জীবনে প্রথমবারের মতো জুটল খেলার সাথী। তার মতো আরও অনেক মেয়েই এখানে ফুটবল খেলে! এমন দৃশ্য আগে দেখেনি সে। শত কষ্টের মাঝে এইটুকু শান্তিই ছিল নাদিয়ার বাঁচার অবলম্বন। কয়েকদিনের ভেতর পাশের শহরের এক ক্লাবের হয়ে প্রথম কোনো কোচের অধীনে অনুশীলনের সুযোগ পেলেন। ততোদিনে নাদিয়ার মাও কিছু কাজ জুটিয়ে ফেলেছেন। কয়েকবছর এভাবেই গেল। ডেনমার্কের ওই শহরেই একটা মাথা গোঁজার ঠাই হল নাদিয়াদের।


    শরনার্থী শিবির ছেড়ে নাদিয়া পড়লেন আরেক বিপত্তিতে। নতুন বাসা থেকে ক্লাবের দূরত্বটা বেড়ে গেছে! কিন্তু মেয়েকে বাসের টিকেটের টাকা দেয়ার মতো অবস্থা নেই নাদিয়ার মায়ের। এবার ত্রাতা হয়ে পাশে দাঁড়াল সেই ক্লাবই। নাদিয়ার জন্য বাস পাসের ব্যবস্থা করে দিল তারা।




    আনুষ্ঠানিক কোচিংয়ের সুযোগ পেয়ে অল্পদিনেই ফুটবল মাঠে ঝঙ্কার তুললেন নাদিয়া! বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে সুযোগ মিলল সিনিয়র দলে। এরপরের গল্পটা শুধু স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাওয়ার। জাতীয় দলের কোচের নজর কাড়লেন খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে খেলার সম্মতি তো তার নেই! নারী হোক যাই পুরুষ, ডেনমার্ক ফুটবল দলে ড্যানিশ ছাড়া সুযোগ মেলেনি কারও।


    তিনি ‘আলাদা’ বলেই কি না নিয়ম বদলালো তার বেলায়। জাতীয়তা নিয়েই খেলা শুরু করলেন ডেনমার্ক দলে। সহজ ছিল না সেই প্রক্রিয়াও। ডেনমার্কের জাতীয়তা পেলেও বাধ সেধেছিল ফিফা। পরে ডেনমার্ক ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় মধ্যস্থতা করে নাদিয়াকে দলে খেলানোর সবুজ সংকেত দিয়েছিল ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা। আর তাতেই নাদিয়া বনে গেলেন ডেনমার্কের প্রথম ‘ভিনদেশী’ ড্যানিশ ফুটবলার।


    বহু চড়াই-উতরাই পার করে যখন সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল খেলা শুরু করলেন ততোদিনে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে তার নাম। দু’বেলা খাওয়া জুটত না যে নাদিয়ার কপালে তিনিই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্লাব পোর্টল্যান্ড এফসির হয়ে খেলেন। যেখানে নারী ফুটবলেও গ্যালারি ভর্তি দর্শক নাদিয়ার নামে সুর তোলেন প্রতি সপ্তাহেই!


    ১৯৯২ সালে জন ইয়েনসেনের গোলে জার্মানিকে হারিয়ে ইউরো জিতেছিল ডেনমার্ক। তাঁদের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্য। তারপর অনেকদিনের সাফল্যখরা কাটিয়ে এবার নারীরাই ডেনমার্ককে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। জন ইয়েনসেন যদি ডেনমার্ক ফুটবলের স্বর্নালী ইতিহাস হয়ে থাকেন, সে তালিকায় নাদিয়া নাদিমের নামটাও তো থাকার কথা। আর দু’টো ম্যাচ জিতে গেলে হয়ত ইয়েনসেনদের কাতারেই শোনা যাবে নাদিয়ার নাম। যিনি এসেছিলেন ভুল করে, কিন্তু ভুল থেকে যদি এমন কিছু হয়, ক্ষতি কী?