• " />

     

    গ্লেন ম্যাকগ্রা : অদ্ভুত পেসার, অনন্য মানুষ

    গ্লেন ম্যাকগ্রা : অদ্ভুত পেসার, অনন্য মানুষ    

    ১.

    গল্পটি সেই ছেলেটির, যে ক্রিকেট বলে বল করতে জানতনা। গল্পটি সেই ছেলেটির, যাকে কিশোর বয়সেই তার উচ্চতা আর লিকলিকে শারীরিক গঠনের জন্যে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া হয়েছিল। শুরু থেকেই যার বোলিং নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না। অনেকের আবার ধারণা ছিল, তার শরীর একজন ফাস্ট বোলারের ভার সামলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি অজি কিংবদন্তী ডেনিস লিলিও প্রথম দেখায় বিশেষ কিছু খুঁজে পাননি ছেলেটির মাঝে। 

    ‘ওকে প্রথম যেদিন দেখি, সেদিন এসেছিল ওর থেকে কয়েক সাইজ বড় ট্রাউজারস চাপিয়ে, জুতোও ছিল অস্বাভাবিক বড়। মনে হচ্ছিল, ও হয়ত ভুলে অন্য কারো পোশাক পড়ে এসেছে। অদ্ভুত লাগছিলো দেখতে’, ছেলেটিকে প্রথম দেখার স্মৃতিচারণে স্টিভ ওয়াহর অভিব্যাক্তি ছিল এমনই। ওয়াহ হয়তো নিজেও জানতেন না, গ্লেন ম্যাকগ্রা নামের সেই অদ্ভুত ছেলেটা আরও কতো অদ্ভুত কান্ডকারখানা করবেন ফাস্ট বোলিংয়ে। 


    ২.
    ম্যাকগ্রার টেস্ট অভিষেক ১৯৯৩ সালে। সাদামাটাভাবেই। তবে তার ক্যারিয়ার সবচেয়ে বড় বাঁকটি নিয়েছিল ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে। সেই সিরিজেই আবির্ভাব হয়েছিল এমন কয়েকজন ক্রিকেটারের, যাদের হাতে শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান নতুন সাম্রাজ্যের, আর পতন হয়েছিল ক্যারিবীয়দের। 

    ২-১ ব্যবধানে জেতা সিরিজে ম্যাকগ্রার নিয়েছিলেন ১৭টি উইকেট। অস্ট্রেলিয়া ড্রেসিংরুমেও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন এরপর থেকে। সতীর্থদের দেয়া ডাকনাম জুটে গেলো তার, লম্বা পায়ের জন্য তার নাম দেয়া হল ‘দ্য পিজিয়ন’!

        

     

    বলে ছিলনা তেমন গতি, ছিলনা সত্তর বা আশির দশকের চিরায়ত অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের মতো শরীরি আগ্রাসন। দেখতে নিপাট ভদ্রলোক ম্যাকগ্রা যেন ঠিক ‘অস্ট্রেলীয়’ ফাস্ট বোলার নন। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন গোটা ক্যারিয়ার জুড়েই, ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার নিত্য নতুন কৌশল রপ্ত করায়। বলকে দুই দিকেই সুইং করতে পারতেন, আর টানা স্পেলে একের পর এক স্টাম্প লক্ষ্য করে বল করাটা তো ছিল তার জন্য ‘সহজাত’! ম্যাকগ্রার মূল শক্তি ছিল তার নিখুঁত লাইন আর লেংথের মিশ্রণ। সাথে ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার সুবাদে উইকেট থেকে পাওয়া অতিরিক্ত বাউন্স।
     
    ব্যাটসম্যানকে আউট না করা পর্যন্ত একই জায়গায় ক্রমাগত বল করতে করতে নাকি নিজের প্রতিই তার বিরক্তি ধরে যেত! তবে ম্যাকগ্রার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিল তার হার না মানা অদম্য মানসিকতা এবং আত্মবিশ্বাস। নিজের বোলিং নিয়ে তার মনে কখনোই সংশয় জাগেনি। কারন তিনি জানতেন, তিনি বলটি কোথায় ফেলতে চান। বলকে কথা বলাতে জানতেন তিনি। 
     
    ৩.
     
    এই কৌশল খাটিয়েই ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম ফাস্ট বোলার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন ১০০ টেস্ট। টেস্টে তার ৫৬৩ উইকেট ফাস্ট বোলারদের মধ্যে এখনও সর্বোচ্চ। ৩৮১ উইকেট নিয়ে ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিকও ম্যাকগ্রা। তবে এসব শুধুই সংখ্যা। এসবের পেছনে আছে অন্য এক গল্প। যে লড়াইটা ২২ গজে বোলিংয়ের চেয়েও অনেকগুণ কঠিন, যে লড়াইটা জীবনের। 

    ১৯৯৫ সালে ম্যাকগ্রার সাথে পরিচয় হলো জেন স্টিলের।  সম্পর্কে জড়ানোর বেশ কিছু পর জেন জানতে পেরেছিলেন, তিনি প্রেম করছেন আসলে এক ক্রিকেট তারকার সাথে! ১৯৯৭ সালে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়লো জেনের। জেন সরে যেতে বলেছিলেন প্রেমিককে, ম্যাকগ্রা যাননি! এরপর শুরু হলো জেনের সঙ্গে গ্লেনের লড়াই- ক্যান্সারের সঙ্গে। ১৯৯৯ সালে বিয়ে করলেন দুইজন। 

                  

    স্ত্রীর লড়াই থেকে অনুপ্রাণিত হতেন ম্যাকগ্রা। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ম্যাচ,  প্রতিটি ওভার,  প্রতিটি বলে মিশে ছিল নিজের সাথে চলা যুদ্ধ। স্ত্রী অসুস্থ থাকা অবস্থাতেও খেলে গেছেন অনবরত। দিনশেষে আবার গিয়ে স্ত্রীকে সময় দিয়েছেন। 
     
    ৪.
    খেলোয়াড়ি জীবনে ইংল্যান্ডের কাছে হার কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেন না ম্যাকগ্রা। প্রতি অ্যাশেজের আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, ‘অস্ট্রেলিয়া ৫, ইংল্যান্ড ০’। সেই ম্যাকগ্রা ক্যারিয়ারে প্রথমবার অ্যাশেজ হারলেন ২০০৫ সালে এসে। এজবাস্টন টেস্ট শুরুর আগে অনুশীলনের সময় পড়ে থাকা বলের ওপর পা পড়ে চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন। ম্যাকগ্রার সেই অদ্ভুত চোট ক্রিকেট মহাকাব্যেরই অংশ। সেই অ্যাশেজের পর স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে ক্রিকেট থেকে বাইরে ছিলেন প্রায় ৮ মাসের মতো।

    ২০০৬-০৭ সালে ঘরের মাঠে ফিরতি অ্যাশেজে ম্যাকগ্রা ফিরলেন। ততদিনে ‘বুড়িয়ে গেছেন, আর দেওয়ার কিছু নেই’ রব উঠতে শুরু করেছে চারপাশে। উত্তর দেয়ার জন্য বোলিংয়ের চেয়ে ভালো আর কিছুই জানা ছিলোনা ম্যাকগ্রার। পাঁচ টেস্টে ২৩.৯০ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে আরেকবার যেন জানান দিয়েছিলেন, সামর্থ্য তখনও আছে তার। 

             

    অস্ট্রেলিয়া জিতল ৫-০ তে, ম্যাকগ্রার ‘৫-০’-তে! সিডনির শেষ টেস্ট দিয়েই বিদায় বললেন তিনি। স্ত্রী আর পরিবারের সামনে। টেস্ট ছাড়লেও ওয়ানডে খেলছিলেন। হাতছানি ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০০ উইকেট শিকারের বিরল ক্লাবে নাম লেখানোর। তবে একদিন সকালে উঠে তার কাছে এসব মনে হতে থাকলো অর্থহীন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, ক্যারিবীয় বিশ্বকাপই হবে শেষ। ২৬ উইকেট নিলেন, ওয়াসিম আকরামকে ছাড়িয়ে হলেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। হলেন টুর্নামেন্ট সেরা। 
     

    ৫.

    ম্যাকগ্রা ক্রিকেট ছাড়লেন। আর জেন ছেড়ে গেলেন তাকে। দীর্ঘ ১০ বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে ২০০৮ সালে মারা গেলেন জেন। তবে ঠিক ছেড়ে গেলেন না, থাকলেন ম্যাকগ্রার কাছে এক অনুপ্রেরণা হয়ে। তাদের ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর হয়ে আসছে ‘গোলাপি টেস্ট’, স্তন ক্যান্সারের সচেতনতা বাড়াতে ও দাতব্য সংগ্রহে। এই টেস্টের একদিন পালন করা হয় ‘জেন ম্যাকগ্রা’ নামে।

    ক্রিকেটের অনেক বড় দূত এভাবেই হয়ে ওঠেন মানবিকতার দূত। গ্লেন ম্যাকগ্রা নামের অদ্ভুত এক পেসার ক্রিকেট হয়ে জীবনে মিশে গিয়ে হয়ে ওঠেন অসাধারণ।